Advertisement
E-Paper

একটা নাগরিক বৃত্তে আটকে গিয়েছি, এতে করে সাংস্কৃতিক পরিসরটা বাড়ছে না

‘‘ইট হ্যাজ় টু বি গেরিলা ওয়ারফেয়ার, নবারুণদার (ভট্টাচার্য) ভাষায় বলতে গেলে এটাই বলতে হয়’’, বললেন নাট্যব্যক্তিত্ব ও চিত্রপরিচালক।

চন্দন মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৫ ০৯:১৫
অকপট সুমন মুখোপাধ্যায়।

অকপট সুমন মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

প্রশ্ন: এই সময়টা কি খুব সুখের? আদৌ কি স্বস্তি দিচ্ছে?

সুমন: স্বস্তি তো কোনও ভাবেই দিচ্ছে না। সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যা চলছে, তাতে যে কোনও সময় ভয়ানক কিছু ঘটে যেতে পারে। বারুদের স্তূপের উপর বসে থাকার মতো অবস্থা। ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ নিয়ে যা চলছে এবং তার সঙ্গে দুর্নীতি— সব মিলিয়ে দেশের রাজনীতির অবস্থাটা বেশ ভয়াবহ। রাজনীতির সঙ্গেই তো গভীর ভাবে জড়িয়ে থাকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক নানা জিনিস। সঙ্গে রয়েছে আজকের সোশ্যাল মিডিয়া। সেখানে যা হচ্ছে তা তো ভীষণ ভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। প্রচুর লোকজন এগুলো দেখেন। সংস্কৃতিগত ভাবে বলতে পারি, ভীষণ ভাবে আটকে গিয়েছি। আমরা চর্চা করছি । কিন্তু, তার যে অভিঘাত পড়া উচিত সামাজিক ভাবে, তা হচ্ছে না।

প্রশ্ন: এখানে নাটক বা থিয়েটারের ভূমিকা কতখানি জরুরি?

সুমন: জরুরি। তবে, শহরের মধ্যে পাঁচটা হলে অভিনয় করে বা শো দেখিয়ে কোনওটাতেই কিছু হয় না। চারদিকে এগুলোর ছড়িয়ে পড়া প্রয়োজন। আগে এই সুযোগ ছিল। আমরা শহর থেকে ছড়িয়ে পড়তাম, শো করতাম বর্ধমান, বহরমপুর বা পুরুলিয়ার মতো বিভিন্ন মফস্সল শহরে। দুর্গাপুর, বার্নপুর, জামশেদপুরের মতো শিল্পশহরেও প্রতি বছর যেতাম। সেখান থেকেও নানা উপাদান আমরা পেতাম। সেটা বন্ধ হয়ে গিয়ে একটা নাগরিক বৃত্তে আটকে গিয়েছি আমরা। এতে করে সাংস্কৃতিক পরিসরটা বাড়ছে না। আমরা কমিউনিটি থেকে দূরে সরে গিয়েছি। সিনেমার ক্ষেত্রেও তাই। আগে কমিউনিটির মধ্যে ছিল সিনেমাটা। পাড়ায় দু’-তিনটে হল আছে। দুপুরে বা সন্ধেয় বন্ধুদের সঙ্গে ছবি দেখে এলাম। সেটা এখন আর নেই। এখন মাল্টিপ্লেক্সে ছুটতে হয়, সেখানে নিরাপত্তার বলয় পেরোতে হয়, কত তার ঝক্কি। পাড়ার হলে সিনেমা দেখার সেই সহজ আনন্দটা আজ নেই। সাংস্কৃতিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে আগে একটা পারস্পরিক আদানপ্রদানের পথ ছিল, তা এখন রুদ্ধ। সব মিলিয়ে সাংস্কৃতিক সেই পরিমণ্ডলটা আটকে গিয়েছে কোথাও। তার সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধগুলো তো আছেই, যেগুলোর মুখোমুখি প্রতিনিয়ত হতে হচ্ছে আমাদের, তাতে কাজটা আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন: এখন প্রকৃত সঙ্কট এবং তৈরি করা সঙ্কটের মধ্যে মানুষ তো বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এটা তো একটা বিপদ...

সুমন: রাজনৈতিক বলো বা সামাজিক অর্থে বলো, আমরা সবাই এখন কম-বেশি ‘ম্যানিপুলেটেড’। সমাজমাধ্যম খুললেই তা প্রকটিত হয়। এই ‘ম্যানিপুলেশন’ বা অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে সত্যি-মিথ্যে সব গুলিয়ে যাচ্ছে। এটা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় অনেক সময়। কারণ, এই নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পিত ভাবে করা হচ্ছে। এটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ একা একা সম্ভব নয়। যারা এটা করছে, তারা যথেষ্ট শক্তিশালী। তাই তাদের এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে দাঁত ফোটাতে গেলে দরকার কমিউনিটির ভিতরে গিয়ে কাজ করা, ছোট ছোট দলে। কেন্দ্রীভূত বড় শক্তি দিয়ে আর লড়া যাবে বলে আমার মনে হয় না। ইট হ্যাজ় টু বি গেরিলা ওয়ারফেয়ার, নবারুণদার (ভট্টাচার্য) ভাষায় বলতে গেলে এটাই বলতে হয়। ছোট ছোট গোষ্ঠীতে পাড়ায় পাড়ায় আগে একটা সচেতন রাজনীতির চর্চা চলত, গ্রামের দিকেও তখন ক্লাস হত। বিশেষ রাজনৈতিক দলের পুষ্ট হলেও স্বাধীন ভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান এগুলো করত। এই ব্যাপারটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন একটা একচেটিয়া কেন্দ্রীভূত প্রবাহ, সে ফেসবুক হোক, ইনস্টাগ্রাম হোক বা এক্স, সারা ক্ষণই আমরা এগুলো দেখছি, সারা ক্ষণই ‘ম্যানিপুলেটেড’ হচ্ছি। এক জনের যে বিষয়ে উৎসাহ, সে সেই ফিড দেখে যাচ্ছে অনবরত, যা আসছে তাই দেখছে, বিচার না করেই। ফলে সে ক্রমাগত অস্থির হয়ে উঠছে, বিভ্রান্ত হচ্ছে নিজের অজান্তেই। ফলে নিরন্তর সেই অস্থিরতার মধ্যে প্রতিটা মুহূর্ত যাপন করছে সেই ব্যক্তি।

সুমন মুখোপাধ্যায় নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘কা‌ঙাল মালসাট’, ‘হারবার্ট’কে পর্দায় ধরেছেন।

সুমন মুখোপাধ্যায় নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘কা‌ঙাল মালসাট’, ‘হারবার্ট’কে পর্দায় ধরেছেন। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

প্রশ্ন: তা হলে কী করণীয়?

সুমন: সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নেমে আসা এই রাজনৈতিক ‘ম্যানিপুলেশন’ বা নিয়ন্ত্রণ এড়ানো সম্ভব, যদি মানুষে মানুষে পারস্পরিক সংলাপ, আদানপ্রদানের আবহটা আবার ফেরানো যায়। সেটার জন্যে ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি করতে হবে, পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে ছোট ছোট আলোচনায় বোঝাতে হবে। বড় কিছু ভাবতে গেলে হবে না। আগে সেটা হত। আমরা এসএমএস করে লোক ডেকে বিশাল প্রতিবাদ মিছিল করেছিলাম আগের সরকারের সময়ে। ধর্মতলা থেকে কলেজ স্কোয়্যার পর্যন্ত মিছিল দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এখন সেটা সম্ভব নয়। এখন একজন মানুষের কাছে অনেক রকম বার্তা পৌঁছোচ্ছে। তিনি জানেন না বা বুঝতে পারছেন না, কোনটায় তিনি যাবেন বা যাওয়া উচিত। তার মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর ব্যাপারটা তো আছেই সর্ব ক্ষণ। আমার মনে হয়, ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি করে কমিউনিটি গড়ে লোকজনকে বোঝানোর প্রক্রিয়ায় ফিরে যাওয়া উচিত।

প্রশ্ন: এই পরিস্থিতিতে বামপন্থার ভূমিকা....

সুমন: রাজনৈতিক দলের মধ্যে যাঁরা কাজ করেন সরাসরি, তাঁদের উদ্যোগটা বড় হয়ে দাঁড়ায়। মুশকিলটা হল, কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে যেমন প্রচুর আলোচনাও হয়েছে, তেমনই তাদের মধ্যে স্ববিরোধও ছিল প্রচুর। দলের বাইরে কেউ কথা বললে তাদের পছন্দসই হত না। এটা আমরা সত্তর-আশির দশকেও দেখেছি। আমাদের নাটক-সিনেমা নিয়ে ওদের ভূমিকাতেও দেখেছি। কিন্তু এর পরেও একটা উদারতা ছিল। একটা খোলা জায়গা, একটা আলাপ-আলোচনার জায়গা তখনও ছিল। কারণ, তখন দলের নেতাদের কেউ কেউ হয়তো বুঝতেন, এরা তাঁদের কথা না মানলেও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে কাজটা এরা করছে, সেটার মধ্যে দিয়ে বামপন্থাকেই কোথাও বৃহত্তর অর্থে গৌরবান্বিত করছে। সেটা ছিল। এখন সেই ‘ডায়লগ’টা, সেই পারস্পরিক আলোচনার জায়গাটা পুরো নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। এখন কোনও পলিসিই দেখতে পাচ্ছি না বামপন্থীদের। রাস্তায় গিয়ে বিরোধ করা বা গাড়ি আটকানো ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। এই যে কমিউনিটির মধ্যে গিয়ে কাজ করা, ক্লাস করা, এই কাজগুলো তো এক সময় কমিউনিস্ট পার্টিই করত। অন্য দিকে, আজও কমিউনিটির মধ্যে কাজ হচ্ছে, কিন্তু তার ধরন আলাদা। সেটা পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির অঙ্গ। এটাকে কাউন্টার করা বা উন্নততর ভবিষ্যতের কথা ভেবে কিছু করা, এটা এখন আর নেই। এ ক্ষেত্রে বামপন্থীদের একটা বড় ভূমিকা থাকা উচিত। কিন্তু আমার মনে হয় না, সে রকম কোনও বড় কর্মসূচি ওদের রয়েছে। কারণ, আমার মনে পড়ে, কয়েক বছর আগে একটা আলোচনাসভায় আমি বলেছিলাম যে, বইমেলায় লিটল ম্যাগাজ়িনের স্থান যে ক্রমাগত সঙ্কীর্ণ হচ্ছে সেটা একটা ভয়ঙ্কর সঙ্কেত। এটা আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সেই সভায় সহ-আলোচক ছিলেন আজকের সিপিএমের একজন প্রধান নেতা। তিনি আমার বক্তব্য খণ্ডন করে বলেছিলেন যে, আমরা নাকি বড় করে কিছু দেখতে পারি না, শুধু ছোট ছোট জিনিস নিয়ে পড়ে থাকি। এটাই নাকি মুশকিল। তো তাঁর সেই কথার প্রেক্ষিতে এটুকুই বলি, আজকে ওঁদের বড় ব্যাপার তো দেখছ।

প্রশ্ন: শাসকের জনবিরোধী কাজের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন। আজ আপনার অনেক সহযোদ্ধা আর এক শাসকদলের সঙ্গী।

সুমন: শিল্পীর, শিল্পীসত্তার যে একটা দার্ঢ্য আছে, তার যে একটা নিজস্ব মতামত, তার নিজস্ব বয়ান আছে সমাজকে পড়ার, রাজনীতিকে পড়ার, মানুষকে চেনার...। সেই স্বতন্ত্র বয়ানটা একটা সময় ছিল শিল্পীদের মধ্যে। সেই বয়ানটাই এখন হারিয়ে গিয়েছে। আজকের শিল্পীদের কোনও যাচাইয়ের মুখোমুখি হতে হয় না। ধরা যাক, আমরা তো নগরজীবনের জন্যই থিয়েটার করছি। কারণ, আমরা নগরজীবনটাকে চিনি। কিন্তু, আগে একটা চেষ্টা ছিল, যদি এটাকে পেরিয়ে আরও অনেকগুলো স্তরে পৌঁছোনো যায়। ফলে আমাদের সর্বত্রই মানুষের কাছে যাচাইয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। আমার কাজের জন্য শহরে হয়তো সাফল্য পেয়েছি, আবার মফস্সল বা গ্রামের দর্শকের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছি। তখন বিরোধিতার মুখোমুখি হওয়ার জায়গাগুলোতেও যেতে হত। এটাই হচ্ছে শিল্পীর সঙ্গে দর্শকের সংলাপের বিভিন্ন স্তর। এখন সেটা হচ্ছে না। এখন আমার কথায় যাঁরা একমত, তাঁদের কাছেই আমরা শিল্পকর্ম দেখাচ্ছি, মতামত দিচ্ছি... কোনও বিরোধিতা নেই। এই যে বিরোধিতা হচ্ছে না, যাচাইটা হচ্ছে না কোথাও, এটা গোটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলটাকে, শিল্পীমানসকে অবরুদ্ধ করে দিচ্ছে, একটা জায়গায় আটকে গিয়েছি আমরা। সংলাপটা দরকার, সে চলচ্চিত্রকারেরও দরকার, আবার নাট্য পরিচালকেরও কাছেও জরুরি। আমার ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ সিপিএমের একেবারেই পছন্দ ছিল না। কিন্তু, সেখানে নিম্নবর্গের কথা যে বলা হয়েছে, সেটায় গিয়ে ওরা আবার আটকে গেল। আসলে ওদের বক্তব্য ছিল, পার্টির কেন সমালোচনা করলে? এটা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রায় সবার ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে— আইপিটিএ মুভমেন্ট থেকে জাঁ পল সার্ত্রে কেউ বাদ যায়নি। আর যদি রাজনৈতিক ছবির কথা বলা হয়, তা হলে বলব, রাজনৈতিক ছবি করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক নাটকও খুবই কম হচ্ছে সেই অর্থে। কড়া রাজনৈতিক বক্তব্যের নাটক যাকে বলে, যেগুলো আমরা করতে চাই, সে নাটক হয়েছে এক সময়। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ করেছি, ‘যারা আগুন লাগায়’, ‘মেফিস্টো’ করেছি। সিনেমায় নবারুণদার ‘কাঙাল মালসাট’ বা ‘হারবার্ট’ করেছি। পাশাপাশি, আমার সমসাময়িকেরাও জরুরি কাজ করেছেন। প্রত্যেকটাই ভয়ঙ্কর ভাবে রাজনৈতিক। ‘হারবার্ট’-এর ক্ষেত্রেও দেখেছি, তখন ছবিটা নানা স্তরের লোকে দেখছেন, সাফল্য পাচ্ছে ছোট ছোট এলাকায়। কিন্তু সেই ছোট ছোট কমিউনিটি স্ক্রিনিংগুলোই আর হচ্ছে না। হয়তো ব্যারাকপুরের একটা সিঙ্গল হলে ‘হারবার্ট’ দেখানো হল, দর্শক রিজেক্ট করল, হতেই পারে। সেটা জানাটাও জরুরি।

‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ ছবির সেটে আবীর চট্টোপাধ্যায়, জয়া আহসান, সুমন মুখোপাধ্যায়।

‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ ছবির সেটে আবীর চট্টোপাধ্যায়, জয়া আহসান, সুমন মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

প্রশ্ন: কলকাতা ছিল প্রতিবাদের শহর। সেই জোরটা যেন আজ নেই। দৃষ্টান্ত আরজি কর আন্দোলন।

সুমন: আরজি কর নিয়ে আন্দোলনটা হঠাৎ একটা নাগরিক উত্থান। এর প্রভাব গ্রামাঞ্চলে তেমন পড়েনি। প্রথম দিকে এর একটা প্রাবল্য ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে এর উত্তাপ কমে যেতে বাধ্য। এটা শহরের বেশ বড় সংখ্যক সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ হলেও, সরাসরি রাজনৈতিক দলের কোনও যোগ ছিল না। কিছু রাজনৈতিক দল ফয়দা তুলতে চেয়েছিল, সেটা ধোপে টেকেনি। কিন্তু রাজনৈতিক দলই একটা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে— সেটাই তাদের কাজ। যেমনটা, নন্দীগ্রামের সময় হয়েছিল। তখন নাগরিক একটা প্রতিবাদের প্রবাহ তৈরি হল। তৃণমূল সেটাকে ব্যবহার করেছিল অত্যন্ত সুচারু ভাবে। সেটা ছিল একটা গ্রামীণ সমস্যা, যেটার ইমপ্যাক্টও অনেক গভীর। সেখানে জমি, চাষ, উপার্জনের মতো বিষয় জড়িয়েছিল। আরজি করের সঙ্গে নন্দীগ্রামের এখানেই সামাজিক ও রাজনৈতিক তফাত। তা সত্ত্বেও বলব, আরজি কর কাণ্ড ঘিরে নাগরিক উত্থানটারও একটা গুরুত্ব আছে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত সেটা রাখা গেল না... যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন সেই আন্দোলনরত ডাক্তার বা শিল্পীরা সরকারি কোপে পড়লেন। সাধারণ মানুষকেও কাজে ফিরতে হবে। তাই সব মিলিয়ে জিনিসটা থিতিয়ে গেল।

২০১১ সালে মিশরে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে কায়রোর তাহরির স্কোয়্যার আন্দোলনের সময় শিল্পীরা, চলচ্চিত্রকারেরা অনেক কাজ করছিলেন। কিন্তু যেটা হল, ওই আন্দোলনের জেরে সেখানে স্বৈরতন্ত্র পড়ে গেল। কিন্তু, তার পরে আরও বড় স্বৈরতান্ত্রিক নেতা এসে বসল। এটাও ঘটেছে। তবে, ওই সময়ে মিশরে ‘আরব স্প্রিং’টা জরুরি ছিল। ফলে এই ইতিহাসটা থেকেও আমরা শিক্ষা নিলাম যে, স্বৈরতন্ত্র অনেক বড় জায়গায় অপারেট করছে। না হলে ট্রাম্প, নেতানিয়াহুর মতো লোক শাসন ক্ষমতায় থাকতেন না। এঁরাও সাধারণ মানুষের ভোটেই ক্ষমতায় এসেছেন। তো আমরা ইতিহাসের এমন একটা গহ্বরে এসে পড়েছি, এই পরিস্থিতিতে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে পরিস্থিতির উপর, এ ছাড়া আর কীই বা করতে পারি। এখন শিল্পীরাও যদি ক্রমাগত পিছিয়ে যান, তা হলে তো মুশকিল।

প্রশ্ন: গ্রামীণ বা লোকশিল্পের চর্চা কমে যাওয়ায় কি বাংলা থিয়েটারও শিকড়হীন, শীর্ণ হয়ে পড়ছে না?

সুমন: এই যে লৌকিক ধারাগুলো, এগুলো সারা ক্ষণ আমাদের মধ্যেও কাজ করে। কিন্তু যেহেতু আমরা কোথাও যেতে পারছি না, তাই সেটার প্রয়োগও করা যাচ্ছে না। এই যে ‘টিনের তলোয়ার’ করলাম, এটা একটা উনিশ শতকের নাটক যার মধ্যে লৌকিক শিল্প ঢুকছে, লৌকিক গল্প ঢুকছে, ওরাল হিস্ট্রি ঢুকছে... এগুলোর সঙ্গে বাংলা নাটক নিজেকে সম্পৃক্ত করেছে বার বার। ঠিক একই কারণে ‘মারীচ সংবাদ’-এর মতো নাটক পঞ্চাশ বছর পরেও জীবিত। কিন্তু এখন যাঁরা ছবি করছেন, বা নাটক করছেন, তাঁরা ভেবেই নিচ্ছেন, যেহেতু নাগরিক সমাজের মধ্যেই তাঁদের কাজ আবদ্ধ থাকবে, সেহেতু নাগরিক বিষয়ই তাঁরা বেছে নিচ্ছেন। আগে সবার একটা দায় থাকত, তাঁদের প্রযোজনা নিয়ে আরও প্রত্যন্ত এলাকায় যেতে হবে, সেখানকার কথা বলতে হবে। তখন ওটা মাথায় থাকত যে, কী ভাবে আমি আমার চেনাশোনা গণ্ডির বাইরে গিয়ে আরও বৃহত্তর সমাজে গিয়ে নিজের কথা বলব, তাদের কথা বলব। বৃহত্তর পরিসরে নিজেদের যাচাই করে নেওয়ারও একটা মন ছিল। সেই যাচাইয়ের জায়গাটা আজ আর নেই। সুযোগও নেই। আমি জানি না, ‘মেফিস্টো’ আজ গ্রামের মানুষ কী ভাবে নেবেন। কিন্তু এটা জানি, ‘টিনের তলোয়ার’ গ্রামে গ্রামে যাওয়া উচিত ছিল। হচ্ছে কী, মফস্‌সলের উদ্যোক্তারা চাইছেন ‘টিনের তলোয়ার’ মঞ্চস্থ হোক সেখানে। কিন্তু সেটা তাঁদের আর্থিক সামর্থ্যে কুলোচ্ছে না। ফলে এই আদানপ্রদানটা বন্ধ হয়ে গিয়ে কী হচ্ছে, নাটকের বিষয়বস্তু চয়ন থেকে, তার নির্মাণ, পরিবেশন শৈলী, এ সব থেকে সেই মফস্সল বা গ্রামের নিজস্ব সংস্কৃতি বাদ পড়ে যাচ্ছে। দু’-একটা প্রয়াস তবু এর মধ্যে দেখা যায়। জসিমুদ্দিনের লেখা নিয়ে হচ্ছে। কিন্তু, সেই ওই একটা-দুটো নিয়েই বার বার হচ্ছে। নতুন কিছু হচ্ছে না। আগে যাত্রাপালা মাধ্যমটার একটা সারল্য ছিল। কিন্তু, সময়ের প্রয়োজনে সেটাকেও বদলে ‘ওয়ান ওয়াল’-এ যেতে হল, গানের ধরনও বদলে গেল। একটা দৃষ্টান্ত দিই। ছোট থেকেই দেখছি, চেতনার ‘মারীচ সংবাদ’ নাটকে ‘মেরি বাবা’ গানটা এক সময় খুব সাড়া ফেলেছিল। শহরে এক রকম হাততালি পড়ত, মফস্‌সলে আর এক রকম হাততালি, এটা দেখেছি। কিন্তু, পরের দিকে মনে হয়েছে, কীর্তনের সুরে গানটার মর্মকথা যে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে, সেই জায়গাটা লোকে আর যেন বুঝতেই চাইছেন না। আমরা যেন দূরে সরে যাচ্ছি দর্শক থেকে। গানের মধ্যে যে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদের কথা বলা হয়েছে, সেই চেতনার জায়গাটাতেই যেন আজ অনেকে নেই। এই নেওয়ার জায়গাটারও বদল ঘটেছে, বুঝতে পারি।

প্রশ্ন: একটা সময় বাংলা নাটকের জগৎ তারকাখচিত ছিল। সেটা আজ নেই।

সুমন: এত তারকা ছিল ঠিকই, তবে লোকজন গ্রুপের নাটক দেখতে যাচ্ছেন বলেই যেতেন, নাটকটাকে ভালবেসে। কে অভিনয় করছেন, সেটা অত গুরুত্বের ব্যাপার ছিল না। তখন তো সবাই তারকা। তখন সেই তারকা অভিনেতাদেরও যেমন গুরুত্ব ছিল, নাট্যদলগুলোরও ছিল। তখন অনসম্বল থিমে কাজ হয়েছে, যেখানে সাধারণ নতুন অভিনেতাদের সঙ্গে তারকারাও থাকতেন। এখন যেটা হয়েছে, অর্থনৈতিক একটা চক্র গোটা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকের কাজ করছে, যার ফলে তারকা-নির্ভরতা জরুরি হয়ে পড়ল। সিনেমার ক্ষেত্রে কী হয়েছে, আগে স্বাধীন পরিচালকদের বা প্রযোজকদের একটা জায়গা ছিল। এখন বড় বড় হাউস এটা নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা সিরিয়াল করে, সিনেমাও বানায়, আবার ওয়েব সিরিজ়ও করে। সব কিছুই তারা করছে, সুতরাং তাদের বিরাট প্রভাব। এর ফলে স্বতন্ত্র কোনও পরিচালক, যিনি নিজে টাকা খরচ করেও হয়তো ছবি করতে চান, তিনি এই চক্রের মাঝে পড়ে যাচ্ছেন। স্বতন্ত্র প্রযোজকেরাও সরে গেলেন। কারণ, তিনি ছবি করে সেটা বিক্রি করতে পারবেন না। ছবি বিক্রি তো আজ একটা প্যাকেজ। সেটা একার পক্ষে করা সম্ভব নয়।

নাট্য নির্দেশনায় সুমন মুখোপাধ্যায়।

নাট্য নির্দেশনায় সুমন মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

প্রশ্ন: এখনও আশা করো, আজ থেকে এক বা দেড় দশক পরের প্রজন্ম বাংলা নাটক দেখতে আসবে?

সুমন: না, মনে হয় না দেখতে আসবে। বাংলা নাটকের দর্শকসংখ্যা এখনও যেটা আছে, সেটা মূলত যাঁরা ষাট-সত্তরের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, এখন প্রবীণ হয়েছেন, তাঁরা দেখি তাঁদের ছেলেমেয়েদের জোর করে নাটক দেখতে নিয়ে আসেন। এখনও বাংলা নাটকে নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা যুক্ত আছেন, এটা ঠিক। কিন্তু, নাটকে বাঙালি দর্শক আশানুরূপ অনুপাতে একেবারেই বাড়েনি। এই প্রজন্মের এনগেজমেন্টের জায়গাটা এখন বদলে গিয়েছে। এখন অনেকেই ভাবে, নাটক দেখতে যাওয়া মানেই আড়াই বা তিন ঘণ্টার একটা কমিটমেন্ট। এ সব নানা কারণে হয়তো থিয়েটারমুখী হতে চায় না এখনকার তরুণ প্রজন্মের অনেকেই। এত সময় এখন ওরা দিতে নারাজ। তো এগুলো ঘটে গিয়েছে। এগুলো তো অস্বীকার করতে পারব না, এ সব নিয়েই চলতে হবে। তবে সব মিলিয়ে এটাই বলতে পারি, জোর করে আশাবাদী আমি হতে পারছি না। আমার আশাবাদ আছে, আমি ভয়ঙ্কর পজ়িটিভ। কিন্তু জোর করে বলতে পারব না। বরং বলা ভাল, আমরা সঙ্কটের মধ্যে আছি। আমাদের উচিত একসঙ্গে মিলিত ভাবে কাজ করে সমাধানের পথ খোঁজা। এটুকুই বলতে পারি।

Politics Acting Suman Mukhopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy