Advertisement
E-Paper

হে পার্থ, কৌন্তেয়, গুড়াকেশ...

একটা লোকের একটাই নাম থাকবে কেন? জীবনের নানা কীর্তি, গুণ, সম্পর্ক, পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন নাম পাওয়া যাবে না কেন? পদবি ব্যবহার করতে হবে কেন? ভারতের মহাকাব্য ও পুরাণ থেকে নামের অপার স্বাধীনতা শিখব না কেন?নাম মানেই পরাধীনতা, মৃত্যুর পরও স্বাধীনতা নেহি মিলেগা। আমাদের পাড়ায় যে ভদ্রলোককে আজও তাঁর মা ভোঁদু নামে ডাকেন, অফিসে তিনিই নাকি দোর্দণ্ডপ্রতাপ চ্যাটার্জিসাহেব। বন্ধুমহল ডাকে আর জি, বউ ডাকেন রামি। ভোটার কার্ডে নাম রামগোপাল চট্টোপাধ্যায়। এই সব নাম বাছাইয়ে কোনও দিনই তাঁর স্বাধীনতা ছিল না। ভোঁদুবাবু স্বাধীন ভাবে হাঁটতে শেখার ঢের আগেই তাঁর বাবা কৃষ্ণগোপালবাবু নিজের সঙ্গে মিলিয়ে একমাত্র ছেলের নাম রেখেছিলেন।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৫
ছবি সৌজন্য: স্টার জলসা

ছবি সৌজন্য: স্টার জলসা

নাম মানেই পরাধীনতা, মৃত্যুর পরও স্বাধীনতা নেহি মিলেগা। আমাদের পাড়ায় যে ভদ্রলোককে আজও তাঁর মা ভোঁদু নামে ডাকেন, অফিসে তিনিই নাকি দোর্দণ্ডপ্রতাপ চ্যাটার্জিসাহেব। বন্ধুমহল ডাকে আর জি, বউ ডাকেন রামি। ভোটার কার্ডে নাম রামগোপাল চট্টোপাধ্যায়। এই সব নাম বাছাইয়ে কোনও দিনই তাঁর স্বাধীনতা ছিল না। ভোঁদুবাবু স্বাধীন ভাবে হাঁটতে শেখার ঢের আগেই তাঁর বাবা কৃষ্ণগোপালবাবু নিজের সঙ্গে মিলিয়ে একমাত্র ছেলের নাম রেখেছিলেন। অতঃপর ভারতীয় রাষ্ট্রের আইন মোতাবেক এই নামটিই তাঁর বার্থ সার্টিফিকেট থেকে পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাসপোর্ট সর্বত্র উল্লিখিত। ভবিষ্যতে ডেথ সার্টিফিকেটেও ওই রামগোপালের খাঁচা থেকে ভোঁদুবাবুর মুক্তি মিলবে না। নাম মানেই অন্যের ইচ্ছায় খোদাই-করা জগদ্দলটি আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে, কেন না সেটাই আইনসম্মত পরিচিতি, একমেবাদ্বিতীয়ম্ আইডেন্টিটি।

অথচ, ভারতজনেরা কোনও দিনই এই প্রতর্কে বিশ্বাসী নয়। একটা লোকের এক কেন, একাধিক নাম হওয়া উচিত। দরকারে পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বদলে যাবে নাম। কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণ আর অর্জুনের কথোপকথন চলছে। কৃষ্ণ তাঁর বন্ধুকে কৌন্তেয়, পার্থ ইত্যাদি নানা নামে সম্বোধন করছেন। অর্জুনও তাঁকে পদ্মপলাশলোচন, হৃষীকেশ ইত্যাদি বলছেন। অতঃপর গীতার একাদশ অধ্যায়ে এসে অর্জুন আচমকা বললেন, ‘যোগেশ্বর ততো মে ত্বং দর্শয়াত্মানম্ অব্যয়ম্।’ মানে হে যোগেশ্বর, আমাকে সেই রূপ দর্শন করতে দিন। শঙ্করাচার্যের ভাষ্য, এই নামের অর্থ যোগের ঈশ্বর নয়। যোগীদের ঈশ্বর। আরও বলছেন, যোগ শব্দের অর্থ যুক্তি। আরও ভাল ভাবে: ঐশ্বরিক যুক্তি। চটজলদি বলা নাম, সেখানেও তৈরি হয় মহাভাষ্য।

যোগেশ্বর এর পর অর্জুনকে বললেন, ‘হে গুড়াকেশ, এই দেখ, আমার শরীরে সারা বিশ্ব। দিব্যচক্ষু দিচ্ছি, আরও যা যা ইচ্ছা, এই দেখে নাও।’ এখানে আর পার্থ নয়। গুড়াকেশ মানে নিদ্রাজয়কারী। অর্জুনকে এখন ঘুমোলে চলবে না, বিশ্বরূপ দর্শন করতে হবে। দর্শনশেষে অর্জুন ভয়ে, ভক্তিতে আপ্লুত। কৃষ্ণ নিজের নতুন নাম বললেন, ‘কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো’, আমি কাল। লোক ক্ষয় করাই আমার স্বভাব। যথাযথ স্বাধীনতা পেলে নাম মিনিটে মিনিটে বদলে যেতে পারে। সকালে যা আলু-নারকোল, বিকেলে তারই নাম হতে পারে রামতাড়ু।

ফলে, নাম বাঁচাতে গেলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিধির বেড়াজাল ভেঙে স্বাধীনতা আনতে হবে। সে বিধি বলে, আমার নামের সঙ্গে আমার বাবা এবং মা অঙ্গাঙ্গি যুক্ত। কিন্তু আমি কি আমার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দারও উত্তরসূরি নই? আমার শোণিতধারায় কি নেই সেই অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহীর উত্তরাধিকার? মহাভারতের আদিপর্বে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনের সঙ্গে অর্জুনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পর তিনি বারংবার অর্জুনকে ‘তাপত্য’ বলেন। বিস্মিত অর্জুনের প্রশ্ন, ‘আমার মায়ের নাম কুন্তী। তাপত্য হতে যাব কেন? তপতী নামে কাউকে চিনি না।’ তখন চিত্রসেন সূর্যকন্যা তপতীর সঙ্গে রাজা সম্বরণের প্রেমের কাহিনি বলে জানালেন, ‘এই সম্বরণের ঔরসে তপতীর গর্ভে কুরুর জন্ম হয়। তিনি তোমাদের পূর্ববংশীয়া, তাই তাপত্য বললাম।’

নামের স্বাধীনতা আনতে গেলে দৃষ্টিকে তাই করতে হবে প্রশস্ত এবং উদার। পৃথু রাজার মেয়ে, নাম পৃথা। তাকে পালন করলেন কুন্তিভোজ রাজা, তাই সে মেয়ের আর এক নাম কুন্তী। সূতপুত্র কর্ণকে বারংবার তার পালিকা মা রাধার নামে ডাকা হয় রাধেয়। নামকরণে জন্মদাতা মা-বাবার পরিচয় থাকতেই পারে, কিন্তু পালক মা-বাবারও সমান অধিকার। নামের সেই গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা আজ প্রায় লুপ্ত।

কে বলেছে, শুধু পিতৃদত্ত নামের জগদ্দল পাথরেই থাকবে আমার পরিচিতি? গরুড় সমুদ্রের ওপর দিয়ে অমৃত নিয়ে উড়ে যাচ্ছেন, ইন্দ্র বজ্র ছুড়লেন। গরুড়ের কিচ্ছু হল না, ইন্দ্রের সম্মানে তিনি ডানা থেকে একটি পালক খসিয়ে দিলেন। সকলে অভিভূত হয়ে বলল, এত সুন্দর পালক যার, তার নাম সুপর্ণ। মা-বাবার কাছে যিনি গরুড়, অন্যদের কাছে তিনিই সুপর্ণ! আয়োদধৌম্য নামে এক ঋষি তাঁর শিষ্য আরুণিকে বললেন, বাঁধে ফাটল ধরেছে। গিয়ে আটকাও। আরুণি শুয়ে পড়ে ফাটল আটকালেন, তাঁর নাম হল উদ্দালক। দেবতাদের নামও তথৈবচ। ভৃগু তাঁর স্ত্রী পুলোমাকে বাড়িতে রেখে স্নানে গিয়েছেন, এক রাক্ষস সেই স্ত্রীকে হরণের চেষ্টা করল। ঋষির বাড়িতে যজ্ঞকুণ্ডের অগ্নি ছিল, তবু হুতাশন রাক্ষসবধের চেষ্টা করলেন না? ভৃগু রেগে অভিশাপ দিলেন, আজ থেকে তুমি সর্বভুক হবে। তখন থেকেই অগ্নির আর এক নাম: সর্বভুক। মানুষের শাপে দেবতার নতুন নামসৃষ্টি এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরেই ঘটে থাকে। অন্যত্র নয়।

সবাই সবাইকে একটা করে নাম দিচ্ছে। কী আশীর্বাদে, কী অভিশাপে! এখানেই কি নেই গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা? বহুভোগ্যা নারীর সন্তান নিজের নাম, বাবার নাম কিছুই জানে না। তবু গুরু তাকে দিয়ে দিলেন নতুন নাম: সত্যকাম। একটিই নাম এবং পিতৃপদবিলাঞ্ছিত সমাজে কোথায় সেই সত্যদৃষ্টি? এখন অনেকেই পদবি বিসর্জন দিচ্ছেন। অনির্বাণ নামে কবি তাঁর পদবি জানাচ্ছেন মাতৃনামে: ধরিত্রীপুত্র। তাঁর বোন ধরিত্রীকন্যা। নচিকেতা থেকে শ্রীজাত, রূপঙ্কর, শুভমিতা, শ্রাবন্তী, শুভশ্রী অনেকেই নামকে মুক্তি দিয়েছেন পদবির খাঁচা থেকে।

পিতৃদত্ত নাম এবং গোত্র পরিচিতি কেনই বা? পরিবার, রাষ্ট্র এবং সম্পত্তির সুবিধার্থে। কিন্তু ভারত তো পেয়েছিল নাম নিয়ে অন্য স্বাধীনতার স্বাদ। কারও নাম সায়ম্ভুব, কারও স্বরোচিষ, কারও বা বৈবস্বত। কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই ‘মনু’। ‘মনু’ একটা পদ, অফিশিয়াল পোস্ট। এই পোস্টের নামেই সাতটা লোক পরিচিত। ব্যক্তিগত নামের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেয়ে তাঁরা তাঁদের মহান কর্তব্য ও পদাধিকারের অভিজ্ঞানেই পরিচিত। দুনিয়া প্রলয়ে বিনষ্ট না হওয়া অবধি এঁরাই বারংবার রচনা করেছেন নিয়মকানুন, তাঁদের সেই বিধান মেনেই পেরিয়ে গিয়েছে এক থেকে আর এক মন্বন্তর। মন্বন্তর মানে দুর্ভিক্ষ নয়, এক মনু থেকে আর এক মনুর কাল।

সাতটি মনু, ব্যাসদেবও অনেক। যিনি মহাভারত রচনা করেন, তিনি দেখতে কালো, জন্মেছিলেন দ্বীপে। তাই তিনি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। তাঁর পাশে আছেন কৃষ্ণ স্বয়ং। এমনকী, অর্জুনের আর এক নাম কৃষ্ণ। অর্জুনের বউ, কৃষ্ণের সখাও তো কৃষ্ণা! একই নামে একই সময়ে অনেক লোক থাকার স্বাধীনতা। আমার নাম, বাবার নাম, ভাইয়ের নাম, পিসের নাম সব একই সঙ্গে হিজিবিজবিজ! তাতে ঘাবড়ানোর কি আছে? নাম একটাই, প্রত্যেকে নিজের মতো করে ডাকে। কেউ বলে তিনি সাংখ্যের পুরুষ, কেউ বলে অক্ষর, কেউ আত্মা, কেউ বা বলে ব্রহ্ম। সত্য একটাই, ঋষিরা বহু নামে ডাকেন। একম্ সৎ বিপ্রা বহুধা বদন্তি।

এখনকার দুনিয়া অন্য রকম। ফোটোকপি মাত্রেই জেরক্স। ওই মার্কিন সংস্থা ছাড়া আরও অনেকে ফোটোকপি মেশিন তৈরি করে, কিন্তু খেয়াল রাখে কে! চকোলেট মাত্রই ‘ক্যাডবেরি’ আর তথ্য জানার জন্য নেট ঘাঁটার অন্য নাম ‘গুগ্ল করা’। সবার উপরে ব্র্যান্ডনাম সত্য, তাহার উপরে নাই!

কিন্তু ব্র্যান্ড-নেমও পারে না নামের মুক্তি দিতে। নামকে মুক্তি দেওয়ার রাস্তা একটাই। একে কখনও ব্র্যান্ড, আইনি পরিচিতি, ব্যক্তিসত্তার আইডেন্টিটি ইত্যাদি ভাববেন না। স্রেফ ছুরি, কাঁচি, ছাতা, জুতোর মতো ব্যবহার্য একটা জিনিস। গ্রিক রাজা মিনান্দার বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগসেনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন। তিনি প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার নাম কী?’ ভিক্ষুর উত্তর: ‘লোকে আমাকে নাগসেন নামে ডাকে। কিন্তু ওটি স্রেফ ব্যবহারের জন্য তৈরি সংজ্ঞা। ওই নামে কোনও পুরুষ নেই।’ রাজার পালটা প্রশ্ন, ‘পুরুষ না থাকলে এই অন্ন, বস্ত্র কে ভোগ করে? পুরুষ যখন নেই, আপনাকে হত্যা করলেও অপরাধ হবে না। তা হলে বলুন, নাগসেন কে? আপনার এই চুল? এই নখ, দাঁত, চামড়া, প্লীহা, যকৃৎ বা এই থুতু, লালা?’ সন্ন্যাসীর উত্তর: না। রাজা আরও এগোলেন, ‘তবে কি আপনার রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা এগুলিই নাগসেন? ফের উত্তর, ‘না, মহারাজ।’ হাল ছেড়ে দিলেন রাজা, ‘আমি শ্রান্ত। এখনও বুঝতে পারছি না, নাগসেন কে? শুধুই একটি শব্দ?’

এ বার ভিক্ষুর পাল্টা প্রশ্ন, ‘আপনি এখানে কী ভাবে এলেন, মহারাজ?’ রাজার উত্তর, ‘কেন? রথে।’ ভিক্ষুর দ্বিতীয় প্রশ্ন, ‘আচ্ছা, রথ কী? ঘোড়াটা?’ রাজা হাসলেন, ‘না, না, ঘোড়া কী ভাবে রথ হবে?’ ‘তা হলে অক্ষ? চাকাগুলো? লাগাম? ঘোড়ার নাল? না কি এগুলির মিলিত সমষ্টিই রথ?’ ফের রাজার উত্তর, ‘না, তাকেও রথ বলা যায় না।’ নাগসেনের পাল্টা প্রশ্ন, ‘তা হলে কি রথ শব্দমাত্র? মহারাজ, এখনও বুঝতে পারছি না, রথ কাকে বলে।’ রাজা একটু ভেবে বললেন, ‘ওই যে ঘোড়ায় টানা গাড়ি, অক্ষ, চক্র....এর সমাহারকে ব্যাবহারিক সুবিধার কারণে রথ নামে ডাকা হয়।’ নাগসেন হাসলেন, ‘সেই রকম আমার চুল, লোম ইত্যাদি রূপ, বেদনা ইত্যাদি পঞ্চস্কন্ধের সমন্বয়কে ব্যাবহারিক সুবিধার জন্য নাগসেন নামে ডাকা হয়। ওই নামে স্বতন্ত্র কোনও পুরুষ নেই।’

স্রেফ ব্যাবহারিক সুবিধার জন্য তৈরি একটা তুচ্ছ জিনিস। এ বার রাষ্ট্র সেটা আধার কার্ড, পাসপোর্ট কোথায় ব্যবহার করবে, স্কুল-কলেজ মার্কশিট না অ্যাডমিট কার্ড কোথায় কাজে লাগাবে, জনসমাজ অন্নপ্রাশনে, বিবাহবাসরে, মদের আড্ডায় কী ভাবে ব্যবহার করবে তাদের ব্যাপার। কিন্তু ওই নামটি মোটেও আমি নই। এই চিন্তাতেই নামের স্বাধীনতা!

goutam chakraborty goutam independence day
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy