একসময় দুর্গাপুজোয় সারা কলকাতা চষে বেড়াতাম। ওই সময়ে যেন আমাদের পায়ের তলায় সর্ষে থাকত! কিন্তু এখন গোটা পুজো জুড়েই অনুষ্ঠান। যদিও সেটাই বাঞ্ছনীয়। তবে দুর্গাপুজো চিরকালই আমার কাছে খুব বিশেষ। এখন শহর বা দেশের বাইরেই কাটে পুজো। কিন্তু পুজোর প্রতি এই ভাললাগা আমার চিরকালীন। কারণটা বলি।
পুজোয় প্রেম নিয়ে নানা রকমের আলোচনা হয়। শুনেছি, এখন নাকি নতুন প্রজন্ম পুজোর সময়ে প্রেমে থাকার জন্যেও সঙ্গী খুঁজে নেয়! কিন্তু আমারটা আক্ষরিক অর্থেই পুজোর প্রেম ছিল। প্রেমটা শুরু হয়েছিল আগেই। কিন্তু প্রেমে সিলমোহর পড়েছিল একটা পুজোর সময়েই। পুজোর আগে আমরা বেশ সংশয়ে ছিলাম। সত্যিই এটা প্রেম কি না, তা নিয়ে কিছু প্রশ্ন থেকে গিয়েছিল। কিন্তু পুজোর সময়েই উপলব্ধি করি— এটা প্রেম। সাত্যকি আমার চেয়ে ছ’বছরের বড়। ও তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে দিল্লিতে চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। আমি তখন সেন্ট জ়েভিয়ার্সে প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছি।
মনে আছে, দিল্লি থেকে ও ষষ্ঠীর দিন এসেছিল দিল্লি থেকে। বিকেলে বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে আমরা দেখা করি। ও আমাকে বেশ কিছু উপহার দিয়েছিল। ও তখন ভালই রোজগার করে। আমার মতো অবস্থা নয়! একটা নামী ব্র্যান্ডের গোলাপি রঙের শার্ট দিয়েছিল সাত্যকি। বেলজিয়ান ডার্ক চকোলেটের একটা বাক্স দিয়েছিল। সেই সঙ্গে দিয়েছিল একটা হিরে। পরে বিয়ের সময় সেই হিরেটা দিয়েই আমি আংটি বানিয়ে নিয়েছিলাম। এখনও সেই হিরেটাই পরে রয়েছি।
আজও সেই দিনটা আমার চোখের সামনে ভাসে। খুব গরম ছিল সেদিন। তার পরেই আমরা দু’জনেই নিজেদের বাড়িতে সম্পর্কের কথা জানাই। আমাদের ‘লং ডিসট্যান্স’ সম্পর্ক ছিল। আমাদের বছরে মাত্র দু’বার দেখা হত—ও এক বার আসত গ্রীষ্মে, আর এক বার পুজোয়। সে এক দারুণ সময় ছিল। তখন হয়তো তেমন টাকাপয়সা ছিল না। কিন্তু আমাদের মধ্যে এক অদ্ভুত উদ্যম ছিল। হেঁটে হেঁটে ঘুরেই সময় কেটে যেত আমাদের। ক্লান্ত হতাম না। এখনও অবশ্য আমাদের ‘লং ডিসট্যান্স’-এই পুজো কাটে। সাত্যকির কর্মস্থল এমনিতেই কলকাতার বাইরে। পুজোয় আমিও থাকি ভিন্ রাজ্যে অথবা ভিন্ দেশে।
ছোটবেলায় ১৪ জন ভাইবোনের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম মণ্ডপে মণ্ডপে। ওদের ঠাকুর দেখার হুজুগ ছিল অন্য মাত্রায়। পাড়ায় বসে আড্ডা দেওয়ার কোনও অভিজ্ঞতাই নেই আমাদের। আমরা এমনিই ঘুরে বেড়াতাম। এখন বদলে গিয়েছে পুজোর উদ্যাপন। এখন পুজোর সময় অনুষ্ঠানে গান গাইতে না পারলেই বরং মনখারাপ হবে। যেমন অতিমারীর সময় সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খুব খারাপ লাগত। এ বার আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও কানাডায় অনুষ্ঠান রয়েছে। পুজোয় গান গাওয়াটাই অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। সবার যখন ছুটি, তখন আমরা কাজ করি।
বিদেশেও পর পর অনুষ্ঠান থাকায় আর আমরা আলাদা করে সেখানেও ঠাকুর দেখতে পারি না। তাই শেষ কবে পুজোয় অঞ্জলি দিয়েছি বা বিজয়ার পরে ঠাকুর প্রণাম করতে গিয়েছি, মনেই নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা, পুজোর চারটে দিন গান গাইতে পারলে তার চেয়ে আনন্দের আর কী আছে! অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পরে মানুষের থেকে যে প্রতিক্রিয়া পাই, সেটা পুজোয় আনন্দ করার চেয়ে কম কিছু নয়।
বিনোদনজগতে আসার আগে পুজো সত্যিই অন্য রকম ছিল! যেমন, এখন শুনি আমি যেমন পোশাক পরি, সেটাও একটা সাজ। এটাও যে সাজ হতে পারে, ধারণাই ছিল না। ছোট থেকেই আমি একটু ‘টম বয়’ সুলভ। এখন যেটুকুও সাজি, সেটুকুও ছিল না আগে। বাবা-দাদারা যেমন জামা পরেন, ওই রকম ঢিলেঢালা পোশাকই পরতাম। এখনও তেমনই ভাল লাগে পরতে। আর পুজোয় কলকাতায় প্রবল গরম থাকে। তাই সুতির বাইরে অন্য কোনও পোশাক ভাবতেই পারি না। অনেকেই খুব সুন্দর পরিপাটি হয়ে সেজে বেরোন। খুব ভাল লাগে সেটা। তবে আমি পারি না। আমি একটু আরামপ্রেমী মানুষ। সাজের জন্য আমি কষ্ট করতে পারি না। নির্ঝঞ্ঝাটে ঘুরতে আর খেতে ভাল লাগে। আর পুজোর সময়ে রাস্তার খাবারে ডুবে থাকি আমি। রোল-চাউমিন-এর মতো খাবার নয়। ফুচকা, ঘুগনি, গিলে-মেটের চচ্চড়ি, পাপড়ি চাট এগুলো খেতে ভাল লাগে।
সকাল আটটার সময়েও পাপড়ি চাট খেয়েছি। আইসক্রিম, বুড়ির চুল এই সবও খুব প্রিয়। গলার জন্য আলাদা করে যত্ন নিই না। সাধারণত গলার অবস্থা ভাল রাখতে টক খাবার এড়িয়ে চলতে বলা হয়। কিন্তু আমার প্রিয় স্বাদই হল টক। রাত বারোটার সময়ও আমি আচার খাই। গলা ভাল রাখতে নিয়মিত রেওয়াজটুকুই করি। তবে বয়স বাড়ছে, তাই সামান্য রাশ তো টানতেই হয়!
পুজোয় সবারই কিছু চাওয়া থাকে। আমি খুবই ক্ষুদ্র মানুষ। আমি চাইলেও চারপাশে চলতে থাকা হাজারো যুদ্ধ থামবে না। তাই এ বার শুধু নিজের জন্যই মা দুর্গার থেকে তিনটে জিনিস চাইব। আমার যেন মাথা ঠান্ডা থাকে। আমার যেন ধৈর্য বৃদ্ধি পায়। রেগে গেলেও আমার চোখেমুখে যেন তা ফুটে না ওঠে। ব্যস!