শুনলাম অ্যাকিউট স্পন্ডেলাইসিস আপনার?
একদমই তাই। বেড রেস্ট। লেখালিখি বন্ধ। ডাক্তার বলছিল, শিরদাঁড়া এত সোজা না হলেও পারত। (হাসি)
খুব সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গীত সম্মান প্রত্যাখ্যান করলেন। কী হল হঠাৎ?
এটা আমার জন্য নতুন ঘটনা নয়। বাম আমলেও সরকারের পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছি। আসলে সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনায় আমার মন ভার হয়ে আছে। কয়েক বার প্রকাশ্যে সরকারের কাজের সমালোচনাও করেছি। এই অবস্থায় সরকারি পুরস্কার গ্রহণ করাটা দ্বিচারিতা বলেই আমি মনে করি।
একটা চ্যানেলের সঙ্গেও তো আপনার সমস্যা হয়েছে?
আমি একটি বেসরকারি চ্যানেলে সাঙ্গীতিক অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছিলাম। যখন প্রথম বার অর্থপ্রাপ্তির সময় এল তখন চ্যানেল কর্তৃপক্ষ আমার ফোন ধরা বন্ধ করে দিলেন। মুখের ওপর সাফ জানালেন তাঁরা টাকাটা দিতে পারছেন না। কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিলেন পরবর্তী শ্যুটিং পর্যায় শুরু হওয়ার আগে পুরো টাকাটাই দিয়ে দেবেন। আমি আবার ওঁদের জন্য কাজ বন্ধ রেখে দিন ঠিক করলাম। শুরুর আগে বললেন আমার মোট পারিশ্রমিকের মাত্র এক চতুর্থাংশ ওঁরা দিচ্ছেন। বাকি টাকা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই।
আর্থিক দিক থেকে এ তো অনেক ক্ষতি!
আমি কিন্তু চাকরি করি না। এই অনুষ্ঠানের জন্য যে টাকাটা পেতাম, সেটা নিয়ে আমার একটা পরিকল্পনা তো ছিলই। এবং আজ বলতে বাধা নেই যে এই চ্যানেলে যাঁরা কর্তাব্যক্তি, তাঁদের অধিকাংশই অমানবিক, অনৈতিক, নির্লজ্জ, অশিক্ষিত, এবং অপেশাদার। এই পাঁচটা শব্দ আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি। মানুষকে এ ভাবে ব্যবহার করা এক ধরনের দুর্নীতি। আমার বন্ধুবান্ধব, পরিচিত মানুষজনকে এই চ্যানেল থেকে দূরে থাকার অনুরোধ করব।
চাকরি না করে বেঁচে থাকা, এটা শ্রীজাত বলে সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু নতুন উঠতি কবির পক্ষে কি এই ধরনের সাহস দেখানো সম্ভব হত?
একজন গদ্যকারের পক্ষে যদিও বা চাকরি না করে লেখালেখি করে জীবন কাটানো সম্ভব, একজন কবির পক্ষে শুধুমাত্র কবিতা লিখে জীবনধারণ করা অসম্ভব। আমাকে উপার্জনের জন্য অনেক ধরনের লেখা লিখতে হয়।
কবিরা কি তা হলে মৃতপ্রায়?
একেবারেই না। তা হলে আপনার সামনে বসে আছি কী করে?
কিন্তু কেবল আপনার অভিজ্ঞতা দিয়ে কি কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায়? আপনি তো ব্যতিক্রম।
সদ্য বইমেলা গেল। সেখানে গিয়ে দেখেছি অন্য কবিদের বই কী পরিমাণে প্রকাশিত হচ্ছে।
কবিতা লেখার কত বছর হল?
আমার প্রথম কবিতা ছাপা হওয়ার কুড়ি বছর হল। কুড়ি বছর ধরে পাঠক আমাকে সহ্য করছেন। অবাক লাগে!
কুড়ি বছর মাথায় রেখেই এ বার কবিতাসমগ্র ছাপা হল?
অনেক দিন আগেই প্রস্তাবটা এসেছিল। কুড়ি বছর ভেবে হয়নি। একটা ধারণা আছে মানুষ পপকর্ন খাবে তবু কবিতার বই কিনবে না।
কিন্তু বইমেলায় লোকে যে কবিতাসমগ্র কিনেছেন এটাই আমার প্রাপ্তি। যত দিন বেঁচে আছি ভাল হোক মন্দ হোক বাংলা কবিতা নিয়েই বেঁচে থাকব।
আর কে কে কবিতা নিয়ে বেঁচে থাকবেন?
পিনাকীদা (ঠাকুর) থাকবেন। বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় থাকবে। অংশুমান, মন্দাক্রান্তারা থাকবে। কোনও শিল্পই কেউ একা করে না। সুনীল-শক্তির সময়টা আলাদা। আবার জয়-সুবোধ-মল্লিকার সময়টাও আলাদা। আমাদের সময়টাকেও আমাদের মতো করে বুঝতে হবে।
আলাদা মানে?
কবিতার বাহ্যিক জগতে কুড়ি বছর পার করে আমি বুঝলাম, এটা মেগাসিরিয়ালে খুনসুটির মতো। ছোট ছোট ঈর্ষা, ষড়যন্ত্র...
কবিতার জগতেও দলাদলি আছে?
অবশ্যই আছে। দুঃখের বিষয়, একটা লেখা পড়ে কেউ আর বলে না, ‘এই লাইনটা কেন লিখলে’? এটা বললে আমি খুশি হই। অনেককে চিনি যাঁরা ফেসবুকে কুৎসা করেন। দেখা হলেই জড়িয়ে ধরেন। এখন কুৎসাই রটে। লেখার বাইরের কথা হয়।
এই রকম কোনও অভিজ্ঞতা আছে?
সম্প্রতি শনিবারের ‘পত্রিকা’তে জীবনানন্দ নিয়ে যে লেখাটি লিখেছিলাম সেটা নিয়ে মানুষের কাছ থেকে প্রচুর ফিড ব্যাক পেয়েছি যেমন, তেমনি সমসাময়িক কয়েক জন এই লেখাটিকে নিয়ে কুৎসা ছড়িয়েছেন। তাঁদের নাম ধরে কিছু বলাটাও আমার খুব কুরুচিকর মনে হয়।
অত্যন্ত আক্ষেপের সঙ্গে বলছি যে কুড়ি বছর ধরে খুব কম কবিতার আড্ডায় গিয়েছি যেখানে কবিতার লোকেরা শুধু কবিতা নিয়েই আলোচনা করছেন। চল্লিশ বছর বয়সে এসে এই মন্তব্যটা করতেই হল।
কবিতার আড্ডায় কবিতার বাইরে কী নিয়ে আলোচনা হয়?
কে কোন পুরস্কার পেল? তা হলে তার কী লবি? এর কবিতা কেন বেশি ছাপা হচ্ছে? তা হলে ও ঠিক কাকে ধরেছে? ও কেন বিদেশ গেল কবিতা পড়তে? পুরুষ হলে এক রকম ব্যাখ্যা। নারী হলে আর এক রকম। সাত জনের মধ্যে ছ’জন এখন কবিতা লেখে। সেই ছ’জন যদি চুলোচুলি করে, কবিতার মধ্যে শিল্প বলে কিছু থাকে না। যাঁরা এই সব করেন, তাঁরা যদি এই সব বন্ধ করে কবিতাটা মন দিয়ে লেখেন তবে কবিতারই ভাল হবে।
আমি কেন একজন কবি হয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় অমুক বিষয়ে মন্তব্য করব এটা তো চর্চার বিষয় হতে পারে না।
বরং মন্তব্যের গুণমান নিয়ে কেউ কিছু বলতে পারেন।
আপনি তো কবি হয়ে গানও লেখেন?
আমার সিনেমায় গান লেখা নিয়েও চমৎকার ক্ষোভ রয়েছে। কিছু পিউরিটান মানুষ ভাবেন সিনেমা ‘নিচু জাত’। কবি কেন সেখানে গান লিখতে যাবেন? আমি তো আমার শর্ত মেনেই সিনেমায় গান লিখছি।
সেই শর্তগুলো কী কী?
আমি এত বড় ইন্ডাস্ট্রিতে খুব কম লোকের সঙ্গে কাজ করেছি। কিন্তু যখন রিনাদি (অপর্ণা সেন) আমায় গান লিখতে বলেন, সৃজিত বা কৌশিকদা গান লেখার কথা বলে, তখন সেটা মাথায় রেখেই বলেন যে আমাকে লিখতে বলছেন। কেউই এমন কিছু লিখতে বলেননি যা লিখতে গিয়ে কবি হিসেবে বেড়া টপকাতে হবে!
কিন্তু কবিতা বা গান, দু’ক্ষেত্রেই মনে হয়নি কখনও শ্রীজাতর শব্দে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
হ্যাঁ, মনে হয়েছে আমি নিজের পুনরাবৃত্তি করছি। তখন লেখা বন্ধ করে দিয়েছি।
আর গানের ক্ষেত্রে?
আমরা কিন্তু গীতিকবিতা বরাবর ভালবাসি। লিরিসিজমের প্রতি আমাদের ঝোঁক থাকবেই।
কিন্তু সিনেমা থেকে বেরিয়ে আসার পর তো গানগুলো মনে থাকে না।
কারণ আমরা কেউ গুলজার, হসরত জয়পুরী বা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার নই। তবে আমাদের সময় বাংলা ছবির গান ৮০-৯০ দশকের চেয়ে অনেক উন্নত।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কখনও গান আর কবিতা একসঙ্গে লেখা নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি?
সুনীলদা দু’রকমই বলতেন। বড্ড বেশি গান লিখছ। আবার বলতেন গান মানুষের মনে দীর্ঘকাল থেকে যায়। সুনীলদার মতো আধুনিক মানুষ আর দেখতে পেলাম না।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পর বাংলা সাহিত্যেও কি পচন ধরেনি?
নাহ্, আমি মনে করি না। আমাদের প্রজন্ম সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ বসু-মতি নন্দী পড়ে বড় হয়েছে। তাঁদের একটা ‘অরা’ আছে। নতুন প্রজন্ম নেটের যুগেও লেখকদের গল্পের বই, উপন্যাস পড়েন। এটা মানতেই হবে।
এখন কার লেখা গান ভাল লাগছে?
প্রসেনের লেখা খুব ভাল। অনেক মেনস্ট্রিম ছবিতে ওকে কাজ করতে হয়। সব সময় নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না। তবে একটু সুযোগ পেলে অন্য ঝলক বেরিয়ে আসে ওর লেখায়। অনিন্দ্য-চন্দ্রিলের কথা আর কী বলি! আর অনুপমের লেখাও ভাল লাগে।
আপনি হিন্দি, উর্দু এত ভাল জেনেও মুম্বই গেলেন না কেন?
আমি ঘরকুনো। আলসেমিও আছে।
পার্টিতে গিয়েও তো মদ খান না...
মদ্যপান আমার কাছে খুব ব্যক্তিগত বিষয়। কয়েক জন কাছের বন্ধুর সঙ্গে বা রাত্রে একা গান চালিয়ে মদ্যপান করি। ওই একলা রাতে নিজের
সঙ্গে দেখা হয়। দেড়শো লোকের মধ্যে আমি কোনও ব্যক্তিগত কাজ করি না। খাওয়া ছাড়া পার্টিতে কিছুই করি না। দু’জন প্রভাবশালী লোক দাঁড়িয়ে থাকলে সামনে গিয়ে হাত কচলাতে পারি না। ব্যক্তি হোক বা রাজনৈতিক দল, হাত কচলানো আমার কাজ নয়।
রাজনীতি না করলে সংস্কৃতি হবে?
রাজনীতি দু’ভাবে হয়। শিল্পের রাজনীতি, শিল্পের বাইরে রাজনীতি। আমার কবিতা কখনও সখনও নিশ্চয়ই রাজনৈতিক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় কবিতায় কথা বলেছি। আসলে এখন রাজনীতি মানে দলে যোগ দেওয়া শুধু নয়। দলের দাস হয়ে যাওয়া। সেটা আমি কোনও দিন করিনি। কবির কাজ দলের বাইরে থেকে সক্রিয় ভাবে রাজনৈতিক থাকা। তার জন্য যে কোনও দল ভাল কাজ করলে সাবাশি দেওয়া যায়। আর খারাপ কাজ করলে তার বিরুদ্ধে লেখা যায়। আজকাল আর অনৈতিক মানুষদের সঙ্গে মিশতে পারি না।
নৈতিক মানুষ বলে আজ কিছু হয়?
শঙ্খ ঘোষ। আমাদের দুর্ভাগ্য একশো জন শঙ্খ ঘোষ আমাদের মধ্যে নেই।
আর সুবোধ সরকার?
নন্দীগ্রামের ঘটনায় যখন আমরা ক্ষুব্ধ, তখন উনি বামফ্রন্টকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। আবার ওঁর আজকের রাজনৈতিক অবস্থান আমার কাছে সমর্থনযোগ্য নয়। তবে আমার লেখালিখির জগতে টানাপড়েনের সময় সুবোধদার অবদান জীবনেও ভুলব না। রাজনৈতিক সুবোধ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ নেই।
কুড়ি বছর পেরিয়ে কোনও আশঙ্কা জন্মেছে?
কবিতা লেখা কিন্তু ক্রিকেট খেলার মতো। বিরাট কোহলি যখন খেলতে নামেন তখন ওঁর স্কোরবোর্ড শূন্য থাকে। আজকেও সাদা পাতার সামনে জীবনের প্রথম কবিতাটাই লিখি আমি।
কবিতা বারবার বিস্মিত করেছে আমাকে। তবে সারা বিশ্বের পরিস্থিতি দেখে আমি শঙ্কিত। কবিতা লিখে, গান গেয়ে কিছু বদলানো যাবে না আর। পৃথিবীটা সন্ত্রাসের হাতে চলে গিয়েছে। তিন-চার মাস কিছুই লিখতে পারিনি।
ইদানীং কিছু কবিতা এসেছে। সম্ভবত আমার জীবনের অন্ধকারতম কবিতা। সেগুলো শুধুই হতাশার কথা বলে। এখন এর মধ্যেই আছি। আস্তে আস্তে এই কবিতার মধ্যে দিয়ে নিজের এবং অনেকের মৃত্যুকে ছুঁয়ে দেখছি।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy