Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

বলিউডে নতুন ঋত্বিক

পদবি রোশন নয়। চক্রবর্তী। হিন্দি ছবির দুনিয়ায় শব্দ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্তপদবি রোশন নয়। চক্রবর্তী। হিন্দি ছবির দুনিয়ায় শব্দ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

মার্চ মাসের শেষে ঋত্বিক চক্রবর্তী ঠিকানা পাল্টাচ্ছেন। গাঙ্গুলিবাগানের তিন তলার ফ্ল্যাট থেকে দু’হাজার কিলোমিটার দূরে চলে যাচ্ছেন মুম্বইয়ে।

আর সেখানে ফ্ল্যাট নয়, থাকবেন একটা চউল-এ। ১০ ফুট বাই ১০ ফুট একটা ঘরে।

জীবনের প্রথম হিন্দি ছবি। মুম্বইতে তার ওয়ার্কশপ এ ভাবে না করলে চলে?

ছবির নাম ‘দ্য ভায়োলিন প্লেয়ার’। পরিচালক বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়। তিনশোর ওপর বিজ্ঞাপন তৈরির পরে যিনি গত বছর বাংলাতে পরিচালনা করেছেন তাঁর প্রথম ফিচার ছবি। নাম ‘তিনকাহন’। যা ইতিমধ্যে ইন্ডিয়ান প্যানোরামাতে প্রদর্শিত হওয়া ছাড়াও দেখানো হয়েছে কুড়িটি চলচ্চিত্র উৎসবে। ইতিমধ্যেই ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, সব্যসাচী চক্রবর্তী, জয় সেনগুপ্ত অভিনীত যে ছবি পেয়েছে এগারোটা আন্তর্জাতিক পুরস্কার।

ছবির নাম যেখানে ‘দ্য ভায়োলিন প্লেয়ার’, সেখানে তার গল্পটা এক বেহালাবাদককে ঘিরে হওয়াটাই স্বাভাবিক। মুম্বই-নিবাসী বৌদ্ধায়নের নিজের লেখা গল্প এটি।

গল্পটা এক বেহালাবাদকের একদিনের জীবনকে কেন্দ্র করে। এই বেহালাবাদক কলকাতানিবাসী। নাম রবি চট্টোপাধ্যায়। মধ্য চল্লিশের একটু সেকেলে মনোভাবের মানুষ। পণ্ডিত ভিজি যোগের ছাত্র। সলিল চৌধুরীর ডাকে সাড়া দিয়ে তার মুম্বইয়ে যাওয়া। আর তার পর বলিউডের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের দুনিয়ায় বহুর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া। ভিজি যোগ বা সলিল চৌধুরীর রেফারেন্স থাকলেও ছবির গল্পটা সাম্প্রতিক কালকে মাথায় রেখেই লেখা।

এ নাগাদ টলিউডের যত অভিনেতা বলিউডে গিয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের ৯০ শতাংশকেই দেখা গিয়েছে জোরালো পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করতে। তা সে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, যিশু সেনগুপ্ত, রজতাভ দত্ত হোন বা খরাজ মুখোপাধ্যায়, রাজেশ শর্মা প্রমুখ। আর সেই সব চরিত্রে অভিনয় করেই আমাদের এই অভিনেতারা শিরোনামে এসেছেন। প্রশংসিত হয়েছেন।

তবে ঋত্বিকের ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম রয়েছে। বলিউডের প্রথম কাজেই তিনি থাকছেন নামভূমিকায়। সঙ্গে আছেন জাকির হুসেন। ‘সরকার’ ছবিতে অভিনয় করেছেন জাকির। ‘‘এনএসডির গ্র্যাজুয়েট। অসামান্য অভিনেতা। এ ছবিতে জাকির থাকছেন এক পরিচালকের ভূমিকায়। আর এক মহিলা চরিত্রের কাস্টিং এখনও চলছে,’’ মুম্বই থেকে জানাচ্ছেন পরিচালক।

তবে মুম্বইতে বসে হিন্দি ছবি করতে গিয়ে হঠাৎ ঋত্বিককে বেছে নিলেন কেন? প্রথম অঞ্জন দত্তর একটা টেলিফিল্মে ঋত্বিকের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন পরিচালক। ‘‘জানতাম এই অভিনেতাকে বোকাবাক্সতে বন্দি করে রাখা কঠিন। তার পর ‘শব্দ’, ‘এবার শবর’, ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’য়ে ওকে দেখেছি। ঋত্বিক না করলে আমি হয়তো এই ছবিটা বানাতাম না। ওর মধ্যে একটা শিল্পীসত্তা আছে। ভালনারেবিলিটি আছে যেটা ভীষণ ভাবে প্রয়োজনীয় এই চরিত্রের জন্য,’’ বলছেন বৌদ্ধায়ন।

সারা ভারতবর্ষে নাকি গরু খোঁজার মতো খুঁজেও আর একজন ঋত্বিককে পাননি তিনি! এর সঙ্গে আরও দাবি করছেন যে বক্স অফিস ভেবে তিনি ছবি বানান না। শুধুমাত্র সিনেমার কথা ভেবেই সিনেমা বানান। এবং সে কারণেই ঋত্বিক ছবির
নামভূমিকায়। ছবিতে একটাও দৃশ্য নেই যেখানে ঋত্বিক থাকবেন না। শ্যুটিং শুরুর আগেই ঋত্বিক যা খাটছেন, তা দেখে মুগ্ধ তাঁর পরিচালক।

তবে বলিউডের প্রথম ইনিংসে নিজের কাঁধে এতটা ভার নিতে ভয় হচ্ছে কি ঋত্বিকের? ‘‘ছবিটা দারুণ ইন্টারেস্টিং। দুর্দান্ত চিত্রনাট্য। চরিত্রটাও খুব ভাল। আমি শুধু এটাই ভেবে ছবিটা করছি। বলিউডে ডেব্যু করতে গিয়ে নামভূমিকায় আছি কি নেই, তা নিয়ে আমার আলাদা করে কোনও টেনশন নেই,’’ সাফ জানিয়ে দেন ঋত্বিক।

একটি দিন নিয়ে গল্প। তার সঙ্গে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির আন্ডারডগের চরিত্র। কোথাও কি এই ছবির সঙ্গে ঋত্বিক অভিনীত ‘শব্দ’য়ের বা ভেনিসে পুরস্কৃত ‘আসা যাওয়ার মাঝে’ মিল রয়েছে? ‘‘এ ছবির গল্পটা একদম আলাদা। ঠিক ইন্ডাস্ট্রির আন্ডারডগ বললে এটার ব্যাখ্যা করা যায় না। হ্যাঁ, একদিনের গল্প ঠিকই। তবে এই একদিনের গল্পের সঙ্গে আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তর ‘আসা যাওয়ার মাঝে’র ট্রিটমেন্টের কোনও মিল নেই। ও ছবিতে তো কোনও সংলাপই ছিল না,’’ প্রথমেই পার্থক্যটা বুঝিয়ে দেন অভিনেতা।

আপাতত টলিউডের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে খবরটা জানিয়েছেন ঋত্বিক। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্বনাথ বসু, প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য আর সুজন মুখোপাধ্যায়। স্বাভাবিক ভাবেই খুব খুশি বন্ধুরা। তবে হিন্দি ছবিতে অভিনয় করা তো যে-সে কথা নয়। যেখানে হিন্দি ভাষাটার সঙ্গেও তাঁর নাড়ির যোগ নেই। বাঁচোয়া এটাই যে চরিত্রটা এমন যে কিনা কলকাতা থেকে মুম্বইয়ে যায়। তাই একটু বাঙালি কায়দায় হিন্দি বললে তাতে চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে যেতে অসুবিধে হবে না। শ্যুটিংয়ের সময় বৌদ্ধায়নের স্ত্রী মোনালিসা, যিনি আবার এই ছবির প্রযোজকও, থাকছেন উচ্চারণ ঠিক করার দায়িত্বে।

মুম্বই যাওয়ার আগেই ঋত্বিক নিজের বাচনভঙ্গি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। আলাদা করে কোনও হিন্দি ভাষার শিক্ষক না রাখলেও এক হিন্দিভাষী দলের সঙ্গে কথা বলা অভ্যেস করছেন তিনি।

প্র্যাকটিসের জন্য কি কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ করে হিন্দিতে উত্তর দিয়ে ফেলছেন তিনি? ‘‘হিন্দিটা যাতে বিশ্বাসযোগ্য হয় সেটারই চেষ্টা করছি,’’ হেসে বলেন ঋত্বিক।

হিন্দিভাষা না হয় আস্তে আস্তে রপ্ত হচ্ছে। তবে সমস্যা হল বেহালা বাজানো নিয়ে। অকপট স্বীকার করছেন যে, মিউজিকাল সেন্স বলতে তাঁর কিছুই নেই। ‘‘আমাকে যদি কেউ বলে গানের সঙ্গে তাল রাখতে, আমি সেটাও ভুল করি। একদম গানহীন মানুষ আমি। সেই আমাকেই বেহালা শিখতে হচ্ছে। এ তো এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার! এটা হল বর্ণপরিচয় না জেনে কাউকে ‘এসে’ লিখতে বলার মতো কাণ্ড। এডিটর অর্ঘ্যকমল মিত্রর পুত্র দিব্যকমলের কাছে আমি বেহালা বাজানো শিখছি,’’ বলছেন ঋত্বিক।

দু’সপ্তাহ হল তালিম নিচ্ছেন। ভুল-ত্রুটি হচ্ছে কি? ‘‘আরে, পুরোটাই তো ভুল করছি। বললাম না, আমার মধ্যে কোনও মিউজিকাল সেন্স নেই। তবে সুবিধে হল, আমাকে তো আর রাগ বাজাতে হবে না। বেহালা কী করে ধরতে হয়, আর কিছু বেসিক ব্যাপার শিখতে হচ্ছে। সেটুকুর উপরই আমি মনোনিবেশ করছি,’’ বলছেন ঋত্বিক। ছবির সুর করছেন ‘তিনকাহন’‌য়ের সুরকার অর্ণব চক্রবর্তী আর কলকাতার বেহালাবাদক ভাস্কর দত্ত।

এপ্রিল মাস নাগাদ মুম্বইতে ছবির শ্যুটিং শুরু। কিন্তু ‘তিনকাহন’ মুক্তির আগেই কেন এই ছবির শ্যুটিং শুরু করছেন বৌদ্ধায়ন? এত তাড়া কীসের? কারণটা নাকি স্বয়ং ঋত্বিক। সামনে পাঁচটা ছবি করার কথা হয়েছে। তাই হিন্দি ছবির ডেট দেওয়া নিয়ে ঝামেলায় পড়েছিলেন তিনি! ‘‘কী আর করব বলুন তো? ঋত্বিক আমার চেয়ে ঢের বিজি। ও এই উইনডোটা বার করতে পারল, তাই সব ছেড়েছুড়ে শ্যুট করছি। এতেই বুঝবেন এ ছবির জন্য ঋত্বিক কতটা জরুরি!’’ হেসে বলেন পরিচালক।

ঋত্বিক হল। বলিউড ডেব্যু হল। হঠাৎ ছবির নামটা ইংরেজিতে কেন? ‘‘টাইটেল হিসেবে ‘বেহালাবাদক’ শ্রুতিমধুর নয় বলেই বোধহয় এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। তা ছাড়া ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ যে কারণে ‘টিফিন কা ডাব্বা’ হল না, ঠিক একই কারণে এ ছবির নাম ‘দ্য ভায়োলিন প্লেয়ার’,’’ সাফ জবাব পরিচালকের।

আগামী মাসের ২৪ তারিখ মুম্বই চলে যাবেন ঋত্বিক। তিন সপ্তাহ মুম্বইতে। কাজ শুরু হবে ওয়ার্কশপ দিয়ে। দেড় বছর বয়সি সন্তানকে এই প্রথম এত দিন ছেড়ে থাকতে হবে বলে একটু মন কেমন করছে ঠিকই। তবে বেহালার সুর দিয়ে বলিউডে শব্দ করতে গেলে তো একটু মন খারাপ নিয়ে থাকতেই হবে। তা শুনে ঋত্বিক বলছেন, ‘‘বলিউড একটা বড় জায়গা। সেখানে শব্দ করতে পারব কি না, এ সব নিয়ে এখন ভাবছি না।’’

এ বছর টলিউডে মুক্তি পাবে ঋত্বিক অভিনীত সাতটা ছবি। তার মধ্যে বলিউডের হাতছানি। মুম্বই গিয়ে থেকে যাওয়ার প্ল্যান নেই তো? ‘‘একদম না। কাজ করতে ও শহরে যাচ্ছি। গল্পটার পটভূমি মুম্বই। যদি হায়দরাবাদ বা লালবাগ হত, তা হলে সেখানে গিয়েই শ্যুটিং করতাম!’’ বলছেন তিনি।

আর মায়ানগরী মুম্বইতে যে
রাজত্ব করছেন তাঁরই নেমসেক অন্য এক অভিনেতা? পদবি আলাদা ঠিকই। আলাদা নামের বানান এবং তার সঙ্গে অনেক কিছু। তবু কেউ যদি রসিকতা করে বলেন, এই তো টলিউড এ বার বলিউডে নতুন হৃত্বিক এক্সপোর্ট করল? প্রশ্ন শুনে একগাল হেসে ঋত্বিক বলেন, ‘‘ধুস্! হৃতিকের আমি ফ্যান নই। ওঁর ছবি ভাল লাগে। এ রকম দুর্দান্ত দেখতে একটা মানুষ। এত ভাল নাচেন। এ ভাবে কিছু কেউ বললে সেটা ইয়ার্কি হিসেবেই নেব। কাজ করতে যাচ্ছি, নতুন একটা ইন্ডাস্ট্রি, নতুন ভাষা। তারপর বেহালার মতো একটা যন্ত্র।
এ সব নিয়েও যেন ভাল ভাবে চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলতে পারি সেটাই আমার লক্ষ্য।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

hrithik chakraborty priyanka dasgupta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE