Advertisement
E-Paper

অকথ্য গালিগালাজ, পুরুষতন্ত্রের দাপট, মাঝারি অভিনয়, কী প্রাপ্তি ‘লজ্জা’র দ্বিতীয় সিজ়নে?

মুখের কথায় চাবুক মেরে যে শুধু প‍ুরুষতন্ত্র জিতে যায়, তাই-ই নয়। জিতে যায় ক্ষমতা, প্রতিপত্তি।

দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:১০
সিরিজ় ‘লজ্জা ২’ কতটা লজ্জা দেবে?

সিরিজ় ‘লজ্জা ২’ কতটা লজ্জা দেবে? ছবি: সংগৃহীত।

‘লজ্জা’ ১ এবং ২, দু’টি সিজ়ন পর পর দেখা সময়ের অপচয়, কারণ অনাবশ‍্যক দীর্ঘায়িত। মোদ্দা কথা, ‘লজ্জা’ ওয়েব সিরিজ়টি অকথ‍্য গালিগালাজের মাধ্যমে গৃহহিংসার বিষয়টি তুলে ধরেছে চড়া দাগের ‘নারীবাদ’-এর মোড়কে।

সিজ়ন ২-এর শুরুতে দেখা যায়, প্রধান চরিত্র জয়া একটি অপ্রীতিকর ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছে উকিল বন্ধু শৌর্যের হৃদ্‌রোগে মৃত্যুর পর। স্থানীয় থানার পুলিশ অফিসার কোনও মহিলা সহকর্মী ছাড়াই জয়াকে বিভিন্ন ভাবে অপদস্থ করছিলেন। মেলোড্রামা করতে গিয়ে কিছুটা খাপ পঞ্চায়েতের ঢঙে সেই হোটেলের বাগানেই বসে গিয়েছিল বিচারসভা। সকলেরই উদ্দেশ্য, জয়ার চরিত্রহনন। জয়ার স্বামী পার্থ গালাগালির ফুলঝুরি ছোটাচ্ছিল । দু’টি সিজন জুড়ে ‘পার্থ সিন্‌হা’র এটাই একমাত্র কাজ দেখানো হয়েছে।

২০২৫-এ কোনও পুরুষ বা নারী পাবলিক প্লেসে, কর্মস্থলে, হোটেলে, রেস্তরাঁয় ক্রমাগত এ ভাবে গালিগালাজ করে চলেছেন এবং পার পেয়ে যাচ্ছেন, বাস্তবিক মেনে নেওয়া দুষ্কর। অকুস্থলে হঠাৎ করে আবির্ভূত হয় শৌর্যের স্ত্রী স্নেহা, যে কিনা মিউচুয়াল সেপারেশনে থেকেও শুধুমাত্র চিন্তিত বরের পরকীয়া প্রেম নিয়ে। স্নেহা, পার্থের সঙ্গে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে জয়াকে সামাজিক হেনস্থা করার জন্য। জয়ার বাবার পারলৌকিক কাজের দিনে তাকে অশ্রাব্য ভাষায় মৌখিক অপমান চূড়ান্ত মেলোড্রামা বলে মনে হয়েছে। চিত্রনাট্যের দুর্বলতার জন‍্যই এই মুহূর্তগুলি সৃষ্ট। অযথা লম্বা করা হয়েছে সিরিজ়টি, যার ফলে চিত্রনাট্য দুর্বল হয়েছে। সিরিজ় হারিয়েছে আসল উদ্দেশ্য।

‘লজ্জা ২’ সিরিজ়ে শাঁওলি চট্টোপাধ্যায়, প্রিয়াঙ্কা সরকার।

‘লজ্জা ২’ সিরিজ়ে শাঁওলি চট্টোপাধ্যায়, প্রিয়াঙ্কা সরকার। ছবি: সংগৃহীত।

শুধু মেয়েরাই শিকার নয়, বহু পুরুষ এবং তৃতীয় লিঙ্গও যে এই ভাষ‍্য কদর্যতার জন‍্য অপমানে জর্জরিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত, সেই জায়গাগুলো কোত্থাও প্রকাশ পায়নি। মুখের কথায় চাবুক মেরে যে শুধু প‍ুরুষতন্ত্র জিতে যায়, তাই-ই নয়। জিতে যায় ক্ষমতা, প্রতিপত্তি। যেহেতু গালি একটি স্ল‍্যাং, এর মূল বিষয় নারীকেন্দ্রিক। নারীর যৌনতা, যৌনাঙ্গের ইঙ্গিতবাহী। ভাষাবিদ ও সমাজতাত্ত্বিকেরা ভাষার মাধ্যমে লিঙ্গবৈষম্যের কথা বলেছেন। ‘ডিকশনারি অফ আমেরিকান স্ল্যাং’ তৈরির সময় সত্তরের দশকে লক্ষ‍ করা গিয়েছিল, অধিকাংশ মার্কিন গালি তৈরি এবং ব্যবহৃত হচ্ছে পুরুষের দ্বারা। সম্মানহানি করা হচ্ছে, গালি দেওয়া হচ্ছে যাকে তিনি মা, বোন বা স্ত্রী। পুরুষতন্ত্রের ধারক-বাহক মেয়েরাও এই অশ্রাব্য গালি দেন মেয়েদের। পরিচালক চমৎকার ভাবে এটি দেখিয়েছেন। কিন্তু তুলনামূলক ভাবে পুরুষকে অপমান করার জন‍্য মহিলাদের কথ‍্য অত‍্যাচারের ঘটনাগুলো একেবারে অনুপস্থিত। চিত্রনাট্য এ ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ।

বহু দিন পর বর্ষীয়ান অভিনেতা দীপঙ্কর দে-কে এই সিরিজে দেখতে পাওয়া একটি বিশেষ প্রাপ্তি। দুঁদে আইনজীবী অমর্ত্য সেনগুপ্তের ভূমিকায় দুরন্ত অভিনয় করেছেন। মূল চরিত্রে প্রিয়াঙ্কা সরকারের অভিনয় একঘেয়ে। দু’টি সিজ়ন জুড়ে জয়া একই রকম বিষাদগ্রস্ত। এমনকি শেষ দৃশ‍্যে নৈতিক জয় হওয়ার পরেও জয়ার মধ‍্যে দৃঢ়তা ও উৎফুল্লতা প্রকাশ পায়নি। বাকিদের অভিনয় যথাযথ। নিঁখুত চরিত্রাভিনয়ে অনুজয় চট্টোপাধ‍্যায় মূর্তিমান ‘পার্থ সিন্‌হা’। সহকর্মী, বান্ধবী মৌ মিত্রের চরিত্রে শাঁওলি চট্টোপাধ‍্যায়ের অভিনয় সাবলীল। খেয়ালী দস্তিদারের মতো শক্তিশালী অভিনেত্রীকে আরও মুনশিয়ানার সঙ্গে ব‍্যবহার করা যেতেই পারত সিরিজ়টির বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে।

সিজ়ন ২-এর ভাললাগার দৃশ্যগুলির মধ‍্যে একটি কোর্টরুমের বাইরে জয়ার সঙ্গে তার মেয়ের মিলন। মায়ের অবদানকে কন‍্যা যখন বুঝতে পারে, মাতৃত্ব সেখানে সফল। বিপরীতে, জয়া যখন তার মাকে বলে, “আমি তো পাগল নই, মানসিক ভারসাম্যহীন নই। আর যদি মানসিক অবসাদ হয়েই থাকে, তা হলে কেন হয়েছে, এক বারও জিজ্ঞেস করেছ?” তখন পরিষ্কার হয়ে যায় বিবাহিত মেয়ের প্রতি এবং মানসিক ভারসাম্যহীনদের প্রতি সমাজের উপেক্ষা, ঔদাসীন্য। মানসিক অবসাদের প্রেক্ষিতে সাইকোলজিস্টের চরিত্রটি দক্ষ ভাবে ফুটিয়েছেন কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। জয়ার প্রতি তাঁর একটি সংলাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ— “বাইজিদের মতো গান গাইতে পারলে জীবন বর্তে যাবে!” দীপঙ্কর দে-র সংলাপটিও শক্তিশালী— “বিয়ে গেছে, সংসার গেছে, বাপের বাড়িটাও গেছে। দেয়ার ইজ় নাথিং টু লুজ়। নিঃস্ব হয়ে খেলার মজাটাই আলাদা।‘’

‘লজ্জা ২’র রেটিং চার্ট।

‘লজ্জা ২’র রেটিং চার্ট। ছবি: আনন্দবাজার ডট কম।

বিস্তর ফাঁকফোকর থাকা সত্ত্বেও তাই ‘লজ্জা’ ভিকটিম মেয়েদের জীবনের ছবি। ‘মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’ যে আপ্তবাক‍্য নয় , সেটাও কাহিনিকার ছোট বোন টিয়ার মাধ‍্যমে এবং আইনজীবী স্নেহার মাধ‍্যমে বুঝিয়েছেন। তবে আটত্রিশ বছর বয়স অবধি নিষ্প্রভ জীবন কাটিয়ে, পারিবারিক লাঞ্ছনার শিকার হয়ে হঠাৎ করে ডিভোর্সের ছ’মাস পরে কোনও খোরপোশ না নিয়ে জয়া নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র কাউন্সেলিংয়ের সুবাদে, সেটা অবাস্তব। শেষটা বাস্তবসম্মত হওয়া দরকার ছিল।

আবহসঙ্গীত যথাযথ। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব‍্যবহার সুপ্রযুক্ত। ওয়েব সিরিজ় হিসেবে ‘লজ্জা’ আহামরি কিছুই নয়, তবে বিষয় নির্বাচনের সাপেক্ষে কাহিনিকার ও পরিচালকের প্রশংসা প্রাপ্য। কারণ, সেই অমোঘ প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছে। ধর্ষিতার ক্ষেত্রে আজও তার নাম, চেহারা প্রকাশ করা যায় না। ভিকটিম ব্লেমিং হয় ধর্ষিতার পোশাক-আশাক, চরিত্র, পেশা নিয়ে।

প্রশ্নটা হল— “কে লজ্জা পাবে, ভুক্তভোগী না কি নির্যাতনকারী?”

Lojja 2 hoichoi Web Series Priyanka Sarkar Dipankar De Anindita Bose Anujoy Chattopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy