ষাটের দশক। কবি কাজী নজরুল ইসলামের বয়সও তখন ছয়ের ঘরে। স্মৃতি চলে গিয়েছে। অসুস্থ। কথা বলতে পারেন না। গলা দিয়ে বিচিত্র শব্দ করেন। কিন্তু পুরো হুঁশ চলে যায়নি। সেই সময় মানুষজন তাঁকে দেখতে আসতেন। লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের মেয়েরা ফুল নিয়ে, মিষ্টি নিয়ে যেতেন। কবি ছেলেমানুষের মতো খুশি! ছাত্রীরা বলছেন, ‘‘একটা সন্দেশ খাবেন?’’ কবি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিচ্ছেন। ওঁরা খাইয়ে দেওয়ার পরে নিজেই খপ করে হয়তো আরও একটি সন্দেশ তুলে মুখে পুরলেন! ওঁরা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে আবদার করতেন, ‘‘আপনি কেমন আছেন, জানিয়ে আমাদের কিছু লিখে দেবেন না?’’ কবি সাদা কাগজে লিখেছিলেন, ‘যেমন ছিলাম তেমনি আছি/ হৃদয়পদ্মে মধু পেল মনের মৌমাছি।’
এই কবিকে আমিও দেখেছি। ওঁর বাড়িতে যাতায়াত ছিল। এক বার গিয়ে দেখি, কাজীসাহেব কোথাও নেই! খোঁজ খোঁজ। শেষ দেখি, বাথরুমের দুই দেওয়াল ধরে অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে! ভুলে গিয়েছেন, কী করতে গিয়েছিলেন, এ বার কী করবেন?
ছবি তুলতে গিয়েছি। হাঁ হাঁ করে চেঁচিয়ে উঠেছেন। দু’দিন দাড়ি কামাননি। ওই অবস্থায় ছবি তোলায় মহা আপত্তি। হাত ধরে সে দিন ঘরে পৌঁছে দিতে দিতে মনে হয়েছিল, এঁর থেকে বর্ণময় গবেষণার বিষয় আর কী হতে পারে?
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে কথা জানাতে অধ্যাপকদের একাংশের তীব্র ব্যঙ্গ। কাজী নজরুল ইসলাম আবার গবেষণার বিষয়? পরে তাঁরাই চুপি চুপি অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তাঁদের নাম যেন আমার গবেষণাপত্রে জুড়ে দিই!
এই অবহেলা কবির জীবন জুড়ে। খুব গরিব ঘরের সন্তান। মাত্র আট বছর বয়সে পিতৃহীন। বাড়িতে উপার্জনক্ষম বলতে কেউ নেই। বাধ্য হয়ে ওই বয়সে লেটো গানের দলে নাম লিখিয়েছিলেন কবি। সেখান থেকে বিভিন্ন পেশায়, বিভিন্ন উপার্জনের চেষ্টা। এ ভাবেই তিনি লেটোর গানের দল থেকে পাউরুটির কারখানায়। তার মধ্যেই পড়াশোনা। ভীষণ মেধাবী ছিলেন কবি। পড়াশোনা ভালবাসতেন। শ্রেণিতে প্রথম হতেন। ডাবল প্রোমোশন পেয়ে অষ্টম থেকে একেবারে দশম শ্রেণিতে। সেই সময় তাঁর মাথায় স্বদেশপ্রেমের আগুন। ওই বয়সেই তাঁর মনে বিপ্লব-চেতনা। তিনি এবং আর এক বন্ধু সেনাবাহিনীতে নাম লেখালেন। ফের নীরবে নিখোঁজ তিনি।
কবির নামে অপপ্রচার, তিনি নাকি যুদ্ধ করেছেন! ভুল খবর। সেনাদের পোশাক তৈরির দায়িত্ব ছিল তাঁর উপর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই তিনি কলকাতায় ফিরলেন। চাকরি পেলেন সাব ট্রেজ়ারি অফিসার পদে।
কিন্তু কবির মনে কি থিতু হওয়ার বাসনা আদৌ ছিল? তাঁর বন্ধুরা বোঝালেন, সরকারি চাকরি করলে লেখার বারোটা বাজবে। কবিও সে কথা বিশ্বাস করে চাকরি ছাড়লেন। বন্ধুদের সঙ্গে মিলে কাগজ বার করবেন ঠিক করলেন। এবং করলেনও সেটি।
কবির জীবনে প্রচুর উত্থান-পতন। বহু প্রেম। সেই প্রেম ঘিরে অসংখ্য গান, কবিতা। কবির প্রথম প্রেম মাত্র ষোলো বছরে। যে গ্রামে থাকতেন সেই গ্রামের মেয়ে স্বর্ণলতার সঙ্গে। উদ্দাম প্রেম চলছে। অন্য দিকে, কবি সেনাবাহিনীতে যাবেন। প্রেমিকার কাছে কবির আবদার, ‘একটা স্মৃতিচিহ্ন দাও। যা দিয়ে তোমায় মনে করব।’ প্রেমিকা মাথার একটি কাঁটা দিয়েছিলেন। পরে সেই প্রেমিকাকে একটি কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন কবি। ভূমিকায় সেই উপহারের উল্লেখ করেছিলেন।
এ ভাবেই তাঁর জীবনে এসেছিলেন নার্গিস। বন্ধু আলি আকবর খানের ভাগ্নি। আলি আকবর তাঁকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন কুমিল্লায়। ভাগ্নির সঙ্গে বিয়ে দেবেন। সব ঠিক। চারিদিকে নিমন্ত্রণপত্র বিলি হয়ে গিয়েছে। বিয়ের সন্ধ্যায় কবি জানতে পারলেন, বৌ নিয়ে তিনি কুমিল্লার বাইরে যেতে পারবেন না! সঙ্গে সঙ্গে বেঁকে বসলেন কবি। বুদ্ধি করে কোনওমতে সেখান থেকে পালিয়ে চলে আসেন। কবির প্রথম বিয়ে ভেঙে গেল।
সেই সময় কবি মানসিক আশ্রয় পেয়েছিলেন প্রমীলার কাছে। সেই আশ্রয় ক্রমশ তাঁর কাছে ভরসার স্থল হয়ে ওঠে। প্রমীলা প্রেমে পড়েন কবির। তাঁদের সেই প্রেমের ছায়া বহু কবিতায়। যেমন, ‘কবি-রাণী’। কবি লিখেছিলেন, ‘তুমি আমায় ভালবাসো তাই তো আমি কবি, আমার এ রূপ-সে যে তোমার ভালবাসার ছবি।।’
এ দিকে, সেই সময়ে হিন্দু মেয়ের সঙ্গে মুসলিম ছেলের প্রেম সমাজ মানবে কেন? বাংলাদেশে ঢি-ঢি পড়ে গেল। সকলেই বিরূপ কবির প্রতি। বাধ্য হয়ে তিনি কলকাতায় চলে এলেন। চিঠিতে চিঠিতে প্রেমের ইজাহার। শেষে আর সামলাতে না পেরে হবু শাশুড়ি গিরিবালা প্রমীলাকে নিয়ে কলকাতায় এলেন। কবিকে সব জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘তুমি কি আমার মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে?’’ কবি রাজি। বন্ধুরা দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিলেন। শুরু হল নতুন জীবন। শেষ দিন পর্যন্ত দু'জনে এক সঙ্গে ছিলেন। প্রমীলা খাইয়ে না দিলে কবি খেতেন না! কবি নিজে কালীপুজো করতেন। দেবীর ভক্ত ছিলেন তিনি। অসংখ্য শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন। যা বহুল জনপ্রিয়।
আরও পড়ুন:
তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মহম্মদ। যদিও সেই পুত্র রক্ত আমাশায় মারা গিয়েছিল। দ্বিতীয় সন্তান বুলবুল। ভীষণ মেধাবী, ক্ষণজন্মা। বাবার গান মন দিয়ে শুনত। আর হুবহু মনে রেখে দিত। কবি ভুলে গিয়ে গানের সুর বদলে ফেললে বুলবুল ধরিয়ে দিত সঙ্গে সঙ্গে। মাত্র চার বছর বেঁচেছিল। বসন্ত রোগে মৃত্যু হয় তার। ছেলে মৃত্যুশয্যায়। বাবা বিষাদে কবিতা লেখাই ছেড়ে দিলেন! সন্তানের মাথার কাছে বসে ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর অনুবাদ শেষ হতেই বুলবুল চিরবিদায় নেয়। কথিত, সেই সময় নাকি কবি লিখেছিলেন ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয়’ বা ‘বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে।’ ভুল কথা। এ সব কবি দ্বিতীয় সন্তানের মৃত্যুর আগেই লিখেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন খ্যাতির চূড়ায়। কিন্তু তাঁর প্রতি বা তাঁর খ্যাতির প্রতি কোনও অসূয়া ছিল না নজরুলের । রবীন্দ্রনাথও কোনও দিন কাজীসাহেবকে ঈর্ষা করেননি। কাজীসাহেব তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’, ‘সঞ্চিতা’ রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেছিলেন। এক বার কবিকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ সংবর্ধনা জানাবে। সেখানে নজরুল যথারীতি আমন্ত্রিত নন। তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রয়োজন কেউ অনুভব করেননি। যা-ই হোক, কাজীসাহেব নিজেই উপস্থিত। কিন্তু ভিতরে ঢুকতে পারছেন না। ভীষণ ভিড়। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখতে পেয়ে সাদরে ভিতরে ডেকে নিলেন। পাশে বসালেন। বাকিরা মহাবিরক্ত! কবিগুরু এ কী করছেন? সে দিন রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘‘হয় ওকে তোমরা চিনতে পারোনি। নয় ওর লেখা বুঝতে চাওনি। আমি ওর বয়সে থাকলে ও যা লিখেছে সেটাই লিখতাম।’’ কেন কাজীসাহেবকে তিনি হিংসা করবেন? রবীন্দ্রনাথ জানতেন, তাঁর থেকে অনেক বেশি লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। সে সব লেখা তাঁর লেখার থেকে অনেক বেশি জনপ্রিয়। কাজীসাহেবের লেখা কুলি থেকে কেরানি, সকলে পড়তেন। পার্থক্য একটাই, রবীন্দ্রনাথ প্রচণ্ড নিয়মনিষ্ঠ, ক্যালকুলেটিভ। নজরুল হৃদয়ের কবি, প্রেমের সহচর। তিনি হৃদয়ের ডাকে সাড়া দিতেন। যেটা মনে করতেন সেটাই করতেন। কাজীসাহেবকে রবীন্দ্রনাথ নন, প্রবল হিংসা করতেন কবি জীবনানন্দ দাশ, জসিমুদ্দিন।
৪২ বছর এ ভাবে শিল্প-সংস্কৃতির দুনিয়ায় নিজেকে প্রমাণিত করার পর কবি অসুস্থ। তাই নিয়েও নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন, প্রমীলার সঙ্গে প্রেম চলাকালীন পাড়ার ছেলেরা তাঁর মাথায় নাকি লোহার রড দিয়ে মেরেছিল। সেই আঘাতের ফলাফল এই অসুস্থতা। কারও দাবি, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এই অসুস্থতার নেপথ্যে। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় থেকে নীলরতন সরকার, দেখেছিলেন তাঁকে। এক বার কবিবন্ধুরা মিলে চাঁদা তুলে তাঁকে বিদেশ পাঠিয়েছিলেন। সেখানকার চিকিৎসকেরা জানান, কবি ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন। যা কোনও দিনই সারবে না। কোনও দিন হারানো স্মৃতি ফিরবে না তাঁর!
সুস্থ অবস্থায় কবির শেষ সংবর্ধনা। লোকে লোকারণ্য সভা। তাঁকে ভালবাসার লোক অসংখ্য। কবি আঘাতও পেয়েছেন প্রচুর। প্রচুর ঠকেছেন। যা-ই হোক, কবি সংবর্ধনা নিলেন। তাঁর অভিমান তাঁকে দিয়ে লেখাল, ‘যে দিন আমি হারিয়ে যাব বুঝবে সে দিন বুঝবে, অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে..... গাইতে বসে কণ্ঠ ছিঁড়ে আসবে যখন কান্না, বলবে সবাই- ‘সেই যে পথিক তার শেখানো গান না?’’