Advertisement
E-Paper

ওসি বাস্তবে এসি-কে শবরদা বলবেন না

গত শনিবার ১০০ দিন পেরোল ‘এবার শবর’। কিন্তু লালবাজারের ‘শবর দাশগুপ্ত’রা পরের ছবিতে চাইছেন আর একটু বিশ্বাসযোগ্যতা। লিখছেন সুরবেক বিশ্বাসগত শনিবার ১০০ দিন পেরোল ‘এবার শবর’। কিন্তু লালবাজারের ‘শবর দাশগুপ্ত’রা পরের ছবিতে চাইছেন আর একটু বিশ্বাসযোগ্যতা। লিখছেন সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০১

বালিগঞ্জ প্লেসে মিতালি ঘোষ খুন হওয়ার পর দু’-এক দিন কেটে গিয়েছে। লালবাজারের ডিডি বিল্ডিং থেকে চিন্তিত মুখে বেরোলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার শবর দাশগুপ্ত। কয়েক মুহূর্ত পরেই হন্তদন্ত হয়ে তাঁর সহকারী। তখন দিনদুপুর। দৃশ্যটা দেখেই এক গোয়েন্দা অফিসার হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘‘এ-ই তো আমাদের বিল্ডিং। কিন্তু ২৪x৭ এক জন গেটম্যান থাকেন। তিনি কোথায়?’’

ডিডি বিল্ডিংয়ের কোনাকুনি উল্টো দিকে লালবাজারের মেন বিল্ডিং, যার দোতলায় পুলিশ কমিশনার ও অন্য শীর্ষকর্তাদের অফিস। ওই বাড়ির গাড়িবারান্দাকে বলা হয় ‘সিপি’জ পোর্টিকো’। কমিশনার লালবাজারে থাকলে তাঁর গাড়ি ওখানে দাঁড় করানো থাকে। ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে তদন্তের ব্যাপারে আলোচনা করছিলেন শবর ও তাঁর সহকারী। তিন দশক লালবাজারে চাকরি করা এক অফিসারের বক্তব্য, ‘‘সিপি-র পোর্টিকো দিয়ে আমরা অনেক সময়ে যাতায়াত করি, কিন্তু ওখানে দাঁড়িয়ে তদন্ত নিয়ে আলোচনা? পাগল নাকি!’’

শবর দাশগুপ্ত গোয়েন্দা বিভাগের এক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। অথচ ছবিতে তাঁর অফিস এক বারের জন্যও কেন দেখানো হল না, সেটা নিয়েও প্রশ্ন বাস্তবের শবরদের।

আবার অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার শবর দাশগুপ্ত যখন নিহত মিতালি ঘোষের বাড়ির ‘খিদমতগার’ হরেনের মাথায় নাটকীয় ভাবে নাইন এমএম পিস্তল ঠেকিয়ে মিতালির বাবার অবৈধ সম্পর্ক ও এক পুত্রসন্তান থাকার কথা বার করে নেন, মুচকি হাসি খেলে যায় লালবাজারের গোয়েন্দাদের মুখে। কারণ, ওটা চিত্রায়িত হয়েছে গঙ্গার ঘাটে, প্রকাশ্য দিবালোকে।

বাস্তবের গোয়েন্দাদের বক্তব্য, অনেক ক্ষেত্রেই কাউকে জেরা করা হয় লালবাজার কিংবা কোনও থানার বাইরে। মাথায় ওই ভাবে বন্দুক ঠেকিয়ে ভয় দেখানোও জরুরি হয়ে পড়ে। ‘‘তা বলে দিনের বেলায় খোলা জায়গায় কখনও নয়। এই সব ক্ষেত্রে আমরা কোনও ঘেরাটোপে নিয়ে যাই। যেখানে সাধারণ লোক ঢুকতে পারবে না’’, বললেন আর এক অফিসার। তাঁর কথায়, ‘‘গোটা ছবিতে শবর দাশগুপ্ত ও তাঁর সহকারী কখনও ট্যাক্সিতে, কখনও টানা রিকশায়, এমনকী ট্রামে চড়ে তদন্ত করলেন। গোয়েন্দা বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনররা তো বটেই, ইন্সপেক্টররাও অন ডিউটি আলাদা গাড়ি পান। শবর দাশগুপ্ত কিন্তু ফেলুদা বা ব্যোমকেশের মতো প্রাইভেট ডিটেকটিভ নন!’’

ছবিতে শবর দাশগুপ্তের চরিত্রে যেমন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, তেমন তাঁর সহকারী নন্দর চরিত্রে অভিনয় করেছেন শুভ্রজিৎ দত্ত। খুনের খবর পেয়ে নন্দকে নিয়ে শবর দাশগুপ্ত মিতালি ঘোষদের বাড়িতে পৌঁছলে স্থানীয় থানার ওসি তাঁকে ‘শবরদা’ বলে সম্বোধন করেন। দৃশ্য দেখে দু’জন অফিসারের সহাস্য মন্তব্য, ‘‘এক জন এসি-কে থানার ওসি দাদা বলে ডাকছেন! বাস্তবে হয় না। এসি-কে ওসি অবশ্যই স্যর বলবেন। এটাই বাহিনীর দস্তুর।’’ তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘খুনের পর শবর ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নিয়ে এক বারও অটোপসি সার্জেন-এর সঙ্গে আলোচনা করলেন না?’’

আলোড়ন ফেলা বহু খুনের কিনারা করেছেন, এমন এক অফিসারের বক্তব্য, মিতালি খুনের ‘প্লেস অফ অকারেন্স’ বা অকুস্থলে যতটা রক্ত, যে ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে, সেটা বাস্তবসম্মত নয়। তাঁর কথায়, ‘‘ছবির শেষে মিতালির খুনি বলবে, সে এক বার-দু’বার নয়, ছ’-ছ’বার মিতালির শরীরে ছোরা দিয়ে আঘাত করেছে। প্রতি বারই খুনি মিতালির পেটের আশপাশে ছোরা ঢুকিয়েছে আর বার করেছে।’’ ওই দুঁদে গোয়েন্দা বলেন, ‘‘এমন ভাবে ছোরা মারলে রক্তে ঘর ভেসে যাওয়ার কথা। কারণ, যকৃৎ, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড ক্ষতবিক্ষত হবে। ওই তিনটি অঙ্গ থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হবে এবং ঘরের চার দিকে ছিটকে ছিটকে রক্ত পড়বে। সে সব কোথায়? মনে হচ্ছে, কেউ যেন মৃতদেহের গায়ে, মেঝেতে কিছু রক্ত মাখিয়ে দিয়েছে!’’ পোড় খাওয়া অফিসারের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ‘‘মিতালির মৃতদেহ শবর ঝুঁকে দেখার আগেই তাঁর বাঁ হাতের কনুইয়ের কাছে রক্তের দাগ এল কী করে?’’

গোয়েন্দা বিভাগের আর এক অফিসার মনে করেন, এ দিকে নজর দেওয়া হয়নি বলেই পুদুচেরিতে ব্যর্থ প্রেমিক জর্জ-এর আত্মহত্যা করার ঘটনাটি অন্তত মৃতদেহ দেখে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। ওই অফিসার বলেন, ‘‘ছবিতে বলা হয়েছে, ওই যুবক পিস্তল থেকে মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। মাথার বাঁ দিকে একটি ক্ষত রয়েছে। কিন্তু গুলি ঢোকার জায়গা অত বড় হয় না। অনেকটা রক্তও বেরোনোর কথা। সেটাও ছবিতে নেই।’’ গোয়েন্দার কথায়, ‘‘মাথার বাঁ দিকে গুলির ক্ষত মানে যুবক বাঁ হাতে বন্দুক ধরে গুলি করেছেন। গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে বাঁ হাত ঝুলে পড়ার কথা। ছবিতে যুবকের দু’হাত দু’দিকে অনেকটা ছড়ানো। যেন কেউ খুন করে ওখানে ফেলে দিয়ে গিয়েছে। সুইসাইডের ব্যাপারটা ঠিক জমছে না।’’

বাস্তবের শবররা জানাচ্ছেন, লালবাজারের এক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার নিজে অত ছোটাছুটি করে অপরাধী ধরেন না। তাঁর নির্দেশ মতো সাব-ইন্সপেক্টর, কনস্টেবলেরা ওই ধরনের কাজ করেন। ‘‘তবে শবরই যেহেতু ছবির নামভূমিকায়, এটায় কোনও অসুবিধে নেই। বিশেষ করে ‘সরফরোশ’-এ আমির খান যেখানে এসিপি রাঠৌরের ভূমিকায় অনেক আগেই এমনটাই করেছিলেন,’’ বলছেন গোয়েন্দা অফিসারেরা।

কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা এটাও জানাচ্ছেন, ‘‘ছবিতে শবর দাশগুপ্ত যে ভাবে খুনি পর্যন্ত পৌঁছন, তাতে কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতার এত টুকুও অভাব নেই।’’ তাঁদের মতে, ‘‘একটার পর একটা ধাপ অতিক্রম করেই তিনি রহস্য ভেদ করেছেন। ছবিটা টান টান। শুধু লালবাজারের অফিসার বলেই পুরো ব্যাপারটা আর একটু বাস্তবসম্মত করতে পারলে ভাল হয়। শবরের পরের ছবিতে!’’

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘ঋণ’ উপন্যাস অবলম্বনে ছবিটা করেছেন যিনি, সেই পরিচালক অরিন্দম শীল জানাচ্ছেন, শ্যুটিংয়ের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হয়েছিল। লালবাজারের ডিডি বিল্ডিংয়ের ভিতরে শ্যুট করতে দেওয়া হয়নি। সেই জন্যই দেখানো যায়নি এসি-র অফিস। সেই সঙ্গে অরিন্দম বলছেন, ‘‘কিছুটা স্বাধীনতা ছবির স্বার্থে নিতেই হয়েছে। শবর দাশগুপ্ত তো শুধু গোয়েন্দা পুলিশের অফিসার নন, তিনি ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রও। তিনিই হিরো।’’ অরিন্দম অবশ্য মেনে নিচ্ছেন, ‘‘সরকারি গোয়েন্দা হিসেবে শবরকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা প্রয়োজন। পরের ছবির আগে এই ব্যাপারে আমি লালবাজারের শবরদের সঙ্গে কথা বলব, শিখব, বুঝব। আপাতত বলি, পরের ছবিতে শবরের একটা গাড়ি থাকছে।’’

Arindam Sil Ebar Shabor Lalbazar Surabek Biswas police kolkata detective saswata chattopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy