Advertisement
E-Paper

পদ্মাবত-পদ্মিনী-পদ্মা, ‘ইতিহাস’-এর জয় হোক!

সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর সিনেমা অলীক কুনাট্যেরই নতুন সংযোজন। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তীসঞ্জয় লীলা ভন্সালীর সিনেমা অলীক কুনাট্যেরই নতুন সংযোজন। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৭ ১৯:৪৯
‘পদ্মাবতী’। ছবি: দীপিকা পাড়ুকোনের ইনস্টাগ্রাম পেজের সৌজন্যে।

‘পদ্মাবতী’। ছবি: দীপিকা পাড়ুকোনের ইনস্টাগ্রাম পেজের সৌজন্যে।

বার বার তিন বার! তৃতীয় বারও সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর ছবি পদ্মাবতী নিষিদ্ধ করার আর্জি খারিজ করে দিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই সঙ্গে কড়া ভাষায় গুজরাত, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী-সহ জনা কয়েক রাজনৈতিক নেতাকে তিরস্কার করে জানাল, দায়িত্বশীল পদে থেকে এ রকম মন্তব্য করা অনুচিত।

আরও পড়ুন, ‘পদ্মাবতী’ নিষিদ্ধ নয়, মুখ্যমন্ত্রীদের তিরস্কার করে ফের জানাল সুপ্রিম কোর্ট

ভারতীয় ঐতিহ্য অবশ্য এটাই। রাম না জন্মাতেই রামায়ণ লেখা, ছবি সিনেমা হল, মায় সেন্সর বোর্ডে আসার আগে গরমাগরম বিরোধিতা। গল্পটা নতুন নয়। বারাণসীতে দীপা মেটার ‘ওয়াটার’ ছবি তৈরির সময় এ রকমই ঘটেছিল।

‘পদ্মাবতী’-ও সে রকম। শুটিংয়ের সময় থেকেই বিতর্কে। কখনও সেটে হামলা, কখনও বা দীপিকা পাডুকোনের মাথার দাম দশ কোটি টাকা ধার্য করা। তার সঙ্গে করণী সেনা, রাজপুত জাত্যাভিমান, আলাউদ্দিন খিলজির সঙ্গে পদ্মাবতী কেন নাচবে, পদ্মিনী-উপাখ্যান ইতিহাস না গল্প ইত্যাদি হরেক গোলকধাঁধা।

‘পদ্মাবতী’ ছবির একটি দৃশ্যে দীপিকা পাড়ুকোন ও শাহিদ কপূর। ছবি: দীপিকার ইনস্টাগ্রাম পেজের সৌজন্যে।

এই গোলকধাঁধা থেকে বেরোতে চমৎকার কাজটি প্রথম করেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপাণী। তিনি এবং বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ দু’জনেই ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সেন্সর যা-ই বলুক, ভোটের আগে এই ছবি গুজরাতে মুক্তি পাবে না। অন্য দিকে, এত ঝামেলা সত্ত্বেও আর এক গুজরাত-গৌরব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখে কুলুপ। এটাই তো হওয়ার কথা। পদ্মাবতী কবিতার নায়িকা। বাস্তব আলাউদ্দিন খিলজির প্রেমিকা অন্য। গুজরাতের হিন্দু রাজা কংসকে আলাউদ্দিন যুদ্ধে পরাস্ত করে তাঁর সুন্দরী স্ত্রী কমলা দেবীকে বিয়ে করেন। কমলা দেবী আবার আলাউদ্দিনের কাছে আব্দার ধরেন, তাঁর মেয়ে দেবলা দেবীকে কংস চুরি করে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছেন। তাকে খুঁজে দিতে হবে। আলাউদ্দিন ছেলে খিজির খাঁকে সেই মেয়েকে খোঁজার নির্দেশ দেন। তার পর চার চোখের মিলন, খিজির খাঁ ও দেবলা দেবীর প্রেমোপাখ্যান আজও বিখ্যাত। এ সব ভুলে শুধু কাল্পনিক পদ্মাবতী নিয়ে ছবি করলে হবে? আফটার অল, গুজরাতি অস্মিতা বলে একটা ব্যাপার আছে না!

আরও পড়ুন, দীপিকার মাথা, মমতার নাক কাটার হুমকি দিয়ে অবশেষে আমুর ইস্তফা

মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীশগঢ় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও এ ব্যাপারে ধন্যবাদ দাবি করতে পারেন। সুফি কবি মালিক মহম্মদ জায়সি ১৫৪০ সালে যখন পদ্মাবত কাব্য লিখছেন, তার দুশো বছরেরও আগে আলাউদ্দিন খিলজি মারা গিয়েছেন। মালবের রাজা গিয়াসউদ্দিন সুফি ভক্ত ছিলেন, আজমেঢ় শরীফে একটি দরজা তৈরি করে গিয়েছিলেন। কিন্তু গিয়াসউদ্দিন খুব বিলাসপ্রেমিক ও নারীসম্ভোগী ছিলেন। এক দিকে অন্তঃপুরের মেয়েদের কোরাণ শেখার ব্যবস্থা করতেন, হারেমে ১২ হাজার মহিলা ছিলেন। সেই সমসাময়িক মালবের রাজার আদলেই তো দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিনকে গড়েছিলেন জায়সি। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীশগঢ়কে ভুলে গেলে তাই চলবে? পদ্মাবতীর ঐতিহাসিক গৌরবে ওঁরাও ভাগীদার। খামোখা লোকে রাজস্থান-রাজস্থান করে!

পঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশওযথোচিত কাজ করেছে। ওই দুই রাজ্যের ইতিহাস জানে, আলাউদ্দিন খিলজি বীর ছিলেন, পাঁচ বার মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন। আলাউদ্দিন ধর্মান্তর করতেন, কলমা পরিয়ে লোককে মুসলমান করতেন। কিন্তু হিন্দুদের অতখানি নয়। তিনি মুখ্যত আদিম শক্তির উপাসক মোঙ্গলদেরই ধরে ধরে মুসলমান করতেন। সেই আলাউদ্দিন খিলজি হিন্দুবিরোধী নারীলোলুপ মুসলমান শাসক! যোগী আদিত্যনাথ, অমরিন্দর সিংহরা তাই সঙ্গত কারণেই এই ছবির বিরোধিতায় সুর মিলিয়েছেন। ওঁদের ইতিহাসবোধ প্রখর!

আরও পড়ুন, পদ্মাবতী কাণ্ড: কাল ব্ল্যাক আউট প্রতিবাদে টলিউড

নীতীশকুমারও শেষ মুহূর্তে ঐতিহাসিক কারণেই এই ছবির বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন। পদ্মাবতীর কবি জায়সি শের শাহের আমলের লোক, শের শাহের বন্ধু রাজা জগৎ দেবই কবির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। শের শাহের রাজ্য বিহার থেকে উঠে-আসা এই বিরোধিতা আজও ‘মিত্রো’ কাহিনিই বটে!

মালিক মুহম্মদ জায়সির কথাটা এ বার খুলে বলা যাক! মধ্যযুগে তিনিই পদ্মাবতীকে নিয়ে প্রথম কাব্যকাহিনি লেখেন। আলাউদ্দিন খিলজির সমসাময়িক কারও লেখায় পদ্মাবতী উপাখ্যান নেই। কিন্তু জায়সি তো হিন্দু-মুসলমান সমণ্বয়ের সুফি কবি। বেদান্ত জানতেন, ফারসি ঐতিহ্যও! জালালউদ্দিন রুমি থেকে হাফিজ, নিজামি বেশির ভাগ ফারসি কবিই তাঁদের কাহিনিতে অনিন্দ্যসুন্দর এক নারীকে নিয়ে আসেন। সেই নারীই পবিত্র অন্তরাত্মা! ‘আলামত-ই-পাকিজগি’ বা পবিত্রতার চিহ্ন। সুফি কবিতা বলেই এখানে চিতোর নিছক কোনও রাজপুত রাজ্য নয়। চিতা মানে চিত্ত বা চিদ। তার সঙ্গে উর বা হৃদয় যোগ করে চিতাউর।

পদ্মাবত কে? সিংহল দ্বীপের রাজকন্যা। চিতোরের রাজা রতনসেন সাই পদ্মাবতের জন্য সিংহলযাত্রা করেন, শিবের মন্দিরে তপস্যা করেন। কথাসরিৎসাগর থেকে অনেক প্রাচীন সাহিত্যে সিংহল বা সুবর্ণদ্বীপের প্রতীকটি বহু ব্যবহৃত, জায়সি সেটিই ব্যবহার করেছেন। কাব্যের এক জায়গায় রতনসেন চিতা সাজান, পদ্মাবতকে না পেলে তিনি সতীদের মতো আগুনে প্রাণ বিসর্জন দেবেন। সেই কামাগ্নি যাতে পৃথিবীকে ছারখার না করে দেয়, সেই কারণেই শিব এবং পার্বতী এসে রতনসেনকে বর দেন। জায়সি স্রেফ রাজপুত রমণীদের জহর ব্রতের কথা বলেননি। তাঁর কাহিনিতে রতন সেন মানবচিত্ত, চিতোর মানবশরীর, পদ্মাবতী চরম সত্য বা ফিরাসত! আর আলাউদ্দিন খিলজি কিছুই নন, মায়া। তিনি চিতোরদুর্গ জয় করলেও রতনসেন এবং পদ্মাবত ততক্ষণে মৃত। শরীর আছে, কিন্তু চিত্ত এবং সত্য সেখানে ধরা দেয়নি। মায়ার বাঁধন ছেড়ে তারা পগার পার।

আরও পড়ুন, বিতর্কের নয়া জটে পদ্মাবতী

অওধের কবি জায়লির লেখা পদ্মাবতের পুঁথি তখন ফারসি, উর্দু বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়, অনেকে গেয়ে শোনান। ভাল কাব্যের যে লক্ষ্মণ, এখানেও তাই। দুই তলে সমান্তরাল খেলা চলতে থাকে, দীক্ষিত পাঠক চিত্তমুক্তির কথা পান। আর সাধারণ পাঠক পেয়ে যান আক্রমণকারী সুলতান ও এক সুন্দরীর বিবরণ। মধ্যযুগ এই বহু স্বরের ইঙ্গিত দিত। শ্রীরাধা যখন কৃষ্ণকে বলতেন, ‘তোমার আমার একই হিয়া ভাল সে জানয়ে আমি’, সে তো নিছক পরকীয়া প্রেমোপাখ্যান নয়। জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন!

আধুনিকতা এসে এই বহু স্বরকে নষ্ট করল। গ্রিয়ারসন পদ্মাবতীর পুঁথি অনুবাদ করালেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জেনারেল টড রাজপুতানা ঘুরে লিখলেন ‘অ্যানালস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিজ অব রাজস্থান’। এই গ্রিয়ারসন, টডেরা ‘মার্শাল রেস’ বা যোদ্ধা জাতির তত্ত্বে বিশ্বাসী। তাঁদের হাতেই সুফি পদ্মাবত হয়ে উঠল চিতোর রাজ্যের পদ্মিনী। চিদ এবং উর-এর ব্যাখ্যান তার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

ব্রিটিশ যদি যোদ্ধা জাতি খোঁজে, ভারতীয়রা চায় পরাধীনতা থেকে মুক্তি। স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে! সিপাহি বিদ্রোহের পরের বছরই ছেপে বেরোচ্ছে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’। একে একে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সরোজিনী বা চিতোর আক্রমণ’, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘পদ্মিনী’। অতঃপর ‘ভারতমাতা’ এঁকে যিনি সকলকে মুগ্ধ করেছেন, সেই অবন ঠাকুরের ‘রাজকাহিনী’। সুফি ইশ্ক বা প্রেমকাহিনির নায়িকা হয়ে গেলেন জাতীয়তাবাদী ইন্ধন। যে যুগের যা ডিমান্ড!

আরও পড়ুন, বাংলায় পদ্মাবতীকে স্বাগত মুখ্যমন্ত্রীর

এই যে এক পুরাকাব্য থেকে যুগে যুগে ভিন্ন কবিতা তৈরি, এটাই শিল্পের ধর্ম। আথেনীয় সভ্যতায় ইস্কাইলাস, ইউরিপিদেসরা ‘ইলেকট্রা’কে নিয়ে নাটক লিখেছিলেন। রাজা আগামেমননের মেয়ে ইলেকট্রা। আগামেমনন ট্রয়ের যুদ্ধে গিয়ে জয়লাভের জন্য নিজের মেয়ে ইফিগেনিয়াকে বলি দেন। তিনি দেশে ফিরলে তাঁর স্ত্রী তাকে খুন করেন। আগামেমননের ছেলে অরিস্টিস পরে দেশে ফিরলে, মেয়ে ইলেকট্রা ভাইকে জানিয়ে দেয়, মা বাবাকে খুন করেছে। পিতৃহত্যার শোধ নিতে অরিস্টিস তাই মাকে কোতল করে। দেশ এবং পরিবারের এই রক্তক্ষয়ী কাহিনি গ্রিক আমলেই শেষ হয়নি, নাৎসি উত্থানের পর জাঁ পল সার্ত্র সেই ইলেকট্রা-কাহিনি নিয়ে লিখলেন ‘ফ্লাইজ’, এ দেশে পরে বুদ্ধদেব বসুও লিখলেন ‘কলকাতার ইলেকট্রা’। যুগে যুগে বিভিন্ন কথা ও কাহিনির পুনর্গঠন চলতে থাকে, সেটাই সভ্যতা। সঞ্জয় লীলা ভন্সালীরও সেই শিল্প-অধিকার আছে।

কিন্তু শিল্পীর অধিকার কে-ই বা পাত্তা দিয়েছে এ দেশে? শুধু দক্ষিণপন্থীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। স্ট্যানলি ওলপোর্টের ‘নাইন আওয়ারস টু রামা’ বা সলমন রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ এ দেশে তথাকথিত প্রগতির ধ্বজাধারীদের হাতেই নিষিদ্ধ হয়েছিল। সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর সিনেমা সেই অলীক কুনাট্যেরই নতুন সংযোজন।

এই কুনাট্যটিতে এ বার সরাসরি সরকার নেই, আছে অন্য অনেক কিছু।

আছে জাত্যাভিমান। যেখানে রাজপুত ভোটব্যাঙ্ক, সেখানেই করণীসেনা ও পদ্মাবতী নিষিদ্ধের দাবি। ব্যক্তিগত পলিটিক্যাল চয়েস নয়, জাতপাত, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভারতীয় রাজনীতির চাকা ঘোরে, সেটাই এই দেশের ঐতিহ্য। বাস্তবে না থেকেও জায়সির কল্পনায়িকা বুঝিয়ে দিলেন, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।

Padmavati Deepika Padukone Ranveer Singh Shahid Kapoor Sanjay Leela Bansali Film Actress Film Actor Celebrities Bollywood পদ্মাবতী
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy