Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

সবার উপরে কালচার সত্য

এমন কোনও মধ্যবিত্ত বাঙালি কি কেউ দেখেছেন, যার ছেলেমেয়েরা একেবারে কম বয়স থেকে হয় লেখে না, না-হয় ছবি আঁকার স্কুলে যায় না, বা গানের স্কুলে, বা নিতান্তই পাড়ায় বা স্কুলে থিয়েটার করে না একেবারে? বা নেহাতই একটা গিটার টুং-টাং করে না? আছে নিশ্চয়ই। তবে তা পাওয়া মুশকিল। ফুল ফুটুক বা না-ই ফুটুক, সংস্কৃতিচর্চার বসন্তকাল বঙ্গজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু কবে থেকে বাঙালি জীবনে এ হেন সংস্কৃতি চর্চার বাড়বাড়ন্ত? রবীন্দ্রনাথের পর থেকে?

ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

ব্রাত্য বসু
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৫৬
Share: Save:

এমন কোনও মধ্যবিত্ত বাঙালি কি কেউ দেখেছেন, যার ছেলেমেয়েরা একেবারে কম বয়স থেকে হয় লেখে না, না-হয় ছবি আঁকার স্কুলে যায় না, বা গানের স্কুলে, বা নিতান্তই পাড়ায় বা স্কুলে থিয়েটার করে না একেবারে? বা নেহাতই একটা গিটার টুং-টাং করে না? আছে নিশ্চয়ই। তবে তা পাওয়া মুশকিল। ফুল ফুটুক বা না-ই ফুটুক, সংস্কৃতিচর্চার বসন্তকাল বঙ্গজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু কবে থেকে বাঙালি জীবনে এ হেন সংস্কৃতি চর্চার বাড়বাড়ন্ত? রবীন্দ্রনাথের পর থেকে? না কি উপনিবেশবাদেরই এ এক অনিবার্য ফল, যার দাদন আজও গিলে চলেছি আমরা? প্রাচীন বঙ্গদেশের সাহিত্য রচয়িতারা বরাবরই দারিদ্র নিয়ে ভেবেছেন, অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে সবিস্তার বলেছেন, ধর্মের কর্মেও তাঁদের আস্থা অটুট, কিন্তু বঙ্গদেশীয় সন্তান মাত্রেই চিরকেলে সংস্কৃতিপিপাসু— মনে তো হয় না। অন্তত সাহিত্যিক নমুনায় এমন কোনও সমাজচিত্র নেই। নবদ্বীপের নিমাই তাঁর দলবল নিয়ে নামসংকীর্তন করেছেন বটে, কিন্তু তাও তো প্রধানত ধর্মীয় ও সামাজিক তাগিদ— সাংস্কৃতিক আত্মপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষা কোথায়? বরং গড়পড়তা বঙ্গদেশীয় মানসিকতা বোঝাতে মধ্যযুগীয় এক পর্তুগিজ পর্যটক, নাম টুমে পিরেস, লিখছেন, ‘যখন ওরা (ভারতীয়রা) কাউকে অপমান করে গালাগালি দিতে চাইত তখন বলত ‘বাঙালি’। অর্থাৎ যারা মূলত শঠ।’ অষ্টাদশ শতাব্দীতেই ঐতিহাসিক আকরগ্রন্থ ‘রিয়াজউস সালাতিন’-এর ভারতবর্ষীয় লেখক মন্তব্য করছেন, ‘দুষ্টবুদ্ধি, নষ্টামি, প্রতারণা ও বদমায়েশিতে বাঙালিদের জুড়ি মেলা ভার।’ আইন-বিশেষজ্ঞ, ইনটেলেকচুয়াল, সদ্য তিরিশ পেরোনো, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মোটা বেতনের চাকুরে লর্ড মেকলে, যিনি পরে ইন্ডিয়ান পিনাল কোড তৈরি করবেন এবং বাংলায় এসেই প্রায় তৈরি করবেন তাঁর সেই বিখ্যাত শিক্ষা-প্রস্তাব, সেখানে পরিষ্কার লিখবেন, “We must at present do out best to create a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern, a class of persons, Indian in blood and colour, but English in taste, in opinions, in morals, as in intellect.” (Minutes on Indian Education: Lord Macaulay, 1835. নিম্নরেখ লেখকের)। শুধু তাই নয়, বাঙালি সম্পর্কে তাঁর সেই বহুলপরিচিত উক্তি, ‘মোষের যেমন আছে শিং, বাঘের যেমন থাবা, প্রাচীন গ্রিকদের ভাষায় মেয়েদের যেমন সৌন্দর্য, বাঙালির তেমন আছে প্রতারণা, লম্বাচওড়া বাক্তাল্লা, চটজলদি অজুহাত, প্রতারণার সূক্ষ্ম বিস্তার, ধূর্ততা, মিথ্যাচার, জালিয়াতি— গঙ্গার নিম্নাঞ্চলের মানুষদের এগুলোই হচ্ছে অস্ত্রশস্ত্র।’

এ সব কথাকে কতটা সিরিয়াসলি নেওয়া উচিত বলতে পারব না, তবে এ তো মানতেই হবে, উপনিবেশবাদের ভাষার হাত ধরে শিক্ষা যেমন এল, তেমনই এল সংস্কৃতিও। তবে সে তো অনেক পরে, সংস্কৃতির একটি নির্দিষ্ট নাগরিক প্যাটার্ন তৈরি হয়ে যাওয়ার পর। আরও খুলে বলতে গেলে, প্রধানত একটি বর্ণহিন্দু সাংস্কৃতিক প্যাটার্ন তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে। কিন্তু মেকলের ওই বিখ্যাত শিক্ষাপ্রস্তাব পাশ হবার আগেই যে সমাজে ওই বিশেষ প্যাটার্নের দাবি উঠে গেছে এবং ওই প্যাটার্ন আত্মস্থ করলে যে অন্তত সাহিত্যে বহির্দেশে খ্যাতি পাবার প্রভূত সম্ভাবনা, তাও ওই মেকলে কথিত ‘চতুর বংগালী’ বুঝছে। এ কথা আমরা বুঝতে পারি ১৮৩৪-এর সাময়িক পত্রে লেখা এক প্রবন্ধে যেখানে প্রাবন্ধিক প্রস্তাব করছেন ‘...তবে তাঁহারদিগের (অর্থাৎ বঙ্গভাষী লেখকদের) উচিত হয় যে তাঁহারা শীঘ্র এক প্রধান সভায় একত্র হইয়া তাঁহারদিগের গ্রন্থ ইঙ্গরেজি অক্ষরে লিখিতে ও মুদ্রাঙ্কিত করিয়া প্রকাশ করিতে স্থির করেন। ...এইক্ষণে হিন্দুদিগের মধ্যে যাঁহারা জ্ঞানবান ও পণ্ডিত তাঁহারদিগের অভিলাষের এই উত্তম পথ খোলা আছে। যদি তাঁহারা তাঁহারদিগের সকল গ্রন্থ ইঙ্গরেজি অক্ষরে লিখেন তবে তাঁহারদিগের বিদ্যা ও বিজ্ঞতা এবং ধর্ম্ম সর্ব্বত্র ইউরোপে এবং অন্য তাবৎ শিষ্ট দেশে বিখ্যাত হইবে।’ (সংবাদপত্রে সে কালের কথা, ২য় খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সংকলিত)

মেকলে এবং এই মতের মূর্তিমান বিরোধিতা তা হলে বঙ্কিম আর মধুসূদন, যাঁরা ওই ‘শিষ্ট’ দেশে খ্যাতি পাবার আকাঙ্ক্ষায় প্রথমে ইংরেজিতে লিখতে শুরু করেও পরে আজীবন বাংলাতেই লিখলেন। অন্য দিকে, লিয়েবেদফ আসার আর বাংলা থিয়েটার কেমন ভাবে করতে হবে তা দেখিয়ে দিয়ে চলে যাবার প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পর বাঙালি শুরু করল নিজস্ব নাট্যচর্চা, তবে তা ইংরেজিতেই। মাঝে মাঝে সংস্কৃতে। আর বাংলার ঘরে ঘরে নাট্যকর্মী জন্মাতে শুরু করল তার প্রায় চল্লিশ বছর বাদে, গিরিশ ঘোষরা যখন শুরু করলেন মধ্যবিত্তের বাংলা থিয়েটার, বাইরে যার নাম ছিল ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। আর বঙ্কিম বা মধুসূদনে যা ছিল ব্রিটিশ বিশ্বায়নপ্রসূত এক ধরনের, যেন-বা দেশের মধ্যেই এনআরআই প্যাটার্ন (যার বিকল্পে তলায় তলায় যদিও সমাজে থেকে গিয়েছিল আলালের ঠগচাচা বা হুতোমের কিস্সা), তার থেকে সাহিত্যকে তুলে নিয়ে মধ্যবিত্তের মধ্যে মুক্তি দিলেন আর এক বিত্তবান এবং নিজেকে ডিক্লাস্ড করতে চাওয়া লেখক রবীন্দ্রনাথ। বিশেষত তাঁর নোবেলপ্রাপ্তি। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যেমন ভারতের অধিনায়কত্ব বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবার পর চারিদিকে ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পের জোয়ার উঠেছিল, প্রায় সে ভাবেই চার দিকে কাব্যসাহিত্যচর্চার বান শুরু হয়ে গেল। নৃত্য বা গানেরও। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বিষয়টা সহজ ছিল না মোটেও। মঙ্গলকাব্য ইতিহাস রচয়িতা আশুতোষ ভট্টাচার্য ‘আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নামক স্মৃতিগ্রন্থে ‘একটি অনুষ্ঠানের বিবরণ’ দিতে স্মরণ করছেন, ১৯২৯-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল-এ আয়োজিত একটি সাংস্কৃতিক সন্ধের কথা। দুই বোন মঞ্চে উঠবে। ছোট বোনটির বয়স আট-নয়, সে, ‘একটু সাজিয়া গুজিয়া মঞ্চে উঠিয়া হাত-পা নাড়িয়া নৃত্যের ভঙ্গি করিবে, পিছন হইতে দিদি হারমোনিয়াম বাজাইয়া একটি রবীন্দ্রসংগীত গাহিবে।’ সংশয় যে ছিল, তাও ছাত্র আশুতোষ বলছেন, কারণ অনুষ্ঠানের নির্ঘণ্টে Dance না লিখে লেখা হয়েছিল action song, কিন্তু ঝামেলা বাধলই। কেননা, ‘অনুষ্ঠান হইয়া যাইবার পরের দিনই ঢাকার ‘ঢাবুক’ পত্রিকা ইহার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় অক্ষরে হেডিং দিয়া ছাপাইল: জগন্নাথ হলে আবার মেয়ে নাচিল।’ নাচ বা গান যে কেন পরবর্তী ক্ষেত্রে বঙ্গজীবনে কেবলমাত্র বিবাহোপযোগিতার কাজে লাগবে কনেদের, তা এই ঘটনা থেকে খানিকটা বোঝা যেতে পারে। এর বহু দিন পরে সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেন। যাঁর সাহিত্য থেকে এই স্বীকৃতি, সারা পৃথিবীর এক জন শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে গড়পড়তা বাঙালি মনে রাখল না তেমন, শুধু ঘরে ঘরে বহু গোদার বুনুয়েল তারকভ্স্কির জন্ম হয়ে গেল। রবীন্দ্রসংগীতের প্রধান প্রকরণ হারমোনিয়াম গিটারে রূপান্তরিত হল গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে নানান কার্যকারণসূত্রে। তারও অবশ্য একটা প্রাগিতিহাস আছে। সেই ইতিহাসের অনুপুঙ্খ বিচারে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ তথা গৌতম চট্টোপাধ্যায় সেই ধারার পথিকৃৎ— বাংলা উপন্যাসের প্রতিতুলনায় তিনিই আমাদের বঙ্কিম; রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র যেমন তার অনেক পরের ঘটনা। কিন্তু ওই যে বাঙালি বুঝতে শুরু করল ‘সংস্কৃতি ছাড়া গীত নেই’, তা তবে ওই উপনিবেশবাদ এবং তার বিরুদ্ধ নিজস্ব চাপ— এই দুইয়ের সমবায়। যা সে নিজের শরীরে ধারণ করল প্রায় নিয়তির মতোই।

কিন্তু তার পর, প্রজন্মর পর প্রজন্ম ধরে কেন বাঙালি বার বার এই ধরনের শিল্পসংস্কৃতিচর্চায় ছেলেবেলা থেকে মনস্ক হয়েছে? বিচারের অন্য একটি প্রেক্ষিতও আছে। কারা মূলত সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতির চর্চা করবে, তা বলতে গিয়ে সাহিত্যদর্পণকার বিশ্বনাথ কবিরাজ স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছিলেন, সূক্ষ্ম বুদ্ধির লোকেরা পড়বে বেদ, তুলনায় মোটা বুদ্ধির মানুষেরা, যাঁরা ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ লাভ করতে চাইছেন, তাঁরা কাব্যসাহিত্যের চর্চা করুন। অর্থাৎ, পাণ্ডিত্যের সাধনা করতে গেলে লাগে শিক্ষা আর বুদ্ধি, আর কাব্যসাহিত্যের চর্চা করতে গেলে তা অতটা না হলেও চলবে। নতুন শতাব্দীর সংস্কৃতিচর্চা ও তার অধিকাংশ কারবারিদের দেখলে কি মনে হয় না, যে কথা বলতে চেয়েছিলেন সাহিত্যদর্পণকার, সেই যজ্ঞ আজ সম্পূর্ণ হয়েছে? চর্চাহীন, শিক্ষাহীন, শীলনহীন, মননহীন এক জাহিরপনায় এসে পড়েছি আমরা, যার মধ্যে আত্মরতি ছাড়া অন্য কোনও ভজনা নেই? এ যেন অনেকটা— লিখতেও পারি, গাইতেও পারি, নাচতেও পারি, অভিনয়ও করতে পারি, নির্দেশনাও পারি— সবই পারি। চাহিদা যেহেতু অনন্ত, জোগানেরও অন্ত নেই কোনও। গত শতাব্দীতে একটি লেখা পড়েছিলাম, যার শিরোনাম ছিল ‘মধ্যমেধার মহাযজ্ঞ’। আজ কি তাও বদলে গিয়ে উপনীত হয়নি নিম্নমেধার মহাযজ্ঞে, যেখানে সবাই মিলে দেখছি ‘শান্ততা, ধর্ষণ চালু আহে’— ‘চোপ, ধর্ষণ চলছে’— ধর্ষিতের নাম মাতৃভাষা! ‘আমি মাঝে মাঝে ব্যঙ্গ করে বলি এখনই যা পড়ার সুযোগ, হয়তো সব মিলিয়ে কুড়ি-পঁচিশ বছর। আর তার পর গোটা ভারতবর্ষ থেকে হয়তো বাংলা ভাষাই উঠে যাবে।’ (অশোক মিত্র: সাক্ষাৎকার, গণশক্তি)

উপরে উদ্ধৃত চাহিদা ও জোগানের বিষয়টি আর একটু বিস্তৃতির অবকাশ আছে। ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন স্বাধীনতার বছরে ভারতীয় রেডিয়ো-শিল্প রেডিয়ো সেট বানিয়েছিল মাত্র তিন হাজার। আর সত্তরের দশকে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়াল দেড় কোটি! নব্বইয়ের দশকে প্রধান মেট্রো শহরগুলিতে গড়ে উঠল এফএম কেন্দ্র, এক একটি শহরে বাড়ি থেকে গাড়ি, সব মিলিয়ে যার সংখ্যা ওই দেড় কোটির অনেক বেশি। পাশাপাশি টিভি চ্যানেল। ‘গাঁধী-উত্তর ভারতবর্ষ’ বইয়ে (রচনা: রামচন্দ্র গুহ, অনুবাদ: আশীষ লাহিড়ী) লেখক দেখিয়েছেন, কী ভাবে রেডিয়োর বাজারকে অধিগত করল এই টিভি চ্যানেল, অতঃপর বেসরকারি চ্যানেলরা কী ভাবে এসে সম্পূর্ণ বিনোদন-বাজারকে গ্রাস করল। ২০০০ সালে ভারতে বেসরকারি চ্যানেলের সংখ্যা ছিল ৭০। আজ তা ৪০০-রও বেশি। পাশাপাশি ২০০৩-এ এক সমীক্ষায় ‘টাইম’ পত্রিকা জানাল, দুনিয়া জুড়ে হলিউড ছবির দর্শকসংখ্যা ২৬ লক্ষ, সেখানে হিন্দি ছবির দর্শকসংখ্যা ৩৬ লক্ষ, অর্থাৎ পাক্কা দশ লাখ বেশি। পরের দশ বছরে এই ব্যবধান বেড়েছে বই কমেনি। আর এই ব্যবসার মোট পরিমাণের তিন গুণ বেশি লগ্নি হয় ভারতের সমগ্র টেলিভিশন ব্যবসাতে। এক আশ্চর্য সময়ে প্রবেশ করলাম আমরা, যেখানে ক্রিকেট, সিনেমা, মার্গসংগীত থেকে শুরু করে মায় খবর পর্যন্ত বিনোদন। প্রতিটি ব্রেকিং নিউজের অধিকারী আসলে এক একটি ছোট ছোট বিনোদন ক্যাপসুলের হিরো বা হিরোইন, অবিকল কিং খান বা কুইন কপূরের মতোই। যে হত্যা করছে এবং যে হত হচ্ছে, যে ধর্ষণ করছে এবং যে ধর্ষিত হচ্ছে, যে অন্যায় করছে এবং যে প্রতিবাদ করছে, প্রত্যেকে আসলে এক একটি বিনোদিত আইটেম, যার তারকা হয়ে ওঠার চাবিকাঠি রয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র গণমাধ্যমের কাছে। নিউজ চ্যানেলের টক-শো নিমেষে রূপান্তরিত হচ্ছে যেন বা বিনোদন চ্যানেলের সিরিয়ালে— যার কুশীলবেরা একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর বদলে বদলে যান অবিকল সিরিয়াল-শিল্পীর মতোই। (লক্ষণীয়, টেলিভিশন ‘টক শো’র নামগুলো পর্যন্ত ওই সিরিয়াল শিল্পের শিরোনামের মতোই)। এ হচ্ছে গণমাধ্যমের নিজস্ব সংস্কৃতি, যার জোর এই সময় দাঁড়িয়ে সবচাইতে বেশি। আর যেহেতু এই নব্য সাংস্কৃতিক প্যাটার্নের খিদে অসীম, অনন্ত, তার জোগানের জন্যই এখন বঙ্গসংস্কৃতি তার নিজস্ব কু বা সুনাট্য তৈরি করে নেবে, যাতে আকণ্ঠ মজে থাকবে হিমালয় সমুদ্র গঙ্গা বিধৌত তাবৎ রাঢ়বঙ্গ। আমি একে সদর্থক একটি ‘সিগনেচার’ হিসেবে দেখতে আগ্রহী, কারণ মার্কিন বিশ্বায়নপ্রসূত এই নব্য সাংস্কৃতিক প্যাটার্ন এক দিকে যেমন অনাবাসী লেখকের মাঝারি লেখাকে পূজ্য করে তুলবে মাতৃভাষার শ্রেষ্ঠ লেখাগুলিকে সরিয়ে রেখে (মেকলের শিক্ষা-প্রস্তাবের মূল নির্যাসটিকে ভুললে চলবে না), তেমনই আবার ওই প্যাটার্নের চৌম্বক শক্তির আকর্ষণে সাংস্কৃতিক জোগানও চলতে থাকবে অবিরাম, যার জোরে মাতৃভাষাতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আত্মপ্রকাশও থাকবে, সে গুণগত ভাবে যেমনই হোক না কেন। শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে আরও অনেক অনেক বছর তা হলে ভাষা ও ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতি এই ভাবেই বাঁচবে তার নিজস্ব প্যাটার্ন সমেত। জয় কালচার! জয় ভালচার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bangali bratya basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE