Advertisement
E-Paper

সন্ধ্যাবেলা

সানি লিওনের সঙ্গে তাঁর চুম্বনদৃশ্য নিয়ে সারা দেশ উত্তাল। সেই সন্ধ্যা মৃদুল শ্যুটিং করছেন বালিতে। সেখানে তাঁর সহ-অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। দেখে এসে লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।পরিচালক ডা.অমিতরঞ্জন বিশ্বাসের প্রথম ছবিতে অভিনয় করার অফারটা পাওয়ার পরে সামান্য একটু দ্বিধা যে হয়নি, তা নয়। বাংলা ভাষা জানতেন না। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম শুনেছিলেন। তবে তাঁর অভিনীত কোনও সিনেমা দেখেননি। কিংবদন্তি এই অভিনেতার সঙ্গে কাজ করাটা... সব ঠিক থাকবে তো?

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৪ ২১:৫৩
শ্যুটিংয়ের ফাঁকে সন্ধ্যা মৃদুল।

শ্যুটিংয়ের ফাঁকে সন্ধ্যা মৃদুল।

কাকভোরের বালি ব্রিজ।

ফুটপাথে বসে আছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং সন্ধ্যা মৃদুল।

সৌমিত্রর একমুখ দাড়ি। সন্ধ্যার চুল উস্কোখুস্কো। তাই দেখে সৌমিত্রর এক অনুরাগী বাস থেকে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার? ফুটপাথে কেন?” সঙ্গে সঙ্গে সৌমিত্রর উত্তর, “ছোটবেলায় বাবা-মা বলেছিলেন সিনেমা না করতে। তখন শুনিনি। আজ তাই পথে বসেছি!”

বাসযাত্রী সেই কথাটা শুনে কী ভেবেছিলেন তা জানা নেই। তবে সন্ধ্যা যথেষ্টই মজা পেয়েছিলেন। এমন সব ইয়ার্কির মধ্যে দিয়ে কখন যে তাঁর সহ-অভিনেতার সঙ্গে দূরত্বটা কেটে গিয়েছিল, বুঝতেই পারেননি।

সৌমিত্রর সঙ্গে সন্ধ্যা

পরিচালক ডা.অমিতরঞ্জন বিশ্বাসের প্রথম ছবিতে অভিনয় করার অফারটা পাওয়ার পরে সামান্য একটু দ্বিধা যে হয়নি, তা নয়। বাংলা ভাষা জানতেন না। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম শুনেছিলেন। তবে তাঁর অভিনীত কোনও সিনেমা দেখেননি। কিংবদন্তি এই অভিনেতার সঙ্গে কাজ করাটা... সব ঠিক থাকবে তো?

তবে প্রথম শটেই বুঝেছিলেন যে, ভয় পাওয়ার কোনও কারণই ছিল না। একদিন তো সকালবেলায় সেটে এসে সৌমিত্র তাঁকে বলেই বসেন, “ইউ মেড মাই ডে!” সেই ঘটনা মনে করে সন্ধ্যা হেসে বলেন, “প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে হেসে ‘রাগিণী এমএমএস ২’ থেকে সানি লিওন আর আমার চুম্বনদৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দিলেন।”

কথা বলতে বলতেই সন্ধ্যার মোবাইল বেজে ওঠে। একটা সাক্ষাৎকার দিয়ে এসে বললেন, “সানির সঙ্গে চুম্বন দৃশ্য নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। আমরা একটা সেক্সুয়ালি ডিপ্রাইভড দেশে বাস করি। সোশ্যাল মিডিয়া তো এই দৃশ্য নিয়ে উত্তাল।” একজন নাকি জিজ্ঞেসও করেছিলেন, সন্ধ্যা ব্যক্তিগত জীবনেও কি ওই রকম চুম্বনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন? “শুনে হাসি পেয়েছিল। আরে বাবা এটা তো অভিনয়। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনে ‘লেসবিয়ান লাভমেকিং’য়ে আকৃষ্ট হওয়ার, বা না হওয়ার কী সম্পর্ক?” প্রশ্ন সন্ধ্যার। তিন মাস আগে দিল্লির বাড়িতে ফোন করে বলেছিলেন এই ছবিটার কথা। এটাও বলেছিলেন, ছবিটার প্রচারের সময় নানা কথা উঠতে পারে। তাতে ওঁরা যেন বিচলিত না হন। “সানি ভীষণ পেশাদার অভিনেত্রী। আমার সব থেকে ভাল লাগে যে ও খুব ফোর্থরাইট। মিষ্টি মেয়ে। আমার বেশ ভাল লেগেছে। ছবিতে আমার চরিত্রটা সম্পর্কে সব জেনেই আমি সেটা করতে রাজি হয়েছিলাম। এটাও জানতাম এ দেশে কোনও অভিনেত্রী যৌনতা নিয়ে কাজ করলে তাকে নিয়ে আলোচনা হবেই। সবাই জানতে উৎসুক, ‘ওই দৃশ্যটা’ শ্যুট করতে কেমন লেগেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে ক’জন জানতে চায়, ‘ব্রিজ’ ছবিতে কোনও ডায়ালগ ছাড়া অভিনয় করার অভিজ্ঞতা কেমন?”

ততক্ষণে শট রেডি। প্রায় দু’শো বছরের পুরনো এক বাড়িতে শ্যুটিং। প্রথমে গল্পটা পরিচালক লিখেছিলেন লন্ডনের পটভূমিতে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে সৌমিত্র লন্ডনে যেতে না পারার পর ঠিক হয় নতুন একটা গল্প লেখা হবে। চিত্রনাট্যে সৌমিত্র এবং সন্ধ্যার চরিত্র অবসাদে ভোগে। এক ভোরে দু’জনের দেখা। ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে। “দু’জনের কারও আত্মহত্যা করা হয় না। তারপর শুরু হয় ‘হিলিং প্রসেস’। সন্ধ্যাকে ‘হিল’ করতে গিয়ে আমিও ‘হিলড্’ হই।

সন্ধ্যা ছবিতে ভাল কাজ করছে,” বলেন সৌমিত্র।

ছবিটা করতে গিয়ে নানা ধরনের অভিজ্ঞতা। ব্রিজ বরাবর দৌড়েছেন। পড়ে গিয়ে হাত ছড়ে গিয়েছে। তবু এক মুহূর্তের জন্য অভিনয় করতে ক্লান্তি আসেনি। কখনও মনে হয়েছে কি, আশিতে এসে তাঁরও হিলিংয়ের প্রয়োজন? “বেঁচে থাকলে তার ফ্যাকড়াও থাকে অনেক। আঘাত, সংঘর্ষ যেমন থাকে, সেই সঙ্গে থাকে হিলিংও। আজ এই বয়সে এসে চিন্তার ব্যাপ্তি ঘটেছে। গভীরতা বেড়েছে। সাহচর্যের ক্ষেত্রে খানিকটা নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছি। একে একে বন্ধুরা চলে গিয়েছে...” বলেন সৌমিত্র। আর তখন? “আই হ্যাভ টু লুক ইনওয়ার্ডস,” জানান তিনি। আর সঙ্গে থাকে লেখালিখি, ছবি আঁকা। হাত দিয়েছেন একটা নতুন কাজে। রবীন্দ্রনাথের চারটে ছোটগল্প, ‘বোষ্টমী’, ‘পয়লা নম্বর’, ‘মাস্টারমশাই’, ‘হালদার গোষ্ঠী’-কে নাট্যরূপ দিয়েছেন তিনি। “কথাসাহিত্যকে নাট্যসাহিত্যে রূপ দেওয়াটা খুব শক্ত। সিনেমাতে সায়লেন্সের বড় জায়গা থাকে। কিন্তু নাটক মানেই কথা। ডায়ালগ। সেই কাজটা করা বেশ কঠিন। নাটকগুলো এর পর শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় ইংরেজিতে অনুবাদ করবেন সর্বভারতীয় পাঠকদের জন্য,” বললেন তিনি।

ইতিমধ্যে শট রেডি। সাইলেন্স না বলে পরিচালক চেয়ে নেন এক খঞ্জনি। পরিচালক পেশায় মনস্তত্ত্ববিদ। ৩০ বছর কত্থক শিখেছেন। লন্ডনে থাকেন। লিখেছেন সৌমিত্র পরিচালিত এবং অভিনীত নাটক ‘হোমাপাখি’ আর ‘ছাড়িগঙ্গা’। “এই ছবিটির মধ্যে দিয়ে আমি নিরাময়ের প্রক্রিয়াটা বোঝানোর চেষ্টা করেছি। একজন রুগির চিকিৎসার ৭৫ শতাংশই হয় বিশ্বাস, ভরসা, ভালবাসার ভিত্তিভূমি তৈরি হলে। ধৈর্য লাগে। হাল ছাড়লে চলে না। এই খঞ্জনিটা আমার চিকিৎসার একটা প্রধান অস্ত্র। এটা বাজিয়ে আমি রুগিদের মনে করিয়ে দিই এখন তাদের সম্পূর্ণ ভাবে সেই মুহূর্তে মনোনিবেশ করতে হবে। যাকে বলে ‘বিইং ইন দ্য নাউ’। শ্যুটিংয়েও আমি একই পদ্ধতি ব্যবহার করি,” বলেই তিনি বাফতা জুরি মেম্বার এবং ছবির সিনেমাটোগ্রাফার জোরান ভেইজকোভিক-র সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে যান।

পরের দৃশ্য সৌমিত্র, কাঞ্চনা মৈত্র, দেবরঞ্জন নাগ আর সন্ধ্যাকে নিয়ে। হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে এক গ্লাস দুধ ফেলে দিলেন সন্ধ্যা। চিৎকার করতে করতে দাঁড়ালেন দেওয়ালে ঠেস দিয়ে। “এই প্রথম গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বের করলাম! একটাও বাংলা সংলাপ নেই সিনেমায়। তবে আমি দু-চারটে বাংলা শব্দ শিখেছি। ভাল আর দারুণের মধ্যে তফাতটা বুঝতে পারি,” বললেন সন্ধ্যা।

২৮ মার্চ সন্ধ্যার জন্মদিন। আর সে দিন কলকাতা ছেড়ে তিনি যাবেন লুধিয়ানায়। সুভাষ কপূরের ‘গুড্ডু রঙ্গিলা’তে শু্যটিং করতে, যেখানে তিনি এক তরুণ রাজনীতিকের ভূমিকায়। তার পর করছেন আদিল হুসেনের সঙ্গে অন্য একটা ছবি। পরপর এতগুলো সিনেমা করলেও মাঝে কিছু বছর কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন? সেই কবে করেছিলেন মধুর ভান্ডারকরের ‘পেজ থ্রি’। তার পর? উত্তরে বললেন, “‘পেজ থ্রি’ করার পর মিডিয়াতে আমাকে বলা হত ‘বলিউডের বোল্ড, বিন্দাস বেব।’ ঠোঁটকাটা ছিলাম ঠিকই। তবে টাইপকাস্ট হতে মোটেই চাইনি। স্পষ্টবাদী ছেলেদের এই সমস্যাটা নেই। দে ক্যান গেট অ্যাওয়ে। কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে স্পষ্টবাদিতা মানেই ঔদ্ধত্য। আর বোল্ড (যদিও এই শব্দটাও অতি-ব্যবহারে তার আসল অর্থটা খুইয়েছে) মানে হল সহজলভ্যতা।”

এ সব জেনেও সন্ধ্যা আপস করেননি। “নিজে মুখে বলেওছিলাম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাস্টিং কাউচ আছে। একটা সময় পরপর ছবি থেকে বাদ দেওয়া হয় আমাকে,” বলেন সন্ধ্যা।

‘ব্রিজ’য়ে অভিনয় করতে গিয়ে সেই সব স্মৃতি ফিরে ফিরে আসতে থাকে। “না, আত্মহত্যার কথা কোনও দিন ভাবিনি। তবে আমারও ‘হিলিং’য়ের দরকার ছিল। যোগব্যায়াম করতে শুরু করি। নিজেকে বোঝাই যে অন্যের আচরণের ওপর আমার কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। যেটুকু নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারে, তা একমাত্র নিজের আচরণের ওপরেই।”

তবে আজ তিনি অভিনয়ে ফেরত এসে খুশি। বলছেন, “ভারতীয় সিনেমায় কী দারুণ সব চরিত্র লেখা হচ্ছে মেয়েদের জন্য। ‘কুইন’য়ে কঙ্গনাকে ভাবুন। বা তন্নিষ্ঠার অভিনয় দেখুন ‘গুলাব গ্যাং’য়ে। অনেক ভার্সেটাইল কাজ আসছে আমাদের মতো অভিনেত্রীদের জন্য।”

তবে একটা আক্ষেপ রয়েছে। “কলকাতাতে শ্যুট করেছিলাম অঞ্জন দত্তের ‘বিবিডি’। কাগজে পড়ে জেনেছিলাম যে, ছবিটা নাকি মুক্তি পাবে আগামী শুক্রবার। দুঃখের বিষয়, এ প্রসঙ্গে প্রযোজকের তরফ থেকে আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। তবে বলব, ছবিটা খুব ভালবেসে শ্যুট করেছিলাম। ওটা মুক্তি পেলে ভাল লাগবে,” বলেন অভিনেত্রী।

এ দিকে সন্ধ্যা নামতে বেশি দেরি নেই। খঞ্জনি আবার বেজে ওঠে। প্যাক আপের আগেই সৌমিত্র-সন্ধ্যার আরও একটি দৃশ্য শু্যট করতে হবে। অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরতে হবে নিরাময়ের পথ। তবে জীবনে ‘হিলিং’ তো চলতেই থাকে। সেখানে কোনও ‘কাট’ হয় না।

sunny loans sandhya mridul
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy