Advertisement
E-Paper

আপন দুই ভাইয়ের মতোই অদ্ভুত মিল আমাদের, স্ত্রী থাকতেই দাদার মতো আমার জীবনেও দ্বিতীয় নারী এসেছে!

চুমু আর চিংড়িমাছ— আমাদের দুই ভাইয়ের কী যে পছন্দ! বাড়িতে অনুষ্ঠান মানেই চিংড়ি মাছের পদ। প্রিয়জনদের মুখোমুখি হলেই আমরা তাঁদের গালে, কপালে চুমু খেতাম।

বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৪:১৫
উত্তমকুমারের জন্মদিনে লিখলেন বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়।

উত্তমকুমারের জন্মদিনে লিখলেন বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায় আর বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়। পর্দায় আমরা ‘দুই ভাই’, বাস্তবেও। কাকতালীয় ভাবে পদবিও মিলে গিয়েছে। সেই সময় বলা হত, উত্তমদার দুই ভাই। ভাগ্য যেন আমাদের অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে দিয়েছিল। নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থ থেকে খাওয়াদাওয়া, এমনকি জীবনসঙ্গিনী—এখানেও অদৃষ্ট আমাদের মিলিয়ে দিয়েছে। দাদা ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন ধনী পরিবারের মেয়ে গৌরীদেবীকে। আমি যেমন রত্নাকে। তার পরেও আমাদের জীবনে দ্বিতীয় নারী এসেছেন। উত্তমকুমারের সুপ্রিয়া চৌধুরী। আমার দ্বিতীয় স্ত্রী ইরা চট্টোপাধ্যায়।

‘বুড়ো’ বা তরুণকুমার, ‘বিশু’ বা বিশ্বজিৎ। দাদার বাড়ির সব অনুষ্ঠানে আমার অবারিত দ্বার। পারিবারিক অনুষ্ঠান, পার্টি— কোথায় থাকতাম না? দাদা না পারলেও আমাদের বাড়ির অনুষ্ঠানে গৌরীবৌদিকে পাঠিয়ে দিলেন। আমার ছেলে প্রসেনজিতের পাঁচ বছরে পৈতে দিয়েছিলাম। বৌদি ওই দিন এসেছিলেন। বুম্বার পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিলেন। আমরা হাঁ হাঁ করে উঠতেই বলেছিলেন, “বুম্বা ব্রাহ্মণ হল। পা ছুঁয়ে ওর আশীর্বাদ নেব না?”

একদিনে কিন্তু দাদা-ভাইয়ের এই সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। আমাদের এই সম্পর্কের অনুঘটক এমকেজি প্রোডাকশনের কর্ণধার বিমল ঘোষ। ১৪-১৫টি ফ্লপ ছবির পর উত্তমদা তখন ইন্ডাস্ট্রিতে ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ বা ‘এফএমজি’। দাদা চুপচাপ সহ্য করতেন। মাথা নিচু করে বাসে করে যাতায়াত করতেন। স্টুডিয়োচত্বরেও মাথা তুলে চলার মতো অবস্থা ছিল না তাঁর। এরকম সময়ে ঠিক হল ‘বসু পরিবার’ ছবি হবে, পরিচালক নির্মল দে। উত্তমদার নাম উঠতেই সকলে বেঁকে বসলেন, কিছুতেই তাঁকে নেওয়া হবে না। সেই সময় বিমল ঘোষ একমাত্র ওঁর হয়ে বলেছিলেন। অনুরোধ জানিয়েছিলেন, দাদাকে সুযোগ দেওয়া হোক। ভাগ্যিস বলেছিলেন! এই ছবি উত্তমকুমারের ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ তকমা মুছে দিয়েছিল। একই ভাবে বিমলদার ‘কংস’ ছবিতে অভিনয়ের পর উনি ‘মায়ামৃগ’ ছবিতে আমায় নায়ক হিসাবে নেওয়ার জন্য পরিচালক চিত্ত বসুকে বললেন। উত্তমদা তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। উত্তমদাকেও নিলেন বিমলদা এবং নেওয়ার আগে জানিয়েছিলেন, আমি তাঁর ছবির নায়ক। শুনেছি, দাদা এককথায় রাজি। বলেছিলেন, “বিশু নায়ক হলে আমি পার্শ্বচরিত্র হতেও রাজি!” ছবিতে সেই রকম একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি।

তখনই টের পেয়েছিলাম, দাদা আমায় পছন্দ করেন, ভরসাও করেন। এর পর অনেক ছবি করেছি। ‘দুই ভাই’, ‘গড় নাসিমপুর’, ‘রক্ততিলক’, ‘চৌরঙ্গী’। এর মধ্যে তৃতীয় ছবিটি আমার পরিচালনা-প্রযোজনায় তৈরি।

বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে স্নেহচুম্বনে ‘বাঁ দিকে’ সুপ্রিয়া চৌধুরী, উত্তমকুমার (ডান দিকে)।

বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে স্নেহচুম্বনে ‘বাঁ দিকে’ সুপ্রিয়া চৌধুরী, উত্তমকুমার (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।

তখন নকশাল আমল। দাদা স্টুডিয়োয় বসে মেকআপ নিচ্ছেন। হঠাৎ একদল অজ্ঞাতপরিচয় ঢুকে পড়ে বন্দুকের নল ঠেকাল উত্তমকুমারের বুকে! দাদা ভয়ে কাঁপছেন। মুখচোখ সাদা কাগজের মতো। কোনওমতে তাদের হাত থেকে রেহাই মিলতেই সুপ্রিয়া ওঁকে নিয়ে সোজা মুম্বই পালিয়ে এসেছিল। উঠেছিল আমার বাড়িতে। আমি বাড়িতে উপরতলায় বসে। দেখি, সিঁড়ি বেয়ে কারা যেন উঠে আসছেন! ভাল করে দেখে বুঝলাম বেণু। সঙ্গের পুরুষটি কে? বেণুই ব্যাপার বুঝে বলল, “কী রে, দাদাকে চিনতে পারছিস না?” মাথার চুলে কদমছাঁট। নিজেকে লুকোতে দাদা সাধের ‘ইউকে’ ছাঁটে কাঁচি চালিয়েছিলেন। একটু ধাতস্থ হয়ে একরাশ অভিমান উগরে দিয়েছিলেন, “ইন্ডাস্ট্রিতে উত্তমকুমারের বুকে বাইরের ছেলেরা এসে বন্দুক ঠেকাল! সবাই চুপ করে দেখল। কেউ কিচ্ছু বলল না রে বিশু। এই ইন্ডাস্ট্রির জন্য আমি কী না করেছি!”

ব্যক্তিগত জীবনেও আমাদের প্রচুর মিল। দাদা সত্যিই সুপুরুষ। অনেকে আমাকেও সেই তকমা দিতেন। আমাদের ঘিরে মহিলা অনুরাগীদের সারা ক্ষণ ভিড়। আমি হাসিমুখে সামলে নিতে পারলেও দাদা কিন্তু খুবই অস্বস্তিতে ভুগতেন! আসলে, আমি যতটা খোলামেলা দাদা ততটাও নন। যথেষ্ট গম্ভীর প্রকৃতির, মেপে কথা বলতেন। খুব বেছে মিশতেন। তার পরেও ওঁর মেকআপ রুমে মেয়েদের লম্বা লাইন! একদিন হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি এত কম কথা বলো। তার পরেও তোমার ঘরে কেন সারা ক্ষণ মহিলাদের আনাগোনা? শুনে দাদার মুখের অবস্থা দেখার মতো। প্রচণ্ড অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলেন। আমতা আমতা করে বলেছিলেন, “দ্যাখ না, যত এড়িয়ে যেতে চাই, ততই ওরা যেন ছেঁকে ধরে! কিছুতেই সরাতে পারি না। কী করি বল তো বিশু?”

সে দিন দাদার অবস্থা দেখে খুব মজা পেয়েছিলাম। নিজের চোখে দেখেছি, উত্তমকুমার নারীঘেঁষা নন। মেয়েরা বরং ওঁকে দেখলে নিজেদের সামলাতে পারতেন না। ওঁর উপরে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো অবস্থা। দাদা বেচারা কী করেন?

খাওয়াদাওয়াতেও আমাদের দাদা-ভাইয়ের জিভের স্বাদ এক। মাগুর মাছের ঝোল, সর্ষে ইলিশ, ভেটকি মাছের কাঁটাচচ্চড়ি, চিংড়ি মাছের পদ রান্না হলে হাত চেটে খেতাম। বেণু মানে সুপ্রিয়া চৌধুরী, ওর দিদি বাচ্চুদি দুর্দান্ত রাঁধত। বাংলাদেশের মেয়েদের হাতে যেন জাদু। যে দিন ভালমন্দ রান্না করত ওরা, আমার ডাক পড়ত। আরও কেউ কেউ থাকতেন হয়তো। গান-বাজনা, খানা-পিনায় রাতভোর! আরও একটা জিনিস আমাদের খুব প্রিয়, চুমু! হ্যাঁ, আমাদের প্রিয়জনদের আমরা চুমু খেতাম। বয়স বুঝে কারও কপালে, কারও গালে। দাদা ওই জন্য রসিকতা করে বলতেন, চিংড়ি আর চুমু দুটোই তাঁর খুব প্রিয়।

এ বছর দাদার ৯৯ বছর। আগামী বারে শতবর্ষ পূর্ণ করবেন। লাভ ইউ দাদা। আমি তো জানি, তুমি কোনও দিন বিস্মৃত হবে না। যেখানে আছ সেখানেও নিশ্চয়ই তোমায় ঘিরে গুণীজনের ভিড়! সকলের মধ্যমণি হয়ে বসে তুমি। চোখ-মুখ চুঁইয়ে হাজার ওয়াটের হাসি ছড়িয়ে পড়েছে। তুমি এ ভাবেই ভাল থেকো।

Uttam Kumar Biswajit Chatterjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy