বন্ধু মিতালির কাছে গল্পটা শোনা। মিতালি তখন সৌরভকে নিয়ে তথ্যচিত্র ‘দ্য ওয়ারিয়র প্রিন্স’-এর কাজ করছে। সৌরভের সঙ্গে গোটা পৃথিবীর নানা প্রান্তে শ্যুটিং সারছে। গ্রেগ চ্যাপেল থেকে সচিন তেন্ডুলকর সবার ইন্টারভিউ নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সমস্যা হল তথ্যচিত্রে ধারাভাষ্য কার থাকবে! সৌরভের ক্রিকেটজীবনের এত উত্থান-পতনের কাহিনি নিয়ে ঠিক কার নেপথ্য ভাষ্য শোনা যাবে? মিতালির কথায়, “সাহস করে একদিন চলেই গেলাম মুম্বই। সোজা ‘জলসা’-য়। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের তথ্যচিত্র করছি শুনে বাড়িতে প্রবেশাধিকার মিলল। বাড়ির মালিক নিজে এসে দেখা করলেন। অমায়িক ব্যবহার। কথা দিলেন সৌরভের তথ্যচিত্রে তিনি নিজে ভাষ্যপাঠ করবেন। কোনও রকম আর্থিক চুক্তি ছাড়াই। শুধুমাত্র সৌজন্যের খাতিরে। আর ভারতের সেরা ক্রিকেট অধিনায়কের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধায়।” মিতালির তথ্যচিত্রে তাই প্রথমেই শোনা যায় ওই জলদগম্ভীর কণ্ঠটাই। ‘আ ওয়ারিয়র নেভার ডাইজ টিল হিজ ডেথ’। পিছনে সৌরভ দৌড়চ্ছেন। আর পর্দায় ভেসে উঠছে টাইটেল কার্ড। ভাষ্যপাঠে অমিতাভ বচ্চন।
ছবি সৌজন্য: অমিতাভ বচ্চনের ফেসবুক পেজ।
ঠিক কতটা সৌজন্যের খাতিরে তাঁর মতো একজন ব্যস্ত পেশাদার চলে আসেন ডকুমেন্টারিতে ভয়েস ওভার করতে? এই কয়েক বছরে হিসেব মেলাতে পারিনি। দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে গেল রবিবার। কলেজ স্ট্রিট লাহাবাড়ির উঠোনটায় দাঁড়িয়ে। সামনে সেই দীর্ঘকায় মানুষটা। হাতজোড় করে বিনয়ে সামনে কিছুটা ঝুঁকে। সন্তানসম আর এক কৃতী মানুষকে নিজের শ্যুটিং চৌহদ্দিতে হাজারো ব্যস্ততার মাঝে দেখেও, যিনি সৌজন্যের সিলেবাসের একটা লাইনও ভোলেননি। সামনে সস্ত্রীক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ। প্রবাদপ্রতিম এক জন মানুষের এই বিনয়, এই সৌজন্য, এই ভদ্রতাকে দু’হাত ভরে গ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। অনেক আগে অমিতাভ বচ্চনের একটা সাক্ষাত্কার দেখেছিলাম টিভিতে। ক্রিকেট নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণ। নিজে যখন ক্রিকেট খেলতেন বাঁ হাতে বল আর ডান হাতে ব্যাট করতেন সিনিয়র বচ্চন। একবার ব্র্যাবোর্ন স্টেডিয়ামে চ্যারিটি ম্যাচ। ফিল্মস্টারেরা ফিল্ডিং করছেন আর বচ্চনের হাতে বল। গোটা তিনেক বল হয়ে যাওয়ার পর আম্পায়ার বললেন, ‘স্টাম্প থেকে একটু সরে বল করো। আরও এফেক্টিভ হবে।’ বচ্চনের নিজের কথায়,“ আমি ভাবলাম এ আবার কে! আম্পায়ারের পরামর্শ শোনার প্রশ্নই ছিল না। আর শুনিওনি। পরে একজনকে বললাম, আম্পায়ার ভদ্রলোক কে? যেচে পরামর্শ দিতে আসছেন। সে বলল, ‘সেকি! চিনতে পারোনি, উনি বিনু মানকড়।’ আমার তখন মনে হচ্ছে কোথায় লুকোই। যেন ধরিত্রী দু’ভাগ হোক আর আমি লুকিয়ে বাঁচি।” খেলা ও খেলোয়াড়দের নিয়ে তাঁর শ্রদ্ধার জায়গাটা এই রকমই। সোশ্যাল নেটওয়ার্কে যে দিন থেকে অ্যাকটিভ তাঁর নিজস্ব ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট, সে দিন থেকেই ভারতীয় খেলাধুলোর কাছাকাছি তিনি। অলিম্পিকে সাইনা নেহওয়াল পদক জিতলে তাঁর যেমন উচ্ছ্বাস, ধোনির টিম জিতলেও তাই।
একাত্তর বছর বয়সে মশাল হাতে দৌড়তে চলে গিয়েছেন অলিম্পিক্সের আসরে। রাত জেগে বিশ্ব ফুটবল দেখার অভিজ্ঞতাও অনেক। ছেলে অভিষেক চেলসির ফ্যান। আর বাবা তো নিজেই এ বার চলে গিয়েছিলেন রিও ডি জেনিরোতে। বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল দেখতে। আইএসএল-য়ে চেন্নাইয়ান এফসি-র ম্যাচগুলোতে হাজির হয়ে যাচ্ছেন। অমিতাভ বচ্চনের খেলাধুলো নিয়ে এই প্যাশনটা বুঝলেই বাকিটা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
“অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। তুমি যাবে আমার সঙ্গে?” শনিবার সকালে ডোনার ফোন।
আগের দিন রাতেই বিগবি-র সঙ্গে স্টেডিয়ামে দেখা হয়েছে গঙ্গোপাধ্যায় দম্পতির। ডোনার স্কুল ‘দীক্ষামঞ্জরী’র দশ বছরের পূর্তি অনুষ্ঠানে আসবেন কথা দিয়েছিলেন। এ বার দেখা হতে নিজেই বলেন, “ কী! তোমার স্কুলে ডাকলে না আমায়?” ডোনার স্কুলের বয়স পনেরো বছর হয়ে গেল। উদ্বোধন লতা মঙ্গেশকরের হাতে। দশ বছর না হোক, অন্তত পনেরো বছরের অনুষ্ঠানে অমিতাভ বচ্চনকে পাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে ও রাজি নয় কোনও ভাবে। এক সাংবাদিক বন্ধু পরিচালক সুজিত সরকারকে বলে সাক্ষাত্কারের ব্যবস্থা করে রাখলেন। সৌরভ সব শুনে বলল, “ না না, নিমন্ত্রণ করতে যাচ্ছে। ওঁর মতো মানুষ। আমি না গেলে খারাপ দেখায়। আমিও যাব।”
‘ডন’য়ের সঙ্গে ‘দাদা’। পাশে ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়।
লাহাবাড়িতে পৌঁছলাম কিছুটা আগেই। ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির উল্টো দিকের রাস্তাটা ব্যারিকেড করে আটকানো। অমিতাভ মেক আপ ভ্যান থেকে বের হতেই চারপাশে যে গর্জনটা শুনলাম, বুঝলাম চারপাশের কত মানুষের অতন্দ্র দৃষ্টি এখন এই পুরনো বাড়িটার দিকে। সৌরভের ঢোকার অপেক্ষায় ছিল পুরো ইউনিট। দাদা আসতেই আবার সেই গর্জন। ডনের ডেরায় দাদাগিরি। অপ্রত্যাশিত তো বটেই।
লাহাবাড়িতে ঢুকে ভাল করে দেখলাম মানুষটাকে। এই সেই অমিতাভ বচ্চন। ইতিহাস, কিংবদন্তি, নস্টালজিয়া আমাদের জীবনের বেড়ে ওঠার বোধহয় একটা বড় অধ্যায়। চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকুন, এই মানুষটা ফিরে ফিরে আসবেনই আপনার নস্টালজিয়ায়। কখনও বাবুমশাই হয়ে, কখনও অ্যান্টনি গঞ্জালেস, কখনও বিজয় দীননাথ চৌহ্বান হয়ে। ‘পিকু’র ডিরেক্টর এ বার ওঁকে মধ্যবিত্ত বাঙালি বৃদ্ধ বানিয়েছেন। নস্যি রংয়ের পাঞ্জাবিতে ঢেকে ফেলা হয়েছে কৃত্রিম একটা ভুঁড়ি। পায়ে সাদা মোজা। সৌরভরা ঢুকলেন যখন, প্রথম শট দেবেন। সৌজন্য বিনিময়ের পর নিজেই বসতে বললেন, “দশ মিনিট সময় দাও। প্রথম শটটা দিয়েই তোমাদের সঙ্গে কথা বলছি।” অতিথি আপ্যায়নে তখন ব্যস্ত পরিচালক সুজিত সরকার। ইরফান, দীপিকা পাড়ুকোনও চলে এলেন সৌরভের সঙ্গে দেখা করতে। বসার চেয়ার দেওয়া হল। সৌরভ বসবেন না। থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলেন অমিতাভের শ্যুটিং। মুখে বিস্ময় মেশানো হাসি। হ্যাঁ, সৌরভেরও বিস্ময়। একসঙ্গে বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন। এই মানুষটা আজও প্রতি মুহূর্তে বিস্ময়ই উত্পাদন করেন।
