Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ছোট্টবেলার প্রেম......

অ্যাম্বাসেডর! প্রথম সব কিছুর সাক্ষী সে গাড়ি। তাকে নিয়ে নস্টালজিক অঞ্জন দত্ত। শুনলেন ইন্দ্রনীল রায়।বহু দিন আগে একটা গান লিখেছিলাম, জানেন? লাইনগুলো ছিল, ‘...ছোট্টবেলার প্রেম, আমার কালো মেম/ কোথায় গেলে হারিয়ে?’ গত সপ্তাহে যখন খবরের কাগজে প্রথম খবর পেলাম যে, অ্যাম্বাসেডরের ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, খালি মনে হচ্ছিল এই লাইনগুলো।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

বহু দিন আগে একটা গান লিখেছিলাম, জানেন? লাইনগুলো ছিল, ‘...ছোট্টবেলার প্রেম, আমার কালো মেম/ কোথায় গেলে হারিয়ে?’

গত সপ্তাহে যখন খবরের কাগজে প্রথম খবর পেলাম যে, অ্যাম্বাসেডরের ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, খালি মনে হচ্ছিল এই লাইনগুলো।

লাইনগুলো আমার বাবার সেই প্রিয় অ্যাম্বাসেডরের জন্য লিখিনি তো?

বোধহয় লিখেছিলাম। আমার সবচেয়ে প্রিয় গাড়ির জন্যই লিখেছিলাম। হয়তো আমাকে লোকে ওল্ড ফ্যাশন্‌ড বলবে। তা বলুক। আমার কাছে পাহাড় মানে যেমন হিমালয়, তেমন গাড়ি মানে অ্যাম্বাসেডর।

বেচারি কত কিছুই না সহ্য করেছে জীবনে। বহু মানুষের বিদ্রুপ শুনেছে। বহু মানুষ বলেছে, ধুর্‌, লুকস্‌ বলে কিছু নেই। কেউ বলেছে, পিক আপ বলে কিছু নেই। কিন্তু বাবার বয়স হয়ে গেলেও তিনি তো বাবা। এক সময় তাঁর মতো দাপুটে তো কেউ ছিলেন না। আমার অ্যাম্বাসেডরও আমার বাবার মতো। আর কে বলল বলুন তো, সব গাড়িকে চিতার মতো ক্ষিপ্র হতে হবে? কে বলেছে সব গাড়িকে হরিণের মতো ডেইন্টি হতে হবে? আরে বাঘের তো একটা নিজস্বতা আছে। আমার কাছে অ্যাম্বাসেডরও তাই।

দ্য টাইগার অ্যামঙ্গস্ট কারস্‌।

আমার প্রথম অ্যাম্বাসেডর মেমরি হল যখন আমার বয়স ছয়। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে আমি, বাবা আর মা নেমেছি। ওখান থেকে বাবা একটা গাড়ি ভাড়া নিলেন এবং নিজেই ড্রাইভ করতে শুরু করে দিলেন।

সেই অ্যাম্বাসেডর চড়েই আমার প্রথম পাহাড় দেখা। প্রথম কুয়াশা দেখা। সেই অ্যাম্বাসেডর চড়েই আমার প্রথম দার্জিলিং দেখা। তার পর তো যেখানেই গিয়েছি সেখানেই সেই অ্যাম্বাসেডর। আর শুধু তো আমি নই। হাজার হাজার বাঙালির লং ড্রাইভের গাড়ি মানেই অ্যাম্বাসেডর।

সে পাড়ার অশোকদাই হোক, কি মানিকবাবুর ফেলুদা। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তে চার বন্ধু অ্যাম্বাসেডরে করেই গিয়েছিল। বহু বাঙালি অজন্তা- ইলোরা তো অ্যাম্বাসেডরে করেই দেখেছে। শিমলার মল হোক কি পহেলগাঁওয়ের নদীর ধার সেই অ্যাম্বাসেডরই গিয়ে তো দাঁড়িয়েছিল।

আজকে সেই গাড়িটাই জীবন থেকে চলে যাবে। এটা ভেবে মনটা হুহু করে ওঠে। আসলে অ্যাম্বাসেডর যেন পাকাপোক্ত সেই মানুষটা যে কোনও দিন লেট ডাউন করবে না। এমন একটা মানুষ যে শত কষ্ট হলেও কিছু বলবে না। বিশ্বস্ত ভাবে শুধু কাজ করে যাবে। এমন একজন যে ট্রাস্টওয়ার্দি।

আমার মনে আছে সেই সময় আমাদের অবস্থা একেবারে পড়ে গিয়েছে। এক এক করে বাবা সব গাড়ি বেচে দিচ্ছে। ভ্যানগার্ডটা বেচে দেওয়া হয়ে গেল। ফিয়েটটাও বেচা হল। পড়ে রইল শুধু কালো অ্যাম্বাসেডরটা।

আজও মনে আছে অ্যাম্বাসেডরটা বেচে দেওয়ার দিন বাবা হাপুস নয়নে দরজা বন্ধ করে কেঁদেছিলেন। এক দিন বোধ হয় শুধু মদ খেয়েই কাটিয়েছিলেন বাবা। শকটা এতটাই ছিল। আমার বাবার মতো বহু মানুষের কাছেই ব্যাঙ্কের লকারে রাখা ফ্যামিলি জুয়েলসের মতোই ছিল অ্যাম্বাসেডর।

আর এক সময় তো সত্যিই হুজ হু-রা চড়ত ওই গাড়িটা। আমি নেতা মন্ত্রীদের কথা বলছি না। তাঁরা তো চড়তেনই। কিন্তু সমাজের বহু গুণী মানুষ যেমন নামী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রোফেসর সবার গাড়ি ছিল ওই একটাই।

আর সেলিব্রিটি? তা হলে বলি শুনুন। তখন সত্তর সালের পার্ক স্ট্রিট। ঘুরতে ঘুরতে ওদিকে গিয়েছি।

হঠাত্‌ অলিম্পিয়ার সামনে শোরগোল। কী হয়েছে? কী হয়েছে? এখনই নাকি উত্তমকুমার বেরোবেন। তা উত্তমকুমারই বেরোলেন, মুখে একটা সিগারেট। বেরিয়ে সোজা নিজের অ্যাম্বাসেডরটায় উঠে হাওয়া। উত্তমকুমারের মতোই ম্যাজিকাল লেগেছিল অ্যাম্বাসেডর গাড়িটা।

একই ভাবে স্কাইরুমে সত্যজিত্‌ রায়কে লাঞ্চ সেরে নিজের অ্যাম্বাসেডরে উঠতে দেখেছি। মৃণাল সেনের সঙ্গে শ্যুটিং মানে আমার কাছে মৃণালদার অ্যাম্বাসেডরে করে শ্যুটিংয়ে যাওয়া। এরকম কত স্মৃতি আছে বলুন তো গাড়িটার সঙ্গে।

আমার প্রথম ড্রাইভিং শেখা ওই অ্যাম্বাসেডরেই। পুজোর সময় দল বেঁধে যত খুশি লোক তুলে ঠাকুর দেখতে যাওয়া কীসে? না, অ্যাম্বাসেডরে। বহু দিন ইউরোপ, আমেরিকা ঘুরে এসে দমদম এয়ারপোর্টের বাইরে অ্যাম্বাসেডরটাকে দেখে একটা বাড়ি ফেরার শান্তি অনুভব হত কিনা বলুন? কোনও দিন বিয়েবাড়ির গাড়ি অ্যাম্বাসেডর ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারবেন, বলুন?

আমি তো আর কোনও গাড়ি কল্পনাই করতে পারি না। যেমন ধরুন ডিটেকটিভ কিরীটী রায়কে আমি অন্য কোনও গাড়িতে ইমেজিন করতে পারি না। আজকে যখন অ্যাম্বাসেডরের জয়যাত্রা শেষ তখন অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে করে প্রিয় গাড়িটাকে।

বলতে ইচ্ছে করে তুমি বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেলে গো। আমাদের শহর তো এখনও তেমন বদলে যায়নি যে তোমাকে আমরা স্থান দিতে পারছি না। এখনও তো শহরটা নিউ ইয়র্ক হল না যে তোমাকে বেমানান লাগবে।

আর কিছু দিন থেকে গেলেই তো পারতে তুমি। বড্ড বেশি স্মৃতি জড়িয়ে আছে গো তোমার সঙ্গে। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।

সত্যি তো, তুমি... আমার ‘কালো মেম / কোথায় গেলে গো আজ হারিয়ে।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE