নায়কের মারকাটারি সংলাপে সিনেমা হল উল্লাসে ফেটে পড়ে, তাতে নতুন কিছু নেই। ‘জওয়ান’ ছবির হাততালি-পড়া এক দৃশ্যে আজাদ চরিত্রটি বলেছিল, ‘‘যে আঙুল দিয়ে ভোটযন্ত্রের বোতাম টেপেন, নেতারা ভোট চাইতে এলে সেই আঙুল তুলেই তাঁদের প্রশ্ন করুন। ভয়, পয়সা, জাতপাত, ধর্ম-সম্প্রদায়ের জন্য ভোট দেওয়ার বদলে প্রশ্ন করুন, ‘আগামী পাঁচ বছর আমার দেশের জন্য আপনি কী করবেন?’’’ আজাদ-বেশী শাহরুখ খানের এই সংলাপকে কিন্তু নিছক ফিল্মি মনে হয়নি অনেকেরই। দেশে অসহিষ্ণুতার বাড়বাড়ন্ত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করায় এই শাহরুখকেই তো এক দিন বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথ তুলনা করেছিলেন লস্কর প্রধান হাফিজ় সইদের সঙ্গে!
‘জওয়ান’-এ অভিনীত দ্বৈত চরিত্র সেই শাহরুখকেই এনে দিল ২০২৩ সালের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার। এবং অবশেষে! ষাটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে জীবনের প্রথম জাতীয় পুরস্কারটি পেলেন শাহরুখ। ‘জওয়ান’-এ ভোট নিয়ে ওই সংলাপ যেমন আজাদের, তেমনই ভক্তেরা কী করে ভুলবেন আজাদের বাবা বিক্রমের চরিত্রে শাহরুখের আর এক হিট সংলাপ, যার বঙ্গানুবাদ হয়, ‘‘ছেলের গায়ে হাত দেওয়ার আগে বাপের সঙ্গে কথা বল্।’’ অনেকেই বলেছিলেন, বিক্রমের মুখোশের আড়ালে এ যেন বিতর্কিত মাদক-কাণ্ডে জেলে যাওয়া আরিয়ান খানের বাবারই গলা।
জাতীয় পুরস্কারের খবর পেয়ে শাহরুখ বলেছেন, এই পুরস্কার তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, অভিনয় শুধুই একটা কাজ নয়, একটা দায়িত্ব। পর্দায় সত্যিটা দেখানোর দায়িত্ব। এই পুরস্কার তাঁকে এগিয়ে যাওয়ার রসদ দেবে। আজ ইনস্টাগ্রামে এক ভিডিয়ো-বার্তায় শাহরুখ বলেন, ‘‘জাতীয় পুরস্কার নিছক একটা অর্জন নয়। এটা আমাকে মনে করাচ্ছে, আমি যা করি, তাতে কিছু যায়-আসে। কলরবে ভরা এই পৃথিবীতে আমার কণ্ঠস্বর সত্যিই কেউ শুনছে, এ আশীর্বাদ।... সকলের ভালবাসার কাছে আমি ঋণী। ভারত সরকারকে ধন্যবাদ।’’ শুটিংয়ে সদ্য চোট পেয়েছেন শাহরুখ। জখম ডান হাত গলায় ঝোলানো অবস্থাতেই অন্য হাতটা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মেলে দিয়ে ভক্তদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘‘এ পুরস্কার আপনাদেরই। জলদিই ফিরছি, পপকর্ন তৈরি রাখুন।’’
শাহরুখের সঙ্গেই যৌথ ভাবে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পাচ্ছেন বিক্রান্ত মাসিহ্। তাঁরও এটি প্রথম জাতীয় পুরস্কার। ‘মির্জ়াপুর’ ওয়েব সিরিজ়ের ‘বাবলু’ চরিত্রে যথেষ্ট খ্যাতি পেয়েছিলেন বিক্রান্ত। কিন্তু ‘টুয়েলফ্থ ফেল’ ছবিতে বিক্রান্ত অভিনীত মনোজকুমার শর্মা বাস্তবের অনেককেই শিখিয়ে দিয়েছিল একটি স্লোগান— ‘রিস্টার্ট’। ব্যর্থতার ধাক্কায় থেমে যাওয়ার কোনও মানে নেই— ‘‘হার মানব না। লক্ষ্যে না পৌঁছে থামব না। আইপিএস হতে না পারলে গ্রামের শিক্ষক হয়ে বাচ্চাদের শেখাব, টোকাটুকি করা ঠিক নয়।’’ ‘জওয়ান’-এ শাহরুখের দুই চরিত্র যদি কাল্পনিক হয়, সত্যিকারের আইপিএস মনোজকুমারের বায়োপিকের নাম-ভূমিকার বিক্রান্ত ততটাই রক্তমাংসের। দর্শক গ্রহণ করেছেন দু’টি ছবিকেই। বিধুবিনোধ চোপড়া পরিচালিত ‘টুয়েলফ্থ ফেল’ সেরা ছবির পুরস্কারটিও পাচ্ছে। বিক্রান্ত বলেছেন, ‘‘শাহরুখ খানের মতো নামের সঙ্গে প্রথম জাতীয় পুরস্কার ভাগ করে নিতে পেরে আমি সম্মানিত।’’ দেশের প্রান্তিক মানুষদের তাঁর পুরস্কার উৎসর্গ করেছেন বিক্রান্ত।
‘ব্ল্যাক’ হোক বা ‘হিচকি’, রানি মুখোপাধ্যায় বাস্তব চরিত্রের ছায়া হয়ে উঠেছেন আগেও। ‘মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে’ ছবিতেও বাস্তবের এক বাঙালি মায়ের লড়াইয়ের ছবি এঁকে সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেলেন রানি। ২০১১ সালে নরওয়ে-প্রবাসী দম্পতি সাগরিকা ও অনুরূপ ভট্টাচার্যের দুই সন্তানকে মা-বাবার কাছ থেকে নিয়ে চলে যায় সে দেশের শিশুকল্যাণ বিভাগ। অভিযোগ, সন্তানদের দেখভালে বাবা-মা ব্যর্থ। দীর্ঘ আইনি যুদ্ধের পরে সন্তানদের ফিরে পান তাঁরা। রানি-অভিনীত দেবিকা চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রটিতে যেমন সাগরিকার ছায়া, তেমনই অনুরূপ অবলম্বনে নির্মিত অনিরুদ্ধের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। আজ এক বিবৃতিতে রানি বলেছেন, ‘তিরিশ বছরের অভিনয় জীবনে এটিই আমার প্রথম জাতীয় পুরস্কার। তা উৎসর্গ করছি সারা দুনিয়ার অসামান্য মায়েদের।’
সেরা পরিচালকের পুরস্কারটি দিতে গিয়ে যদিও বিতর্ক তৈরি করেছে জাতীয় পুরস্কারের জুরি বোর্ড। সুদীপ্ত সেন পরিচালিত ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ ছবিটি সেরা পরিচালনার পাশাপাশি সেরা চিত্রগ্রহণের পুরস্কারও পেয়েছে। কিন্তু এই ছবিটিতে যা দাবি করা হয়েছে, অর্থাৎ কেরলের মহিলাদের জোর করে ধর্মান্তরণের পরে ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীতে শামিল করানো হচ্ছে— তার বাস্তবতা নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন উঠেছে। তার ফলে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ছবির শুরুতেই তার কাহিনিটি ‘কাল্পনিক’ বলে লিখে দিতে বাধ্য হয়েছেন নির্মাতারা। যদিও সেই ছবির পরিচালক, শিলিগুড়ির সুদীপ্তকে পুরস্কৃত করার কথা ঘোষণা করতে গিয়ে জুরিদের প্রধান আশুতোষ গোয়ারিকর বলেছেন, ‘‘এমন কঠিন বিষয় যতটা স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরা হয়েছে, আমরা মনে করেছি তাকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।’’ কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন এ নিয়ে এক্স হ্যান্ডলে ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘কেরলের ভাবমূর্তি নষ্ট করা এবং সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করার উদ্দেশ্য নিয়ে চূড়ান্ত ভুল তথ্য ছড়ানো একটি ছবিকে সম্মানিত করলেন জাতীয় পুরস্কারের জুরিরা। এমন একটি ভাষ্যকে তাঁরা মান্যতা দিলেন, যার ভিত্তিই হল সঙ্ঘ পরিবারের বিভাজনের আদর্শ।’
সেরা বাংলা ছবির জাতীয় পুরস্কার পাচ্ছে আবির চট্টোপাধ্যায়, তনুশ্রী চক্রবর্তী অভিনীত এবং অর্জুন দত্ত পরিচালিত ‘ডিপ ফ্রিজ’। সেরা নন-ফিকশন (পুরোদস্তুর কাহিনিচিত্র নয়) ছবি নির্বাচিত হয়েছে পরিচালক সৌম্যজিৎ ঘোষ দস্তিদারের ‘ফ্লাওয়ারিং ম্যান’। এ দিন ঘোষণা করা অনেকগুলি পুরস্কারেই অবশ্য দক্ষিণের জয়জয়কার। তার মধ্যে রয়েছে সেরা সম্পাদনা, সেরা মৌলিক চিত্রনাট্য থেকে শুরু করে সেরা সহ-অভিনেতা, সহ-অভিনেত্রীর পুরস্কার। সেরা গায়ক পিভিএনএস রোহিত। ‘জওয়ান’-এর একটি গানের জন্য সেরা গায়িকার পুরস্কার পাচ্ছেন শিল্পা রাও। সেরা হিন্দি কাহিনিচিত্র ‘কাঁঠাল’। একাধিক পুরস্কার পেয়েছে ‘স্যাম বাহাদুর’ ছবিটিও।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)