প্রায় তিন মিনিটের একটা শট। প্রায় পুরোটাই ওঁর নিজের সংলাপ। অনায়াস ভঙ্গিমায় বলে ফেলেন। প্রথমবার টেকের পর নিজেই বলেন, “আর একবার নাও।” ৭৩ বছর বয়সেও সন্তুষ্টির কোনও জায়গা নেই। সে দিনই নাতনি আরাধ্যার তিন বছরের জন্মদিন। ‘প্রতীক্ষা’য় রাতেই অভিষেক আর ঐশ্বর্যার জমজমাট পার্টি। অথচ ৭৩ বছরের দাদু সব ফেলে দশ দিন ধরে পড়ে আছেন কলকাতায়। আসলে কিংবদন্তিরাও কোনও মসৃণ হাইওয়েতে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছোন না। তাদের রাস্তাটাও অগ্নিপথ সংঘর্ষ আর নির্মাণের। না হলে ৭৩ বছরেও সাফল্যের খিদে, পারফেকশনের খিদে একই রকমভাবে ছুটিয়ে বেড়ায় না একটা জীবনে সব পেয়ে যাওয়া মানুষটাকে। সৌরভের হাসিটা বলে দিচ্ছিল সেই মুহূর্তগুলোয় ওই পাকা চুল, ব্যারিটোন ভয়েসে ভেসে গিয়েছেন তিনি নিজেও। বারবার ডোনার কানের কাছে সাবধানবাণী আওড়ে যাচ্ছেন, “কোনও ভাবে ওঁর অসুবিধে যেন না হয়। উনি যেভাবে বলবেন, ঠিক সেভাবেই সবটা অ্যারেঞ্জ কোরো।” ডোনা বাধ্য ছাত্রীর মতো মাথা নাড়ছেন। শট শেষ হতেই তিনি এলেন। ডোনা-সৌরভের মুখোমুখিই বসলেন। শুনে নিলেন গোটা বিষয়টা। বললেন, “অবশ্যই আসব। জানুয়ারির মাঝামাঝি কিছু দিন ফাঁকা আছি। সে সময়ে আসব। কিন্তু তোমার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারলেই আমার বেশি ভাল লাগবে। দরকার হলে তোমার স্কুলে চলে যাব। কোনও বড় অনুষ্ঠানের দরকারই নেই।” ডোনা বললেন, “আমার স্কুলে প্রায় দু’হাজার ছাত্রছাত্রী নাচ-গান, ক্যারাটে কিংবা সাঁতার শেখে। বড় অনুষ্ঠান ছাড়া সবাইকে এক করা যাবে না।” অমিতাভ বচ্চন অবশ্য তাতেও রাজি। সৌরভ তখনও বলে যাচ্ছেন: “ডোনা, ওঁর যেন কোনও অসুবিধে না হয়।” অমিতাভই বরং আশ্বস্ত করেছেন সৌরভকে। “না, না, আমার কোনও কিছুতেই কোনও অসুবিধে নেই। কলকাতার জন্য আমার কোনও কিছুতে আপত্তি নেই। বিশ্বাস করো, এত জায়গায় যাই। এখানকার মতো উষ্ণতা কোথাও নেই। কলকাতার মানুষজন অসাধারণ।” সায় দিচ্ছিলেন সৌরভও। সত্যি এই শহরের তো তুলনা নেই। আর এগুলো যে নেহাতই চিত্রনাট্য নয়, সেটা সিনিয়র বচ্চনের ফেসবুক, ট্যুইটার ফলো করলে অনায়াসে বুঝতে পারবেন। প্রতিদিন কাজের শেষে মানুষের ভালবাসায় ভাসতে ভাসতে হোটেলে ফিরছেন। জীবনসায়াহ্নে কৃতজ্ঞতায় ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে ওঁর কলমও। এখনও এই ভালবাসা! কলকাতা-চেন্নাই ম্যাচ ড্র হওয়ার পর ফেসবুকে লিখছেন ‘উফফ্... হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এক দিকে আমার ভালবাসার শহর, পেশাদারি জীবন শুরু করার শহর কলকাতা। অন্য দিকে অভিষেকের দল চেন্নাই। যে হারত, তার জন্যই কষ্ট পেতাম। ম্যাচ ড্র। রিলিফ।’
কলকাতার প্রতি উষ্ণতা, এখনও চলকে পড়ে মুম্বইয়ে বসেও। মনে আছে, আইপিএল-য়ে পুণে-কলকাতার সেই বিখ্যাত ম্যাচটার পরও ট্যুইট করেছিলেন। জীবনের শেষ ইনিংসটা ইডেনের বুকে খেলেই বেরিয়েছিলেন সৌরভ। বেরিয়ে আসছিলেন যখন, ইডেনে বেজেছিল অমিতাভ বচ্চনের গলায় ‘কহানি’র গান ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে।’ গোটা ইডেন সেদিন গলা মিলিয়েছিল ওই ব্যারিটোন আওয়াজে। গানটা, ওই মুহূর্তগুলো, বোধহয় এখনও ভোলেননি সৌরভ। ওঁর ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন করলে কলার টিউনে শুনতে পাবেন ওই গানটাই। হ্যাঁ, অমিতাভ বচ্চনের গলাতেই।
জীবন যে কাকে কখন কোথায় মিলিয়ে দেয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy