Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বাঙালি গড়নে বিশ্বমানের ছবি

ইন্সটাগ্রামের আঠাওয়ালা চোখে স্লো? ধৈর্য ধরলে কিন্তু আবিষ্ট হতে হবে। ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ দেখে এলেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়উড়ুক্কু গতি নেই। প্লটের মারপ্যাঁচ নেই। প্যাকেজিংয়ের কেরামতি নেই। সংলাপের চটক তো দূর, ছবিতে সংলাপই নেই। কী আছে তবে? মাছের কাঁটা। বাসের টিকিট। বাপুজি কেক। লাল মেঝেতে ভেজা পায়ের দাগ… পশ্চিমবঙ্গে বসে বিশ্ব সিনেমা সম্পর্কে আগ্রহ যাঁরা পোষণ করেন, তাঁরা অনেক দিন পর উত্তেজিত। সদ্য তিরিশ পেরনো যুবকের নিজের পয়সায় বানানো একটি ছবিকে ঘিরে।

‘আসা যাওয়ার মাঝে’

‘আসা যাওয়ার মাঝে’

শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

উড়ুক্কু গতি নেই। প্লটের মারপ্যাঁচ নেই। প্যাকেজিংয়ের কেরামতি নেই। সংলাপের চটক তো দূর, ছবিতে সংলাপই নেই।

কী আছে তবে? মাছের কাঁটা। বাসের টিকিট। বাপুজি কেক। লাল মেঝেতে ভেজা পায়ের দাগ…

পশ্চিমবঙ্গে বসে বিশ্ব সিনেমা সম্পর্কে আগ্রহ যাঁরা পোষণ করেন, তাঁরা অনেক দিন পর উত্তেজিত। সদ্য তিরিশ পেরনো যুবকের নিজের পয়সায় বানানো একটি ছবিকে ঘিরে। ২৬ জুন মুক্তি পাচ্ছে আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত-র ‘আসা যাওয়ার মাঝে’।

ছবিটির কথা প্রথম শোনা গিয়েছিল গত সেপ্টেম্বরে। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের ‘ভেনিস ডেজ’ বিভাগে পুরস্কার জয়ের সুবাদে। ঔৎসুক্য তৈরি হতে তাই দেরি হয়নি। কিন্তু ঢাকঢোল পেটানো প্রচার ছিল না, বড় ব্যানার ছিল না। নবীন পরিচালকের ছবি আদৌ মুক্তি পাবে কবে, জানা ছিল না সেটাও। এর মধ্যে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি দেখে ফেলেন অনেকে। তার পরেই মুখে মুখে ছড়াতে থাকে, বহু কাল বাদে একটা বিশ্বমানের বাংলা ছবি দেখা গেল। যার গড়নটি আদ্যন্ত বাঙালি।

এ বার কলকাতায় মুক্তির পালা। বড় পরিবেশকের দ্বারস্থ হওয়ার মতো পয়সা ছিল না। সুতরাং আদিত্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে অল্প কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি দেখানোর ব্যবস্থা করেছেন। পাশে পেয়েছেন চিত্রপরিচালক সুমন ঘোষকে। তিনি আগ্রহ করে ছবিটি প্রেজেন্ট করার দায়িত্ব নিয়েছেন। টানাটানির সংসার নিয়ে আক্ষেপ নেই। বরং আদিত্যর মনে হয়, প্রাচুর্যের দেখনদারি তাঁর ছবির মেজাজের সঙ্গে খাপ খায় না মোটেই। যাঁর ছবির ভাষা এত অনুচ্চকিত, যে ছবির সৌন্দর্য এত মেকআপহীন, সে ছবির বিপণনই বা চিৎকৃত হবে কেন?

ইতালো কালভিনোর একটা চার পাতার গল্প। অ্যাডভেঞ্চার্স অব আ ম্যারেড কাপল। ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ সেই গল্পের ছায়ায় তৈরি। গল্পের প্রেক্ষিত ছিল পঞ্চাশের দশকের যুদ্ধবিধ্বস্ত ইতালি। আদিত্যর ছবি একুশ শতকের কলকাতা। মন্দার প্রকোপে হাজারো মানুষের কর্মহীনতার কথা জানান দেয় টিভির খবর। পথসভার মাইকে আত্মঘাতী শ্রমিকের আখ্যান। এই সবের মাঝে ঘুপচি গলিতে ঋত্বিক আর বাসবদত্তার সংসার। অভিনেতাদের নামই বলতে হল। কারণ চরিত্রদের নাম জানা যায় না ছবিতে। দু’টি মানুষ, ভাগ্যক্রমে যাদের চাকরি এখনও বহাল। সংসার পেতেছে দু’জনে। কিন্তু ভালবাসার যৌথ অবসরটুকু তাদের হাতে নেই।

স্ত্রীর মেলে যাওয়া শাড়ি-সায়ার পাশে পাজামা-পাঞ্জাবি শুকোতে দেয় স্বামী। ও-ই যেন পাশাপাশি থাকা। ঠাকুরের আসনে এর জ্বেলে যাওয়া ধূপে শেষ গন্ধটুকু ওর নাকে এসে লাগে। ও-ই যেন ভালবাসার ঘ্রাণ। জানলার পাশে রেখে যাওয়া চাবি, বালতিতে সাবান ভেজানো জামাকাপড়— ও-ই যেন স্পর্শের বিনিময়। মুখের কথা ছাড়া, আবেগের প্রত্যক্ষ প্রকাশ ছাড়া, শুধু ব্যবহারিকতা দিয়ে একটা অভিনয় কত কী বলতে পারে, সেটা এই ছবিতে ঋত্বিক চক্রবর্তীকে দেখলে বোঝা যাবে। মনে রয়ে যাবে বাসবদত্তা চট্টোপাধ্যায়ের স্নিগ্ধ লাবণ্য।

আদিত্যর ছবি সেই আটপৌরে মধ্যবিত্ততার কাহিনি, হালের বাংলা ছবিতে যা প্রায় ব্রাত্য। বাসবদত্তা একটি ব্যাগের কারখানায় সুপারভাইজার। ঋত্বিকের কাজ রাতে, কাগজের প্রেসে। সকাল থেকে সন্ধে খাঁ খাঁ ঘরে ঋত্বিক একা। সন্ধের পর একলাটি বাসবদত্তা। সংলাপের সুযোগ কই? ছাল-ওঠা মোবাইল অ্যালার্ম দেওয়ার কাজে লাগে। আর ঘর ভর্তি নীরবতাকে বাঙ্ময় করে রাখে পাড়ার ইস্কুলে ছেলেদের কবিতা পড়া, পাশের বাড়িতে কচি গলার গান প্র্যাকটিস, ফিরিওয়ালার হাঁক, টিভির আওয়াজ, ঘড়ঘড়ে পাখা, সন্ধের শাঁখ, ঘরকন্নার খুটখাট...। সেরা সাউন্ড ডিজাইনের জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন অনীশ জন। আদিত্যর ছবি নিঃসাড়ে কান পেতে থেকেছে। খুলে রেখেছে চোখ। ক্যামেরা ততটুকুই নড়ে, যতটুকু না নড়লে নয়। যত্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে নির্নিমিখ। বাংলা ছবি এ রকম চুপটি করে বসে খুঁটিনাটি লক্ষ করতে ভুলে গিয়েছিল অনেক কাল। ইনস্টাগ্রামের আঠা জড়ানো চোখে মনে হতে পারে ‘স্লো’। কিন্তু ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে একটু একটু করে গা ভেজানোর ধৈর্য থাকলে এই মৃদুমন্দ লিরিসিজমই আবিষ্ট করবে।

যেমন করেছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর শর্মিলা ঠাকুরকে। স্বতঃস্ফূর্ত মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন দু’জনেই। সৌমিত্র ক’দিন আগেও বলতেন, এমন কাউকে দেখি না যাকে দেখে মনে হয় একটা ‘পথের পাঁচালী’ বানালেও বানাতে পারে। আজ তিনিই বলছেন, ‘‘আমরা প্রথম যখন কাজ শুরু করেছিলাম তখন সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালরা যে রকম রাস্তায় নেমে নাড়ির স্পন্দনগুলো ধরতেন বাঙালির, এ ছবিটা সে রকম করে তৈরি...।’’

অথচ ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ কিন্তু অতীতের ছবি নয় মোটেই। ‘লিখিও, উহা ফিরৎ চাহো কিনা’ যেমন উনিশ শতকের কবিতা নয়, আদিত্যর ছবিও ষাটের দশকের নয়। স্ব-কালের চিহ্নটি এখানে স্পষ্ট ভাবেই আছে। আশির দশকের কলকাতায় বেড়ে ওঠা আদিত্যর। এখন মুম্বইতে। প্রশ্ন করি, সংলাপ না রাখার ভাবনা গোড়া থেকেই ছিল? আদিত্য বলেন, ‘‘প্রথমে অল্প কিছু সংলাপ ছিল। শ্যুটিং শুরু করার পরে মনে হল আলো-ছায়া-ধ্বনি মিশে একটা অদ্ভুত ছন্দ তৈরি হচ্ছে। সংলাপ দরকার নেই।’’

কলেজ স্ট্রিটের কাছে একটা বাড়ি পেয়েছিলেন। ভাড়াটে উঠে গিয়েছেন, হাতবদল হবে। তারই ফাঁকে আদিত্য শ্যুটিং সেরে নেন। খালি ঘরে সাজিয়ে নেওয়া হয় নায়ক-নায়িকার সংসার।

‘আসা যাওয়ার মাঝে’-র আর এক নাম ‘লেবর অব লভ’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE