রব কিংসলে ও এলভিস প্রেসলি
দেখতে অবিকল একই রকম। সেই সাদা শার্ট, বেলবটস ট্রাউজার্স, গলায় এক গুচ্ছ সোনার হার। হেয়ারস্টাইলটা অদ্ভুত।
প্রতি মুহূর্তে বদলে যায় জুতোর রং। কখনও সাদা, কখনও লাল, আবার কখনও সোনালি।
মঞ্চে উঠে নিজের বাঁ-হাতের তালুতে বন্দি করেন মাইকটা। দর্শকদের উদ্দেশে ছুড়ে দেন নানান শব্দ। আবার কয়েক মুহূর্তে হঠাৎ উধাও। মঞ্চে পড়ে থাকে কিছু স্মৃতি, কিছু অদ্ভুত সুর, আর...এলভিস প্রেসলি। রক অ্যান্ড রোলের অবিসংবাদিত আইকন।
আসলে, রব কিংসলে।
দেখতে এলভিসের মতো। এডিনবুর্গে যে পাড়ায় থাকেন সেখানে সবাই তাঁকে একডাকে চেনে। অবশ্য একটা অন্য নামে। ‘কিঙ্গ অব রক’।
যে কোনও প্রান্তে শো করতে গেলে যে পরিমাণ মানুষ অটোগ্রাফ বা সেলফির আবদার করেন, তাতে মাঝে মাঝে নিজেই বুঝতে পারেন না, তিনি আসলে কে? রব, না এলভিস?
দীর্ঘ সাড়ে তিন দশক ধরে এলভিসকে নিয়ে তাঁর সংসার। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এলভিস সেজে গান গেয়ে বেড়ান। সঙ্গী আরও চারজন মিউজিশিয়ান, যাঁরা প্রত্যেকেই মনে মনে বাস করেন সত্তরের সেই দামাল দশকে। ‘‘সেই তিন বছর বয়সে এলভিসের গান শুনি।
তার পর মানুষটার প্রেমে পড়ি। মাঝে মাঝে মনে হয় এলভিস না থাকলে আমার কী হতো? হয়তো অন্য কিছু করতাম, কিন্তু এখন যে রকম আনন্দ পাই, তা পেতাম না,’’ আনন্দplus-কে বলছিলেন রব স্বয়ং।
বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে সারা বছর ‘ভিশন অব এলভিস’ শো করলেও কোনও দিন ভারতে আসা হয়নি মঞ্চের এলভিসের। কিন্তু রবিবার প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব রায়েল পদমসির আয়োজনে মুম্বইয়ের এনসিপিএ প্রেক্ষাগৃহে প্রথমবার মঞ্চে যখন দেখা গেল রবকে, দর্শকরাও পড়লেন ধন্দে। ইনি রব, না সত্যিকারের এলভিস! অনেকেই জানতে চাইলেন, পরের শো কোথায়?
উদ্যোক্তারা বলছেন, সব ঠিকঠাক চললে, ডিসেম্বরে কলকাতার মঞ্চও কাঁপাতে পারেন রকস্টার রব।
‘‘ভারতেও এলভিসের প্রবল জনপ্রিয়তা। এবং, আমাদের লক্ষ্য ছিল প্রত্যেক এলভিস-ভক্তকে সেই পুরোনো দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাতে আমরা সফল,’’ বলছিলেন রব।
তাঁর নিজের জীবনটাও অনেকটা সিনেমার মতো। বছর পঁচিশ আগে, লন্ডনের অলি-গলিতে গিটার হাতে গান গাওয়ার পর সবাই যখন ভাবতে শুরু করেছে যে, এই ছেলেটার আর কিছু হবে না, রব হঠাৎ যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। রয়্যাল স্কট আর্মিতে যোগ দিয়ে পৌঁছে যান জার্মানিতে, যেখানে একদা কাজ করতেন তাঁর গুরু। এলভিস স্বয়ং!
বছরখানেক পর শুরু হয় প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ। এবং, সেখানেও হাজির রব। যে হাতে এত দিন গিটার ধরতেন, সেই হাতেই ওঠে বন্দুক। তবু, রবের গলায় শান্তির গান। ‘‘এলভিসও এক সময় সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন, এবং সেই কারণেই আমিও সেনায় যোগ দিই। চতুর্দিকে যখন মৃত্যু মিছিল, ভয়ের পরিবেশ, তখন আমি গিটার নিয়ে এলভিসের গান শোনাতাম সতীর্থদের,’’ বলছিলেন রব।
কথা বলতে বলতে একটু থামলেন। তার পর আবার যেন ফিরে গেলেন অস্থির সেই সময়ে। ‘‘এলভিস কোনও দিন চাইতেন না যুদ্ধ হোক, মানুষ মারা যাক। এবং, যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে আমিও সেই শান্তির গানই গাইতাম। প্রতি সন্ধ্যায় একের পর এক এলভিসের গান শোনাতাম বিমর্ষ সতীর্থদের,’’ স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে বলছিলেন রব।
নব্বইয়ের মাঝামাঝি, যুদ্ধ শেষের পর সেনার চাকরি ছেড়ে ফিরে আসেন এডিনবুর্গে। বন্ধুদের নিয়ে শুরু করেন ‘এলভিস ব্যান্ড’। তাঁর পৃথিবী জুড়ে তখন যে সেই সাদা শার্ট, সাদা বেলবটস, আর...এলভিস প্রেসলি।
সেই শুরু। ‘‘তার পর থেকে কোনও দিন অন্য কারও গান গাইনি। যুদ্ধের সময়েই বুঝে যাই, এলভিস ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না,’’ মৃদু হেসে বলছিলেন রব।
লড়াইটা অবশ্য যথেষ্ট কঠিন ছিল। প্রথম যে দিন পরিবারের সবাইকে নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানালেন, কেউই মানতে পারেননি। অনেকে আপত্তি জানিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর চাকরি ছাড়া নিয়েও। কিন্তু পাশে ছিলেন স্ত্রী মারি। ‘‘আমার মতো মারি-ও এলভিস-পাগল। ও না থাকলে আমি কোনও দিনই এত ভাল গাইতে পারতাম না,’’ বলছিলেন রব।
অনিশ্চয়তার জীবন, তার ওপর হাতে পয়সা নেই। গোড়ার দিকে ভাড়া করা পোশাক পরেই মঞ্চে উঠতেন রব। ‘‘ভাড়ার পোশাক সব সময় ঠিকঠাক ফিট হতো না। তবু তারই মধ্যে মারি জানত কী করে আমাকে এলভিস সাজাতে হয়,’’ তিনি বলছিলেন।
কিছু দিন এদিক ওদিক শো করার পর, ওয়েম্বলি-র সামনে একটি স্ট্রিট শো-তে এক বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা হয় রবের। তাঁকে দেখে চুমু খান সেই বৃদ্ধা, নেন অটোগ্রাফও। মিনিট কয়েক পর রব বুঝতে পারেন, বৃদ্ধা আসলে তাঁকে এলভিস ভেবে ভুল করেছেন। ‘‘সেদিন মনে হয়েছিল, আমার প্রচেষ্টা সফল। তার পর থেকে যেখানে গেছি লোকে এলভিস ভেবে ভুল করেছে,’’ বলছিলেন রব।
আসলে চার দশক আগে এক যুবক শুধু মঞ্চ শাসন করেননি, শিখিয়েছিলেন যে, রক সঙ্গীতের কোনও দেশ হয় না, ধর্ম হয় না। সাদা শার্ট আর বেলবটসের সেই বেহিসেবি যুবক আসলে নেহাত একজন শিল্পী ছিলেন না।
তাঁর ভক্তদের কাছে তিনি এখনও যে রক অ্যান্ড রোল রাজ্যের ‘প্রথম রাজা’। এলভিস!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy