Advertisement
E-Paper

ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় শত্রু, ক্ষতিকারক চোর! সব জেনেও তাকে ধরা যাচ্ছে না কেন?

এ ভাবেই ইন্ডাস্ট্রির মানুষ দিনের পর দিন চুপ করে আছেন। দেখা গিয়েছে, এই কারণেই ৯৫ শতাংশ প্রযোজনা সংস্থা ‘ইম্পা’ বা প্রশাসনের কাছে কখনও চুরির অভিযোগ জানায় না।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২৫ ১৭:২৮
ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় শত্রু কে? প্রতীকী ছবি।

ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় শত্রু কে? প্রতীকী ছবি।

খোকাবাবু। প্রতি শুক্কুরবার সাতসকালে প্রেক্ষাগৃহে ছোটেন বাংলা ছবি দেখতে। দাবি করেন, তিনিও নাকি ‘ইন্ডাস্ট্রি’। কলকাতা শহরের বুকে ঠিক কী করেন তিনি, কারও জানা নেই। পিছনে লোক লাগিয়েও দেখা গিয়েছে, হাতে বিশাল বড় পপকর্নের বাক্স নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে ঢোকেন, ছবি শেষ করে বেরিয়ে যান। এটুকুই। সোজা চোখে যায় না দেখা। আসলে পপকর্ন ভর্তি সেই বাক্সে ফুটো করে ক্যামেরা ফিট করেন তিনি। হুবহু তুলে নেন টাটকা নতুন ছবি। তার পরেই ছড়িয়ে দেন ইউটিউব এবং বিভিন্ন পাইরেটেড সিনেমার সাইটে। প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে টিকিট কেটে ছবি দেখার প্রয়োজন নেই। চুরি করা ছবির লিঙ্ক পেলেই হল। কেল্লাফতে!

খোকাবাবুর সংসার ভর-ভর। দু’খানা গাড়ি, দুটো বাড়ি। সিনেমা চুরি করার পর, তার স্যাঙাতরা বিভিন্ন প্রযোজনা সংস্থায় ফোন করে। চোরের মায়ের বড় গলা। তারা বলে, “আপনার নতুন ছবির পাইরেসি বাঁচাতে গেলে আমাদের টাকা দিন। নয়তো...। যত বড় নামী প্রযোজকই হন, সে দিন সকালে তাঁর মুখ ফ্যাকাসে — টাকা দিয়ে ছবি টোকা বন্ধ করতে হবে? এক প্রযোজকের কথায়, “টাকা দিয়ে যেমন পাইরেসি বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়, তেমনই বাজারে কোন ছবির কদর আছে, সেটা জেনেই তার প্রতিযোগী প্রযোজক ওই ছবি পাইরেসি করার জন্যও খোকাবাবুদের টাকা দেন। এমন ঘটনাও ভুরিভুরি আছে।” টাকা বেশি দিলে ছবির দৃশ্য থেকে শব্দের ওপর বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়। ভিডিয়োর গুণাগুণ বাড়ে। ওই ভিডিয়ো দেখেই মানুষ খুশি।

ছবিমুক্তির দিনই ছবি চুরি করে যদি অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, এককথায় তা সর্বনাশ! লোকে টিকিট কেটে ছবি দেখবে না আর, অনলাইনেই দেখে নেবে সব। ওটিটি-র জন্য অপেক্ষা করবে না। পাইরেসির মাধ্যমে ছবি দেখা হয়ে যাওয়ার ফলে, স্যাটেলাইটে ছবি বিক্রি করার ক্ষেত্রে সেই ছবির দাম কমতে থাকে। লাভের মুখ দেখাই প্রযোজকের কাছে তখন বড় ব্যাপার।

ছবি টোকার এই ঘটনা নতুন কিছু নয়, ইন্ডাস্ট্রিতে জানতে কারও বাকিও নেই। কিন্তু ঠেকায় কার সাধ্য? কারণ ইন্ডাস্ট্রির অধিকাংশ মানুষই জানেন, যে অ্যাকাউন্ট থেকে ছবির প্রথম ‘লিঙ্ক’ অনলাইনে আসে, সেই অ্যাকাউন্টের ‘আইপি অ্যাড্রেস’ বাংলাদেশের হয়। ভারতের ছবি বাংলাদেশে মুক্তি পায় না। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই মুক্তির এক-দু’দিনের মধ্যেই ভারতের বাংলা ছবি দেখে ফেলেন। কী করে পারেন? এর প্রধান কারণ ‘পাইরেসি’। বাংলা ছবির সবচেয়ে বড় শত্রু।

‘এসকে মুভিজ়’-এর তরফে প্রযোজক অশোকা ধানুকা বলেন, “বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার অনেক বেশি। ওরা ভারতীয় ছবি সবসময়ে পায় না। তার উপর আছে কিছু অর্থলোভী মানুষ। ৫-১০ হাজার টাকায় পাইরেসি করে বিক্রি করে। এ বার সেই ক্রেতা ওই ছবি ইন্টারনেটে আপলোড করে। এর মধ্যে নিষিদ্ধ বিজ্ঞাপন চালানো হয়। সেখান থেকে আয় হয়। এটা একটা র‌্যাকেটের মতো চলে।” র‍্যাকেট চলছে, চলবে। অর্থাৎ, খোকাবাবু কিছু ভুল বলেননি। টলি ইন্ডাস্ট্রির পাশাপাশি চলছে এই ছবি পাইরেসির ইন্ডাস্ট্রি। ছবি টোকা, আপলোড করা, তা ছড়িয়ে দেওয়া — প্রত্যেকটা ধাপই খুব সুনিপুণ ভাবে হয়। অনেক মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত।

কী বলছেন প্রেক্ষাগৃহের অধিকর্তারা? বিনোদিনী থিয়েটারের (সাবেক স্টার থিয়েটার) মালিক জয়দীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, “এখন ছোট ছোট ক্যামেরা সর্বত্র পাওয়া যায়। কে কখন ছবি তুলছে বোঝা যায় না। সিসিটিভি বসানো হলে, তাতেও দর্শকের গোপনীয়তা নষ্ট হয়। তাই কোনও সরকারি সংস্থা বা ফেডারেশন যদি নিয়মিতভাবে প্রেক্ষাগৃহে মনিটরিং করে, তা হলে এই সমস্যা অনেকটাই রোখা সম্ভব হবে বলে আমার মত।” ছবির ব্যবসায় মুনাফা কমলে ক্ষতিগ্রস্ত হন টেকনিশিয়ানরাও। আশা করা যায়, ফেডারেশন এই বিষয়ে নজর দেবে।

প্রেক্ষাগৃহের সব অধিকর্তা অবশ্য এই বিষয়কে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ‘পাইরেসি’র অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন ‘নবীনা’র মালিক নবীন চৌখানি। তাঁর কথায়, “আজকাল প্রেক্ষাগৃহে পাইরেসি প্রায় হয় না বললেই চলে। দর্শক এখনও প্রেক্ষাগৃহে এসে ছবি দেখছেন, তাই পাইরেসির জন্য বক্সঅফিসে তেমন প্রভাব পড়ছে না।”

নবীনবাবু তাঁর মতামত দিয়েছেন। কিন্তু এমন উদাহরণও আছে, প্রেক্ষাগৃহের কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষেই নাকি সিনেমা চুরি করা হচ্ছে। কোথায় হয়? কে করে? পরিচালক, প্রযোজক — সকলেই সব জানেন। কিন্তু মুখ খুলতে চান না। মুখ খুলবেনই বা কী করে? এক পরিচালকের কথায়, “আমি যদি জানাই, আমার ছবি পাইরেসি হচ্ছে, তা হলে সকলে সেই চুরি করা ছবির লিঙ্ক খুঁজতে শুরু করবে। প্রেক্ষাগৃহে কেউ আসবে না। আমার ছবি আরও কিছু দর্শক হারাবে।” এ ভাবেই দিনের পর দিন ইন্ডাস্ট্রির মানুষ চুপ করে আছেন।

দেখা গিয়েছে, এই কারণেই ৯৫ শতাংশ প্রযোজনা সংস্থা ‘ইম্পা’ বা প্রশাসনের কাছে কখনও চুরির অভিযোগ জানায় না। এটা যেন সেই রকম অপরাধ, যেখানে কোনও কন্যা আচমকা কোনও হিংসার শিকার হলে, তার পরিবার লোকলজ্জার ভয়ে সেই অপরাধ লুকিয়ে রাখে। পাছে কন্যার মুখ সামনে আসে। তাকে সবাই দেখে ফেলে। আর অপরাধ সামনে না এলে তার গুরুত্বও কমতে থাকে। বেড়ে চলে অপরাধের সংখ্যা। প্রযোজক রানা সরকারের বক্তব্য, “বড় ছবির ক্ষেত্রে পাইরেসির প্রভাব বেশি দেখা যায়। একবার ডিজিট্যাল কপি ছড়িয়ে পড়লে সেটা রোখা কঠিন। কোথা থেকে পাইরেসি শুরু হচ্ছে, সেটা খুঁজে বের করাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি।”

শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বাংলা ছবির বাজারকে নষ্ট করছে 'পাইরেসি'। বাংলা ছবি বিদেশে নিয়ে যাওয়া তাঁর স্বপ্ন ছিল। স্বপ্নপূরণ করতে গিয়ে আমেরিকার এক পরিবেশক বললেন, ‘‘যে জনপ্রিয় ছবিগুলো আমি প্রবাসী বাঙালিদের দেখাতে চাইছিলাম, সেগুলো তাঁরা ইতিমধ্যেই অনলাইনে দেখে ফেলেছেন। পাইরেসির জন্যই বাংলা ছবি বিদেশের বাজার হারাচ্ছে।’’

এখানেই শেষ নয়। বাংলা ছবির অপর এক পরিবেশক বলছিলেন, “সরকারি প্রেক্ষাগ়ৃহে ছবি প্রদর্শনের জন্য ডিভিডি-তে নতুন ছবি পাঠাতে হয়। ডিভিডি থেকে তো যে কোনও মুহূর্তেই ছবি টুকে নেওয়া যায়। কী ভয়ঙ্কর বলুন তো!” শুধু সরকারি প্রেক্ষাগৃহই নয়, সেন্সর বোর্ডেও আনকোরা ছবি ডিভিডি-তে পাঠাতে হয়। এমনটাই চল। কিন্তু এখন তো নির্দিষ্ট ‘পাসওয়ার্ড’-এর মাধ্যমে ছবির লিঙ্ক অনলাইনে অনায়াসে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। সেই পদ্ধতি এখনও কেন চালু হল না? এই প্রশ্ন বার বার উঠে আসুক। এতে অন্তত ছবি চুরি হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমবে।

এক প্রযোজক মজার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন। তিনি জানালেন, অনেক দিন আগে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন নিজের নতুন ছবির প্রদর্শনের জন্য। বাংলাদেশের নাটক কিনবেন বলে বাজারে গেলে তাঁকে বাংলাদেশের সবচেয়ে চর্চিত ছবি বলে যে সিডি দেওয়া হয়, সেটা তাঁরই সদ্য মুক্তি পাওয়া ওই ছবির টোকা সংস্করণ।

পাইরেসি প্রসঙ্গে ‘ইম্পা’ এবং ‘স্ক্রিনিং কমিটি’র সভাপতি পিয়া সেনগুপ্তের দাবি, “পাইরেসি নিয়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে, আরও হবে। বড় প্রযোজনা সংস্থাগুলির কাছ থেকে অভিযোগ আসছে, পাইরেসির কারণে তাঁদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।”

ধরা পড়ছে না চোর। বন্ধ হচ্ছে না চুরি। বাংলা ছবির পাশে থাকা নয়, বাংলা ছবির চোর ধরাই এখন সবচেয়ে বড় কাজ।

Tollywood
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy