Advertisement
E-Paper

অমিতকুমার বড়দা, আমরা তিন ভাইবোন! এ ভাবেই আমাদের বড় করেছিলেন মা রুমা গুহঠাকুরতা

“কিশোরকুমারকে আমরা ডাকতাম ‘বাপি’। অশোককুমার আমাদের বাড়িতে এসেছেন। মা সেই সময়ে বিচ্ছেদের পরেও ‘বন্ধু’ হওয়ার দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন।”

শ্রমণা চক্রবর্তী (গুহঠাকুরতা)

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৫ ০৯:৫৮
শ্রমণা চক্রবর্তী তাঁর মা রুমা গুহঠাকুরতার গল্প শোনালেন।

শ্রমণা চক্রবর্তী তাঁর মা রুমা গুহঠাকুরতার গল্প শোনালেন। ছবি: ফেসবুক।

বড় টিপ। চওড়া পাড় শাড়ি। কখনও খোলা চুল। কখনও ঘাড়ের কাছে হাতখোঁপা বা বিনুনি। এই সাজে রান্নাঘরে আর পাঁচজন মধ্যবিত্ত বাড়ির গিন্নির মতোই ব্যস্ত আমার মা। বড়ি, বেগুন দিয়ে পালং শাকের ঘণ্ট রাঁধছেন! রুমা গুহঠাকুরতা।

খ্যাতনামী অভিনেত্রী। সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের সদস্য। ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের প্রতিষ্ঠাতা-কর্ণধার। আমার মায়ের অনেক পরিচয়। কিন্তু আমার কাছে তাঁর সমস্ত পরিচয় ছাপিয়ে জ্বলজ্বল করে মাতৃসত্তা। মা যে আমাদের খুব সময় দিতেন, তা নয়। অথচ যখন সময় দিতেন, ভরিয়ে দিতেন। যৌথ পরিবারের রান্নাবান্নার দিক ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। জেঠিমা-কাকিমাদের সঙ্গে মিলে মা সে দিকটা দেখতেন। একটু বড় হওয়ার পরে স্কুলে যাওয়ার সময় দুই বিনুনি হয়তো বেঁধে দিতে পারতেন না রোজ। কিন্তু শিক্ষিকারা মিটিংয়ে ডাকলে সময় ধরে উপস্থিত। মায়ের অভাব অনেকটাই পূরণ করে দিয়েছিলেন দিদা। স্কুল থেকে ফিরে, স্নান খাওয়া সেরে গল্প শুনতাম দিদার কাছে। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম। দিদা চলে যাওয়ার পর মা সেই ভূমিকা নিয়েছিলেন। ছোটদের ইংরেজি গল্পের বই থেকে গল্প পড়ে শোনাতেন।

মা-বাবার সঙ্গে তরুণী শ্রমণা চক্রবর্তী।

মা-বাবার সঙ্গে তরুণী শ্রমণা চক্রবর্তী। ছবি: ফেসবুক।

আর শিখিয়েছিলেন ‘ভাল স্পর্শ’, ‘মন্দ স্পর্শ’। একটি মেয়ে ছোট থেকে কী ভাবে ধাপে ধাপে বড় হয়ে ওঠে। তখন তার কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়, বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বন্ধুর মতো। মাকে দেখতে দেখতে অবাক হয়ে যেতাম। এত কিছু মাত্র দুটো হাতে সামলান কী করে! কী যে গুছিয়ে সংসার করতেন। আমি কোনও দিন মায়ের ‘গোছানো মেয়ে’ হতে পারলাম না। ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের শিল্পীরা যেন ওঁর পরিবর্ধিত পরিবার। আমার শহরের বাইরে যাওয়া মায়ের এই দলের সঙ্গেই। মা আমাদের নিয়ে যেতেন নানা জায়গায়, নানা অনুষ্ঠানে। সেখানে গিয়ে মা বাকিদের সঙ্গে এক জায়গায় থাকেন। সবাই যা খেতেন মা-ও তা-ই। কেবল নিরামিষ রান্না বেশি ভালবাসতেন মা।

একটা মজার গল্প বলি? তখন যৌথ পরিবারের অন্য রকম শাসন। সেই শাসনের ঘেরাটোপে বড় হওয়ায় ছোটবেলায় সিনেমাহলে সিনেমা দেখতে যেতে পারতাম না। ন’মাসে-ছ’মাসে ছোটদের ছবি হলে দেখতে যাওয়ার অনুমতি মিলত। একটু বড় হওয়ার পর মায়ের একটি ছবি দেখতে গিয়েছিলাম। সেই ছবিতে মা খলনায়িকা! মাকে ওই ধরনের চরিত্রে দেখে আমার কী কান্না! মনখারাপের চোটে ক’দিন খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলাম। ছোট থেকে মায়ের অবস্থান সম্পর্কে সজাগ ছিলাম না বলেই হয়তো ‘আমার মা সেলিব্রিটি’— এই ভাবনা মনের মধ্যে তৈরি হতে পারেনি। মাতৃপরিচয় বা পিতৃপরিচয় আমাদের উপরে বোঝা হয়ে ওঠেনি।

তার মানে কি মায়ের নাম প্রয়োজনে ব্যবহার করিনি? অবশ্যই করেছি। সেটা ইডেন গার্ডেনে ক্রিকেট খেলা দেখার সময়ে। মা বলে দিতেন, কার থেকে টিকিট জোগাড় করব। ব্যস, ওটুকুই।

শ্রমণাকে নিয়ে ‘সংসারী’ রুমা গুহঠাকুরতা।

শ্রমণাকে নিয়ে ‘সংসারী’ রুমা গুহঠাকুরতা। ছবি: ফেসবুক।

আসলে মা যখন যেমন, তখন তেমন। সুকুমার রায়ের বাড়ির মেয়ে। সেটাও যেমন বহন করেছেন, কিশোরকুমারের ‘প্রাক্তন’ স্ত্রী— এটাও অস্বীকার করেননি। মায়ের দৌলতেই অমিতকুমার আমাদের বড়দা। আমরা তিন ভাইবোন— শিখিয়ে গিয়েছেন মা। আমরা কিশোরকুমারকে ‘বাপি’ ডাকতাম। আমাদের বাবাকে ‘বাবা’। ‘বাপি’ কোনও দিন আমাদের বাড়িতে আসেননি। আমরা কিন্তু মুম্বইয়ে ওঁর বাড়িতে গিয়েছি। খুব আদর করতেন তখন। লীনা চন্দ্রভারকরের সঙ্গেও সখ্য তৈরি হয়েছিল তখনই। একই ভাবে অমিতদা ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের কাছেই বড় হয়েছেন। তার পর মুম্বই যান। ‘বাপি’ না এলেও ‘দাদামণি’ অশোককুমার, কাকু অনুপকুমার কিন্তু আমাদের বাড়িতে আসতেন। গঙ্গোপাধ্যায় পরিবারের সঙ্গে গুহঠাকুরতা পরিবারের সেতুবন্ধ তৈরি হয়েছিল এ ভাবেই।

আমার মা তাঁর আমলে বিচ্ছেদের পর ‘বন্ধুত্ব’ ধরে রাখার দৃষ্টান্ত গড়েছিলেন।

বাবার মৃত্যুর পর কলকাতায় খুব একা হয়ে গিয়েছিলেন মা। দুই পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল বলেই শেষজীবনে মাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন বড়দা। আমিও বেঙ্গালুরু থেকে মাকে দেখতে যেতাম। কিশোরকুমারের সঙ্গে ফেলে আসা জীবনস্মৃতি আঁকড়েই মুম্বইয়ে তাঁর বাড়িতে শান্তিতে, সম্মানের সঙ্গে দিন কাটিয়েছেন রুমা গুহঠাকুরতা।

Sromona Chakraborty Kishore Kumar Amit Kumar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy