Advertisement
E-Paper

হাসতে হাসতে আত্মদর্শন

বিজ্ঞাপনী প্যাকেজিংয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালি। শাশ্বত দুর্দান্ত। রাইমা স্বতঃস্ফূর্ত হলে পারতেন। লিখছেন সংযুক্তা বসু।বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে...‘পালামৌ’য়ের লেখক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই উপলব্ধিই বাঙালির সত্যি সত্যি কাল হল! মাতৃক্রোড় থেকে তার মুক্তি নেই। আর মুক্তি যদি বা ঘটেও, পদে পদে মায়ের কোলের পিছুটান। সে কিছুতেই আর নিজের ভাষা বা প্রকাশভঙ্গি খুঁজে পায় না।

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৪ ০০:০২

বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে...‘পালামৌ’য়ের লেখক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই উপলব্ধিই বাঙালির সত্যি সত্যি কাল হল!

মাতৃক্রোড় থেকে তার মুক্তি নেই। আর মুক্তি যদি বা ঘটেও, পদে পদে মায়ের কোলের পিছুটান। সে কিছুতেই আর নিজের ভাষা বা প্রকাশভঙ্গি খুঁজে পায় না। এই রকম এক বিভ্রান্তিতে নাজেহাল ছবির নায়ক শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে হাসির ছড়রা বইয়ে দেওয়া স্যাটায়ার দেখতে গত রবিবার ‘বাড়ি তার বাংলা’ ছবির গায়ে ঝুলেছিল নব্বই শতাংশ হাউস ফুলের বোর্ড। মাল্টিপ্লেক্স চেনে।

মননময় হাসির রসদ আর কিছুটা বিদ্রুপ নিয়ে বাঙালিমানসকে নিজের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিতেই গল্পের জাল বুনেছেন পরিচালক রংগন চক্রবর্তী। বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় অনেক অভিজ্ঞতার পর যিনি এর আগে পরিচালনা করেছিলেন হাসির ছবি ‘বর আসবে এখুনি’। এবার পরিচালক ঝুঁটি ধরে টান দিতে চেয়েছেন বাঙালি মধ্যবিত্ত ভাইসেসের। সংলাপের পানিং, উদ্ভট দৃশ্যকল্প রচনা, মজার মজার কথায় গানে গেঁথে কটাক্ষ করেছেন সেই বাঙালিকে যাঁরা নিজেরাই নিজেদের উদ্দেশে বলে ‘হুঁকো মুখো হ্যাংলা, বাড়ি তার বাংলা।’

বছর চল্লিশের শাশ্বত বিজ্ঞাপনসংস্থার সফল কপিরাইটার থেকে হঠাত্‌ই বেকার হয়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারেন তিনি নিজে থেকে আর কিছুই লিখতে পারছেন না। কারণ এত দিন তিনি যা লিখেছেন তা সবই ফরমায়েশি। অনুভূতিটা তাঁকে এতটাই অবসাদে ভোগাতে থাকে যে মনোবিদের কাছে যেতে হয়। মনোবিদ রাইমা সেন ঢুকে পড়েন শাশ্বতর অতীতে। যিনি চার মাস বয়স থেকে কেবলই বিজ্ঞাপনের ভাষাতেই কথা বলেছেন। বলেছেন, মা তুলিকা বসুর দিকে তাকিয়ে, “তোমার আমার সবার সুখ বুকের দুধ’’, বলেছেন ‘বুকের দুধের কোনও বিকল্প নেই”। মায়ের প্রেরণাতেই শাশ্বত ধীরে ধীরে বিজ্ঞাপন জগতে ঢোকেন। কারণ রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যজিত্‌ রায় সকলেই বিজ্ঞাপন নিয়ে কাজ করেছেন। শাশ্বতও লেখেন, “সোহাগি সিঁদুর: দেখা হবে সিঁথির মোড়ে’ কিংবা ‘এসি দাশের রসগোল্লা: টিপে নিয়ে চুষে খান’।

রসবোধ, ব্যঙ্গ, শ্লেষ, ভাষার চমক মিলিয়ে রংগনের গল্পে এসে পড়ে শাশ্বতের রাজনৈতিক জীবন। কারণ দশচক্রে বাঙালি রাজনীতির প্যাঁচে জড়াবেই জড়াবে। আর তারই বুলি আউড়ে কেটে যায় জীবন। এটাই দস্তুর। সেখানেও চোস্ত ক্যাপশন লেখেন শাশ্বত ‘হয় মেরুন নয় মরুন’। ‘এবার বাংলার গায়ে হলুদ’। চমকিত করে বোরোলিনের সুরে কেরোসিন তেল নিয়ে শাশ্বতর বিজ্ঞাপনের কপি, “সারা গায়ে ঢেলে দিন/ সুরভিত এক টিন কেরোসিন/বউ গন/আবার পণ”।

রঙ্গরসের জ্বালাময়ী ওয়ানলাইনার-এর মধ্যে গল্পে সুন্দর ভাবে মেলে ধরেছেন পরিচালক মধ্যবিত্তের মার্কিন ডলার লোভ, রাজনীতির গায়ে হেলান দেওয়া নির্বিকারত্ব, রাজনৈতিক দাদাগিরির সুযোগ সর্বস্বতার মতো চিরকালীন কিন্তু সাম্প্রতিক গরমাগরম বিষয়।

কিন্তু অতিরিক্ত ‘পান’, ওয়ালাইনারের গুরুভার অবশ্য মাঝে মাঝে ক্লান্তি আনে। কখনও বা সংলাপ ভালগারিটির সীমাও ছুঁয়ে ফেলেযেটা কিনা একজন বিচক্ষণ ছবিকরিয়ের কাছে কাম্য নয়। বিভিন্ন পণ্যের ব্র্যান্ডিং গল্পের মধ্যে অত প্রট না হয়ে আরও সূক্ষ্ম হতে পারত। ছবি দেখতে দেখতে মনে পড়ল আর এক ছবির অভিজ্ঞতা। যদিও তুল্যমূল্য বিচারে তার তুঙ্গ জনপ্রিয়তা, সামাজিক মেসেজ, ফর্ম একেবারে ভিন্ন মাত্রায় বাঁধা। ‘ভূতের ভবিষ্যত্‌’। সে ছবির পরিচালক অনীক দত্তও বিজ্ঞাপনের ব্যক্তিত্ব।

বিজ্ঞাপন জগতের ছবিকরিয়েরা কপি এবং ভিশু্যয়ালের সামঞ্জস্য আনতে গিয়ে সিনেমাকেও কি ওয়ানলাইনারের দৃশ্য-কল্পনায় ভাবতে থাকেন? সিনেমার তো নিজের একটা ভাষা আছে। বছরে এক আধবার সরস পানিংয়ে তৈরি ছবির স্বাদ পেতে ভালই লাগে। কিন্তু বারবার নয়।

সামাজিক স্যাটায়ারের প্রকাশভঙ্গি হিসেবে আশা করা যায় এর পর রংগন যে ছবি করবেন তার গঠনশৈলী আলাদা হবে। দেবজ্যোতি মিশ্রের সুরে ছবির গান সরস, শ্রুতিমধুর।

রাইমা সেন আর শাশ্বতর প্রেমের দৃশ্যগুলো আর একটু উন্মোচিত হতে পারত। রংগনের লেখা গান ‘আনমনে যদি কফি কাপ থেকে ঠোঁটে লেগে যায় উত্তাপ’ এক রোম্যান্টিক শ্রবণ। রাইমা আর একটু স্বতঃস্ফূর্ত হলে পারতেন। যে কোনও মনোবিদেরই রুগির সঙ্গে কথায়বার্তায় একটা আন্তরিকতকার ছোঁয়া থাকে। তুলিকা বসু, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায় সুমিত সমাদ্দারের অভিনয় আলাদা করে নজর কাড়ে।

কমেডি অভিনয়ের দুর্দান্ত গুণ নিয়ে হাজির শাশ্বত। আবার একই ছবিতে সফল ভাবে তিনি ট্র্যাজিক হিরোও। তিনিই মিলিয়ে দেন ট্র্যাজেডি আর কমেডি। মায়ের সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক নিয়ে তুলিকার মুখে একটি গানে ঝরে পড়ে বাঙালি মায়ের সন্তানকে ঘিরে আশা প্রত্যাশা উচ্চাকাঙ্ক্ষা। সবে মিলে উপভোগ্য ছবি। কিন্তু বিজ্ঞাপনী চটক কম থাকলে ছবিতে সরলতার গুণটা যোগ হত। সিনেমাটিক মূল্যায়নে প্রশ্নচিহ্ন থাকলেও ছবি দেখার তাত্‌ক্ষণিক মজা স্বীকার না করে উপায় নেই। বুদ্ধিদীপ্ততা আর মুখরোচক হাসির মিশেলে ভরপুর উপভোগ্য ছবি।

bari tar bangla Movie Reviews sanjukta basu
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy