তখন দুটো শিফটে চুটিয়ে কাজ করছি মুম্বইয়ে। সকাল ৭টা থেকে ২টো, আবার ২টো থেকে ১০টা। চলছে ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে ‘মেরা হামদম মেরা দোস্ত’ ছবির শ্যুটিং। এ রকমই এক সন্ধ্যায় ‘ছলকা ইয়ে জাম’ গানের শ্যুট চলছে। এ দিকে পরের দিন সকালেই আমার ইডেন টেস্ট দেখতে কলকাতা যাওয়ার টিকিট কাটা, যেখানে টাইগার খেলছে। এটা সেই ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ় টেস্ট, যেখানে শেষ পর্যন্ত টিকিট বণ্টন নিয়ে বিরাট গন্ডগোল হয়েছিল মাঠে, অর্থাৎ ১৯৬৮-র জানুয়ারির সেই টেস্ট ম্যাচ।
যাওয়া তো ঠিক, কিন্তু রাতে নির্ধারিত শিফট-এর মধ্যে কাজ শেষ হল না। আমি প্রমাদ গুনলাম। তার মানে আগামিকালের আগে এই কাজ শেষ করার কোনও উপায় নেই। অথচ আমার কলকাতা যাওয়ার সব ঠিক।
কী করা যায়? উপায়ান্তর না দেখে ধরমকে অনুরোধ করলাম, যদি আজ রাতে বাড়তি কাজ করে শেষ করে দেওয়া যায় শ্যুটটা, তা হলে আমি কাল কলকাতা যেতে পারি। শুধু যে এক কথায় রাজি হল, তা-ই নয়, সামান্য বিশ্রাম নিয়ে গোটা রাত পরিশ্রম করে শেষ করা হল শ্যুট। আমরা যখন প্যাক আপ করছি, তখন ঘড়িতে সকাল ৭টা! আমি সরাসরি দৌড়লাম এয়ারপোর্টে। আমার দীর্ঘ কেরিয়ারে মনে করতে পারি না, এমনটা কেউ করবেন তাঁর কো-অ্যাক্টরের জন্য। ও তো বলতেই পারত, তুমি খেলা দেখতে যাবে বলে আমি সারা রাত কাজ করতে পারব না। মনে রাখতে হবে, সে সময় ধরম খুবই বড় মাপের তারকা। এতটা বড় মন ছিল ধরমের, অন্যদের জন্য সর্বদাই হাত বাড়িয়ে দিত। মনে পড়ছে, এক বার ‘সত্যকাম’-এর শ্যুটিংয়ের সময় ঘাটশিলায় এক দল গুন্ডা ধরনের লোকের পাল্লায় পড়তে হয়েছিল আমাদের। কোনও একটা বিষয় নিয়ে উত্তেজনা শুরু হয়। সে দিনআমাকে এবং আমাদের ইউনিটকে সুরক্ষিত করতে ধরমের ভূমিকা কখনও ভুলব না।
বহু কথা আজ মনে ভিড় করে আসছে। আমার আর ওর একই দিনে জন্মদিন। ৮ ডিসেম্বর। যদিও ও আমার থেকে দশ বছরের বড়, কিন্তু আমাদের একটা সংযোগ ছিল এই দিনটির মাধ্যমে। শুধুমাত্র বড় তারকা এবং অভিনেতাই তো নয়, ধরম ছিল অসম্ভব বড় মনের একটা মানুষ। বৃহত্তর পরিবারকে আগলে রাখত পিতার মতো। শুধু নিজের সন্তানদের নয়, ভাইবোনেদের ছেলেমেয়েরাও ওকে বাবার মতোই দেখত। পাপাজি বলে ডাকত সবাই।
আটটি ছবি আমি করেছি ধরমের সঙ্গে। তার মধ্যে সবার আগে রাখব ‘সত্যকাম’, ‘অনুপমা’ এবং অবশ্যই ‘চুপকে চুপকে’— হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের এই তিনটি ছবিকে। আবার এই তিনের মধ্যে ‘চুপকে চুপকে’ ছবিতে ওর কমিক টাইমিং-এর তো কোনও তুলনাই হয় না। আমার মতে ধরমের জাতীয় পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল ‘চুপকে চুপকে’ ছবির জন্য। কিন্তু কমেডি অভিনয়ের জন্য বোধহয় দেওয়া হত না ওই পুরস্কার। আজ ওর চলে যাওয়ার দিনে তো আমার মনে হয়, যাঁরা ওর কাজ ভালবাসেন, সবার এই ছবিটা আর এক বার দেখা উচিত। যে কোনও ধরনের রোলে ও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারত, তা অ্যাকশন ছবি হোক, কমেডি অথবা আবেগদীপ্ত নরম স্বভাবের চরিত্র। হৃষীদার সঙ্গে ধরমের রসায়ন ছিল অনবদ্য। উনিও খুব ভালবাসতেন ধরমকে। উনি বকাঝকা করতেন, পিছনে লাগতেন আর ধরম অসম্ভব শ্রদ্ধা করত হৃষিদাকে। একবার দেরি হয়ে গিয়েছিল সেটে আসতে, হৃষিদা শ্যুটিং শুরু করে দিয়েছিলেন। ব্যস, আর কখনও ওকে দেরি করতে দেখিনি ফ্লোরে আসতে।
করণ জোহরের ‘রকি আউর রানি কি প্রেম কহানি’ ছবিতে আমার কাজ করার কথাছিল। কিন্তু সে সময় একে কোভিড চলছে, সঙ্গে আমার নিজের অসুস্থতা। কো-মর্বিডিটির ঝুঁকি ছিল। আমার চিকিৎসকও নিষেধ করলেন। ফলে আমার আর কাজ করা হয়নি। আজ আফসোস হচ্ছে। ধরমের সঙ্গে আবার একটা কাজ করতে পারলে, আরও কিছু স্মৃতি সঞ্চিত হয়ে থাকত আমার কাছে।
এ বারের জন্মদিনটা সত্যিই আমার খুবই খারাপ কাটবে, ধরম।
অনুলিখন: অগ্নি রায়
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)