‘রাসমণি’র চরিত্রে দিতিপ্রিয়া রায়।
ভাষা নদীর মতোই বহমান। তাতে মেশে নতুন জলধারা। তার অন্তরে থাকে পুরনো জলের সত্তাও। তাই অনেক আদি শব্দ বা তার মূল বয়ে নিয়ে যায় ভাষা। আবার অনেক শব্দ যায় হারিয়েও। যতদিন না ভাষার লিখিত রূপ পাওয়া যায় ততদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ের ভাষার স্বরূপ উদ্ধার সম্ভব নয়। অন্য দিকে লিখিত ও মৌখিক ভাষার থাকে মূলগত কিছু প্রভেদ। ফলত একটি নির্দিষ্ট সময়ের মৌখিক ভাষা অনেকটা অনুমান করেও নিতে হয়। ‘করুণাময়ী রানী রাসমণি’ ধারাবাহিকের সংলাপও তাই এ ভাবেই নির্মাণ করা হয়। সেই সময়ের মৌখিক ভাষা কী সত্যিই এরকম ছিল?
ভাষাবিদ পবিত্র সরকার জানালেন, “কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে যে পুরনো বাংলা বলা হত... ‘দেকিচি’, ‘খেয়িচি’, ‘বলবেনে’ বা ‘হবেনে’... এখন সত্যি সত্যি এ রকম করে বলা রাসমণির সময় চালু ছিল কি না আমি জানি না... তবে কলকাতার পুরনো বাংলা ভাষা সম্বন্ধে জানি... ‘হয়েছে’, ‘বলেছে’-ই বলা হত... ‘কলকাতার ভাষা’ নামে আমার একটা লেখাও আছে। এরা (ধারাবাহিক কর্তৃপক্ষ) চেষ্টা করছেন ওই সময়ের ভাষা তুলে আনবার... রাঢ়ী অর্থাৎ রাঢ় অঞ্চলের ভাষা... গঙ্গার ধার ঘেঁষে কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর পর্যন্ত যে ভাষা সেটা তাঁরা তুলে আনবার চেষ্টা করছেন। মেয়েদের মধ্যে যারা স্কুল-কলেজে যেত তারা ক্রমশ মান্য চলিত অর্থাৎ শিক্ষিত লোকের বাংলা বলতো। যে মেয়েরা বাড়ির বাইরে বার হতো না, সাহিত্য পড়ারও সুযোগ পেত না, নিরক্ষর ছিল... তারা মাটির ভাষাটাই বলতো... এটা চিরকাল সব দেশেই হয়, মাটির ভাষা মেয়েরা বলে। মেয়েদের প্রথম স্কুল তো হল বেথুন স্কুল, ১৮৪৯ এ... রানি রাসমণি স্কুলে যাননি... কাজেই তাঁর মুখে তখনকার ওই খাঁটি... যেটাকে ‘উপভাষা’ বলে, সেটাই শোনা যেত। মেয়েদের ভাষায় পুরুষের ভাষা থেকে বিশেষ তফাৎ হয়... ‘হ্যাঁ গো’, ‘হ্যাঁ গা’, ‘যাবনিকো’... এগুলো মেয়েরা বেশি বলে। ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’-র ভাষায় এর নিদর্শন পাওয়া যায়। শ্রীরামকৃষ্ণও এ ভাবেই কথা বলতেন। ওরা চেষ্টা করছেন, গল্পে সব সত্যি আসুক না আসুক...(শিল্পের স্বাধীনতার পক্ষে প্রশ্রয়ের মৃদু হাসি)”
রানি রাসমণি মানে দিতিপ্রিয়া দু’শো বছর আগের এই নির্মিত মৌখিক ভাষায় কথা বলতে গিয়ে কী উপলব্ধি করছেন? তিনি বললেন, “সংলাপ বলার সময় ‘ছ’-কে আমরা ‘চ’ বলি... তো দেখছি ব্যক্তিগত জীবনেও কথা বলতে গিয়ে মাঝে মাঝে ‘ছ’-টা ‘চ’ হয়ে যাচ্ছে... ‘ল’ হয়ে যাচ্ছে ‘ন’... ‘রাসমণি’ সিরিয়ালের সিগনেচারই হচ্ছে চরিত্রগুলোর ভাষা... ভাষাটাই মানে অ্যাকসেন্টটাই স্পেশাল আরকি...”
আরও পড়ুন, শাড়ি ছেড়ে সুইমস্যুটে দিতিপ্রিয়া!
‘করুণাময়ী রানী রাসমণি’ ধারাবাহিকের একটি দৃশ্য।
কিন্তু এই সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষার নিজস্বতা কি আমরা হারিয়ে ফেলছি? দিতিপ্রিয়া যোগ করলেন, “এখনকার ছেলেমেয়েদের বাংলাটা ঠিক আসে না... আমাদের অবশ্যই অন্য ভাষা জানা উচিত। কিন্তু নিজের ভাষা ভুলে গিয়ে নয়... নিজের ভাষাকে সম্মান করা উচিত। যখন নিজেদের ভাষাকেই সম্মান করতে পারি না, তখন নিজের ভাষা বুঝবো কী করে, আর অন্য ভাষাকেই বা রেসপেক্ট দেব কী করে?”
আরও পড়ুন, ‘ভূতের রাজা’র মতো এ কার আগমন টলিউডে?
গাজী আব্দুন নূর মানে রাজচন্দ্র ধারাবাহিক থেকে বিদায় নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এতদিন ধরে অভিনয় করতে করতে ধারাবাহিকের ভাষা নিয়ে কী মনে করেন তিনি? নূর গভীরে গিয়ে ভাষা বোঝার চেষ্টা করলেন, “বাবু রাজচন্দ্র নিজে পড়াশোনা করে ইংরেজি, পার্সি শিখেছিলেন। ১৮২৯ এ যখন সতীদাহ প্রথা বন্ধ হয়, তখন কিন্তু ব্রিটিশ প্রোনানশিয়েশন ব্যবহার হত, এখনকার মতো আমেরিকান ইংলিশ নয়... তখন বাবু রাজচন্দ্র ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সঙ্গে ব্যবসা করতেন। বাবু রাজচন্দ্র কী ভাবে কথা বলতেন, সেটা বাস্তবত আমরা জানি না... কিন্তু তাঁর ভাষাটা তৈরি করে নিতে হয়েছে। তখন যে সব শব্দ ব্যবহার হত, গত দু’শ বছরে সেই শব্দগুলো পাল্টে গিয়েছে। এখন যেমন বলা হয়, ‘দরজা বন্ধ কর’, তখনকার হিসেবে আমি বলছি, ‘দোর বন্ধ করে এসো’... আগে বলা হত, ‘শ্বশুর ঘর থেকে কবে ফিরলি?’, এখন বলি, ‘শ্বশুরবাড়ি থেকে কবে ফিরলি?’। আগে আমরা আঠেরো-উনিশ ঘণ্টা কাজ করতাম, পরে চৌদ্দ ঘণ্টা... তো এ ভাবে সংলাপ বলে বলে ব্যক্তিগত জীবনেও ইংরেজি শব্দ ব্যবহারই করি না। মাঝে মাঝে কঠিন কঠিন বাংলা শব্দ বলে ফেলি। বন্ধুবান্ধবরা বলে, ‘ভাই, শব্দটার মানে কী?’। আমি বাংলা বলে গর্ব বোধ করি। কারণ আমি বাঙালি। আমি বাংলাদেশি... ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আমরাই পেয়েছি... সত্যি বলতে আমি বাংলা ভাষা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি এবং এই একটিমাত্র ভাষা খুব ভালভাবে বলতে পারি।”
হিন্দি ও ইংরেজি বাংলা ভাষার ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছে। বাংলা ভাষার নিজস্বতা যাচ্ছে হারিয়ে। পুরনো বাংলা ভাষা খুঁড়ে এনে এই রকম ধারাবাহিকগুলি হয়তো কোণঠাসা বাংলা ভাষার হৃদয়ে নতুন প্রাণের সঞ্চার করছে।
(টলিউডের প্রেম, টলিউডের বক্স অফিস, বাংলা সিরিয়ালের মা-বউমার তরজা -বিনোদনের সব খবর আমাদের বিনোদন বিভাগে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy