Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সংস্কার ভাঙার বার্তা দিয়েই অস্কার জিতলেন ইরানি-মার্কিন পরিচালক রাইকা

লজ্জা আর চাপা হাসি! কী নিয়ে কথা বলছে ওরা। পিরিয়ডস! কী সেটা? মেয়েরা বলছে, জানি, কিন্তু বলতে লজ্জা পাচ্ছি। ছেলেদের প্রশ্ন, ঘণ্টা পড়লে বুঝতে পারি পিরিয়ড শেষ হল, সেটার কথা বলছেন?

পরিচালক রাইকা জ়েটাব্‌চির (ডান দিকে) সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার স্নেহা। লস অ্যাঞ্জেলেসে। রয়টার্স

পরিচালক রাইকা জ়েটাব্‌চির (ডান দিকে) সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার স্নেহা। লস অ্যাঞ্জেলেসে। রয়টার্স

অন্বেষা দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:২৪
Share: Save:

লজ্জা আর চাপা হাসি! কী নিয়ে কথা বলছে ওরা। পিরিয়ডস! কী সেটা? মেয়েরা বলছে, জানি, কিন্তু বলতে লজ্জা পাচ্ছি। ছেলেদের প্রশ্ন, ঘণ্টা পড়লে বুঝতে পারি পিরিয়ড শেষ হল, সেটার কথা বলছেন?

এমন টুকরো সব মুহূর্ত ধরা পড়েছে ‘পিরিয়ড. এন্ড অব সেন্টেন্স’ তথ্যচিত্রে। দিল্লি থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের হাপুর গ্রাম। সেখানকার বাসিন্দাদের নিয়েই ২৫ বছর বয়সি ইরানি-মার্কিন পরিচালক রাইকা জ়েটাব্‌চির তৈরি এই ছবি সেরা তথ্যচিত্র হিসেবে জিতে নিয়েছে অস্কার। গ্রামীণ ভারতে ঋতুস্রাব নিয়ে কী ধরনের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, গ্রামের নারী-পুরুষকে সচেতন করতে কী করা হচ্ছে, প্যাড মেশিন বসিয়ে কী ভাবে গ্রামের মেয়েরা একে অন্যের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, ‘ফ্লাই’ নামে স্যানিটারি প্যাড তৈরি করে কী ভাবে উত্তরণের কথা ভাবছেন তাঁরা— ২৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের ছবির প্রতিপাদ্য এটাই।

পুরস্কার হাতে কেঁদে ফেলে অস্কার-মঞ্চে রাইকা বলেছেন, ‘‘আমার পিরিয়ডস হয়েছে বলে কাঁদছি না। বিশ্বাস করতে পারছি না, ঋতুস্রাব নিয়ে তৈরি ছবি অস্কার পেয়েছে!’’ এই সূত্রে তিনি উল্লেখ করেন ছবির প্রযোজক গুনীত মোঙ্গার কথাও। যিনি টুইট করেছেন, ‘‘আমরা জিতেছি। এই বিশ্বের সব মেয়ের জন্য... তোমরা এক এক জন দেবী... যদি স্বর্গ এ কথা শোনে...।’’

ছবিতে নিজের কথা বলেছেন ‘প্যাডম্যান’ অরুণাচলম মুরুগনন্থম। তাঁকে নিয়ে আগেই একটা ছবি তৈরি হয়েছে (নামভূমিকায় অক্ষয় কুমার)। মুরুগনন্থম ফোনে আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘ঋতুস্রাব নিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত আলোচনা বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে নিয়েছে, তার জন্য খুবই ভাল লাগছে। এটা কিন্তু বিশ্বজনীন সমস্যা। শুধু উন্নয়নশীল দেশে এই সমস্যা রয়েছে ভাবলে ভুল হবে। উন্নত দেশেও এই সংক্রান্ত সচেতনতার অভাব আছে। অস্কার পাওয়ার পরে অবশ্যই ছবিটা বদলাবে, বিশ্বজনীন ক্ষেত্রে আলোচনা শুরু হবে।’’

ছবির পোস্টার

হাপুর গ্রামে তিনি যে ভাবে প্যাড তৈরির মেশিন দিয়ে সাহায্য করেছেন, অন্য কেউ আবেদন জানালেও কি করবেন? প্যাডম্যানের জবাব, ‘‘অবশ্যই। সেটাই আমার লক্ষ্য। দেশকে ১০০ শতাংশ স্বাস্থ্যসম্মত করে তুলতে চাই।’’

ঋতুস্রাব নিয়ে সংস্কার কাটবে কী ভাবে?

মুরুগনন্থম বলেন, ‘‘পাঁচশোরও বেশি বছরের পুরনো এই সংস্কার ভাঙতে দরকার শুধু আলোচনা। প্রত্যেক বোন যেন দাদাকে, মেয়ে তার বাবাকে, স্ত্রী তার স্বামীকে এ নিয়ে দ্বিধাহীন ভাবে কথা বলতে পারে।’’

প্যাডম্যানের অভিনেতা অক্ষয় কুমারও টুইটে অভিনন্দন জানিয়েছেন টিম পিরিয়ড-কে। তাঁর মন্তব্য, ‘‘অত্যন্ত প্রয়োজনীয় আলোচনা এবং যথাযথ জয়।’’

উত্তরপ্রদেশের হাপুর গ্রামে গত ২০ বছর ধরে কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার (‘অ্যাকশন ইন্ডিয়া’) দেবেন্দ্র কুমার। তাঁরাও এই ছবির সঙ্গে জড়িয়ে। ফোনে বললেন, ‘‘এই ছবি নিয়ে এ বার জোর প্রচার শুরু হবে। স্কুলের পরীক্ষা শেষ হলেই ১ মার্চ থেকে আমরা এই ছবি দেখাব স্কুল, কলেজ, ক্লাবে।’’ এর আগে কেমন ছিল গ্রামের অবস্থা? দেবেন্দ্র জানাচ্ছেন, ছবিতে যেমন দেখেছেন, মহিলা-পুরুষ কেউই এ নিয়ে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। আমেরিকা থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, লস অ্যাঞ্জেলেসের কিছু স্কুলপড়ুয়া এবং আরও অনেকের সঙ্গে মিলে ঋতুস্রাব নিয়ে ছুতমার্গ কাটানোর কাজটা শুরু হয়েছিল। মার্কিন সংস্থাই চাঁদা তুলে জোগাড় করে দেয় প্রায় ৫ লক্ষ টাকা। লক্ষ্য ছিল, গ্রামের মহিলাদের ক্ষমতায়ন। তাঁরাই প্যাড তৈরি করবেন, তাঁরাই বিলি করবেন। যাতে মহিলাদের জড়তা কাটে। টাকায় না কুলোনোয় যোগাযোগ করা হয় কোয়মবত্তূরে ভারতীয় ‘প্যাডম্যান’-এর সঙ্গে। তাঁর সস্তায় প্যাড তৈরির মেশিন দিয়ে সাহায্য করেন মুরুগনন্থম।

২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু হয়। হাপুরের নানা বয়সের মহিলাকে শামিল করা হয় তাতে। পুরো অভিজ্ঞতা ক্যামেরায় ধরে রাখেন রাইকা। উদ্দেশ্য, সচেতনতা বাড়াতে ব্যবহার করা হবে এই তথ্যচিত্র। তার পর থেকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে অস্কার জয়। কেমন লাগছে হাপুরের?

গ্রামে বসে দেবেন্দ্র বললেন, ‘‘গ্রামবাসীরা খুব খুশি। আমেরিকায় আমাদের গ্রামের নাম পৌঁছে গিয়েছে, এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে!’’ গত দু’বছরে কতটা বদলেছে গ্রামবাসীদের মানসিকতা? অভিজ্ঞ সমাজকর্মী বলছেন, ‘‘সবাই এত কম সময়ে কি পাল্টে যায়? তবে অনেক মহিলা এখন প্যাড ব্যবহার করেছেন। এখানকার মহিলারাই দোরে দোরে ঘুরে তাঁদের বোঝাচ্ছেন।’’ তাঁদের সাফল্যে এগিয়ে এসেছে ব্যবসায়িক বেশ কিছু সংস্থা। যাদের সপাটে না বলে দিয়েছেন এই প্রকল্পের

সঙ্গে জড়িত সবাই। তাঁরা বলেছেন, ‘‘আমরা পরিবেশবান্ধব প্যাড তৈরি করে সস্তায় তা বেচে সাহায্য করতে চাই আরও অনেককে। এটা নিয়ে অন্য কেউ শুধু ব্যবসা করে লাভবান হবে, সেটা চাই না।’’

প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে একটু একটু করে সাহসী হয়ে উঠেছেন হাপুরের স্নেহা (যিনি স্বপ্ন দেখেন দিল্লি পুলিশে যোগ দেবেন), সুমন, রাখিরা। ছবিতে স্নেহা বলেন, ‘‘বিয়ে থেকে বাঁচতে পুলিশ হবো।’’ মেয়ে হয়ে গোটা গ্রামের সঙ্গে একা লড়বেন কী ভাবে? ভাবনা ছিল তাই নিয়ে। প্যাড তৈরির কাজ করে রোজগারের টাকা দিয়ে এখন পুলিশ হওয়ার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন স্নেহা। একদিন তাঁর বাবাও হাজির প্যাড তৈরির কারখানায়!

অটোয় করে ঘুরে ঘুরে প্যাড বেচার কাজে যোগ দিয়েছেন বয়স্কা শাবানা। মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার আগে যিনি বোঝান, ‘‘অনেক কিছু পাল্টাতে হবে। অনেক কিছু এ বার পাল্টাবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

OSACRS 91st Academy Awards
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE