শেষ কবে ঘুরতে গিয়েছিলেন?
ওহ্, কাজের চাপে যেতেই পারেননি! ট্যুর প্ল্যান করেও ক্যান্সেল করেছিলেন?
ছাড়ুন তো...
ফেসবুকের ট্যুর গ্রুপ আছে না? জয়েন করে প্ল্যান করে নিন পরবর্তী ট্যুর। ঘোরার নেশায় আজকাল তো এখানেই দল বাঁধছেন অনেকে।
না, এঁরা কোনও পূর্বপরিচিত ঘুরতে বেড়ানোর দল নয়। বন্ধুর বন্ধু, তার বন্ধুও নয়। এঁরা যে যার স্মার্টফোন বা ওয়েবদুনিয়ার সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের চৌহদ্দিতে ঘুরে বেড়ানো একদল মানুষ। ওঁদের একটাই নেশা। বেড়ানো।
আর তার টানেই জমে ওঠে আড্ডা। ভার্চুয়াল জগতের চৌহদ্দি ভেঙে যার যার মতো করে নিজেদের চিনে নেওয়া। কিন্তু ঘুরে বেড়ানোর নেশা পেরিয়ে শেষমেশ আড্ডাটাই কি আসল হয়ে উঠল? এমনই এক গ্রুপের অ্যাডমিন স্বপ্নময় পাল কিছুটা একমত। পেশায় হাইস্কুল টিচার স্বপ্নময়বাবু বললেন, ‘‘আমরা যখন ২০১৩-তে এই গ্রুপটা বানিয়েছিলাম, তখন একটা কথাই মাথায় ছিল। অনেকেই নানা কারণে বেড়াতে যেতে পারেন না। তাঁরা যেন ঘরে বসেও ঘুরে বেড়ানোর স্বাদটা পান। বেড়ানো নিয়ে যাবতীয় তথ্য দেওয়া, ছবি আপলোড করা তাই ইম্পর্ট্যান্ট ছিল তখন।’’
দলের আর এক অ্যাডমিন চন্দন সেনগুপ্ত অবসরপ্রাপ্ত ফার্মেসি এক্সিকিউটিভ। আমুদে প্রকৃতির চন্দনবাবু আড্ডা মারতে মারতে বললেন, ‘‘আমি রিটায়ারমেন্টের পর একটা জায়গা খুঁজছিলাম। নিজেকে এনগেজড রাখার। এখন দারুণ সময় কাটছে। এটাই এখন আমার নতুন চাকরি।’’
কিন্তু হঠাৎ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটই কেন?
স্বপ্নময়বাবুর মতে, নিখরচায়, প্রচুর লোককে এক ছাদের নীচে নিয়ে আসার এত ভাল প্ল্যাটফর্ম আর হতেই পারে না। ‘‘এই তিন বছরেই আমাদের গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১২৫০০ ছাড়িয়েছে। দেশ জুড়ে আমাদের মেম্বার। নিয়মিত আড্ডা হয়। কে কোথায় বেড়িয়ে এলেন সেই তথ্য শেয়ার করেন গ্রুপ সাইটে।’’ তবে নতুন করে গ্রুপে সদস্য বাড়াতে নারাজ এই তিন গ্রুপ অ্যাডমিন। বলেন, ‘‘আমরা নিয়মিত গ্রুপ আপডেটস চেক করি। কোনও কনটেন্ট আপত্তিকর হলে তা সঙ্গে সঙ্গে ডিলিট করা হয়। কিছু দিন ধরেই আজেবাজে কমেন্ট পোস্ট করছিলেন কিছু সদস্য। এখন তাই ভাল করে দেখেশুনে মেম্বার নেব ভেবেছি।’’
আর গ্রুপ সদস্যরা?
বছর পঞ্চাশের শুভ্রা ঘোষ, মেঘমালা দে বা মঞ্জুলা ঘোষ-রা যেমন আছেন, তেমনই আছেন তিরিশের এদিক-ওদিক সৈকত গুপ্ত, সুপ্রতিম মুখোপাধ্যায়, সুরূপা-শুভ্র ভট্টাচার্যরা। ‘‘সবাই প্রচুর ইনপুট দেন। প্রচুর উৎসাহ নিয়ে অর্গানাইজ করেন প্রতিটা ইভেন্ট। খাবারের অ্যারেঞ্জমেন্ট কী হবে তা-ও,’’ জানান আর এক গ্রুপ অ্যাডমিন পেশায় ব্যবসায়ী তন্ময় ভট্টাচার্য।
মুখোমুখি আড্ডার ভাবনাটাও কি তখনই মাথায় এসেছিল?
‘‘আমরা অনলাইন ফোরামেই আড্ডা দিতাম। বেড়ানোর প্ল্যানিং করতাম। কিন্তু গ্রুপ সদস্যরা অনেকে দাবি তুললেন তাঁরা মুখোমুখি আসতে চান। প্রথম বিজয়া সম্মিলনীটাও সে ভাবেই হয়। আর এখন তো প্রায় প্রায়ই আড্ডা চলছে,’’ বলেন স্বপ্নময়।
বেড়ানোর পাশাপাশি এই আড্ডায় এসে অনেক নিঃসঙ্গ মানুষই খুঁজে পেয়েছেন মনের মতো বন্ধু। এঁদের কারও একমাত্র সন্তানের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কেউ বা আবার বাড়িতে অনেকের ভিড়ে নিঃসঙ্গ। কেউ আবার এতটাই অসুস্থ যে ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া বাইরে বেরনো মানা।
অসুস্থতার এ রকমই এক সাঙ্ঘাতিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল আর এক গ্রুপ অ্যাডমিন সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের। কিছু গ্রুপ সদস্যকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলেন হিমাচল প্রদেশের বেশ কিছু জায়গা। ‘‘টিমের এক দিদি হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওঁর পরিবারের লোকেরা তো ওঁকে প্রায় নিয়েই যান। পরে ওঁরাই বললেন উনি এতটা অসুস্থ তা কাউকে জানান না। যদি বাদ দেওয়া হয় ওঁকে। কারও কথা না শুনেই বেরিয়ে পড়েন ঘুরতে,’’ জানান সৌরভ।
এত আড্ডা, এত রোশনাইয়ের মধ্যে অন্ধকার কি কিছুই নেই?
গ্রুপ সদস্য মেঘমালা দে-র খুব খারাপ লেগেছিল গ্রুপ থেকে এক জনপ্রিয় সদস্যকে বের করে দেওয়ায়। বললেন, ‘‘দেখুন, মতামতের হেরফের তো হতেই পারে। তা বলে ওয়েল-ইনফর্মড একজন লোককে নিজেদের রেষারেষির জন্য বের করে দেওয়ার তো কোনও মানে নেই।’’ অনেকেই আবার কথায় কথায় জানান খরচ নিয়েও ঝামেলা নেহাত কম নয়। অল্পবয়সিদের মদ্যপানের হুজুগে বিকেলের স্ন্যাক্সের ফিশফ্রাইয়ে টান পড়ে মাঝেমধ্যেই। ফেসবুক পোস্টে আপত্তিকর কমেন্টস নিয়ে ঝুটঝামেলা কম হয় না।
যাই হোক না কেন, হাতের স্মার্টফোনে এঁদের লগড ইন থাকার বিরাম হয় না। ছাঙ্গু লেক-এর বরফটা গলল কি না, সিল্ক রুটে ঠিক কতটা ঠান্ডা, সেই খবর নেওয়ার পাশাপাশি জিজ্ঞেস করা হয়ে যায় দুপুরের মেনুতে কযা মাংস, না ইলিশের ঝোল। পরের গেট টুগেদারে কে কী পরছে। ইলিশ উৎসবটা কারও বাড়িতে হচ্ছে, না ডে-ট্যুরে বেরিয়ে। ফোরামে আড্ডা চলে। আর সাইটে আপলোড হতে থাকে সদ্য বেড়িয়ে আসার ছবি। সঙ্গে পোস্টে কে কী কমেন্ট করল তা নিয়ে টকঝাল গবেষণা।
বেড়ানোর আড্ডার ফেসবুক গেটওয়ে। মন্দ নয়! বলুন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy