Advertisement
E-Paper

১০০ কোটি মানেই হিট নয়

টলিউডেই বা হিট কারে কয়? খোঁজ নিলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।মুক্তি পাওয়ার মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় হৃতিক রোশন-ক্যাটরিনা কইফের ‘ব্যাং ব্যাং’য়ের ১০৯.৪৯ কোটি টাকা রোজগার করার খবর নিয়ে চারদিকে ধুন্ধুমার কাণ্ড; বলা হল ‘ব্যাং ব্যাং’ নাকি ফাটাফাটি রোজগার করছে। ছবির জন্য হৃতিক পারিশ্রমিক বাড়িয়ে করেছিলেন ৩০ কোটি। রেকর্ড খাতায় এটাই বলিউডের কোনও নায়কের সব থেকে বেশি পারিশ্রমিক! ছবিটি ১০০ কোটি ক্লাবে নাম লেখানোয় হৃতিক-ক্যাটরিনা দারুণ খুশি।

শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০০

মুক্তি পাওয়ার মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় হৃতিক রোশন-ক্যাটরিনা কইফের ‘ব্যাং ব্যাং’য়ের ১০৯.৪৯ কোটি টাকা রোজগার করার খবর নিয়ে চারদিকে ধুন্ধুমার কাণ্ড; বলা হল ‘ব্যাং ব্যাং’ নাকি ফাটাফাটি রোজগার করছে। ছবির জন্য হৃতিক পারিশ্রমিক বাড়িয়ে করেছিলেন ৩০ কোটি। রেকর্ড খাতায় এটাই বলিউডের কোনও নায়কের সব থেকে বেশি পারিশ্রমিক! ছবিটি ১০০ কোটি ক্লাবে নাম লেখানোয় হৃতিক-ক্যাটরিনা দারুণ খুশি।

কিন্তু এই সবের মধ্যে কেউ বললেন না যে, ছবি বানানোর খরচা যেখানে ১৪০-১৫০ কোটি, সেখানে পাঁচ দিনের মাথায় ১০৯.৪৯ কোটি রোজগার করলে তো তাকে ‘হিট’ আখ্যা দেওয়া যায় না। হিটের সনাতনী সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘ব্যাং ব্যাং’কে কম করে ৩০০ কোটি রোজগার করতে হবে। তার আগে ছবিকে সফল বলা গেলেও হিট বলা যায় না।

কারণ একটাই।

বলিউডের নিয়ম অনুযায়ী একটা ছবিকে হিট করতে গেলে তার লগ্নির দ্বিগুণ রোজগার করতে হবে। আর সুপারহিট হতে গেলে ছবিকে লগ্নির দ্বিগুণ রোজগার করার পরেও আরও ৫০% বেশি আয় করতে হবে। যে ছবি শুধুমাত্র লগ্নির টাকাটা তুলতে পারে তাকে বড়জোর অ্যাভারেজ বলা যায়। ‘হিট’ তো নয়ই!


হৃতিক-ক্যাটরিনা। ‘ব্যাং ব্যাং’-য়ে

হিসেবমতো ১০০ কোটির ছবিকে ন্যূনতম ২০০ কোটির ব্যবসা করতে হবে ‘হিট’য়ের শিরোপা পেতে। খুব কঠিন মনে হলেও আদতে এই হিসেব ছোটবেলার অঙ্কের মতোই সহজ। যত লগ্নি করা হয়েছে তার থেকে কত বেশি রোজগার করা হল সেটাই মুনাফা। কিন্তু মজার ব্যাপার হল বলিউডে ছবি ১০০ কোটি, ২০০ কোটির গল্প শোনা গেলেও প্রযোজকরা কিন্তু সন্তর্পণে ছবির বাজেট সম্পর্কে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন! একের পর এক প্রেস রিলিজ আসে কোটি ক্লাবের রমরমা নিয়ে। কিন্তু ছবির বাজেট রহস্যই থেকে যায়।

১০০ কোটি ক্লাবের সদস্য ‘কিক’য়ের বাজেট ছিল ১২০ কোটি। ‘ব্যাং ব্যাং’য়ের বাজেট ১৪০ কোটি। ‘ধুম থ্রি’ও তাই। বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ কোমল নাহাতা তাই বলছেন, “বিজ্ঞাপনে তো যা ইচ্ছে তাই বলেই পার পাওয়া যায়। কিন্তু এটা বুঝতে হবে যে ১০০ কোটি মানেই ছবি হিট নয়। আমার হিসেবে বলিউডের লাস্ট হিট ছবি হল ‘ধুম থ্রি’।”

তা হলে কেন বারবার এই ১০০ কোটি ২০০ কোটির রেকর্ড নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করা হয়? সত্যি কি এই ক্লাবের সদস্য হলে হিটের মুখ দেখা সম্ভব? আগেকার দিনে ছবির বাজেট কম ছিল। এখন তা বেড়ে আকাশচুম্বী জায়গায় পৌঁছেছে। তার সঙ্গে বলিউড আবিষ্কার করেছে নতুন নতুন সব টার্ম। ‘হিট’ বলার থেকে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ‘সফল’ শব্দটা। তাতে সাপও মরে, লাঠিও ভাঙে না।

সনাতনী সংজ্ঞা মেনে ‘হিট’ বলতে বাধা থাকলেও ব্যবসার ‘ভলিউম’ ভাল বলে সাফল্যের মুকুট পরতে অসুবিধা নেই কারও।

রিলায়্যান্স এন্টারটেনমেন্টের চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার শিবাশিস সরকার জানাচ্ছেন, “১০০ কোটি টাকা একটা সফল ছবির পক্ষে এখনও বেশ ভাল দৃষ্টান্ত। আমরা ১০০ কোটি বলতে নেট বক্স অফিস অব ইন্ডিয়ান থিয়েট্রিকাল বিজনেস বুঝি। এখনও পর্যন্ত সেটা ৩০-৩২টা ছবির ক্ষেত্রেই হয়েছে। আর যদি ছবিগুলোর লাভ করার ক্ষমতার দিকটা দেখেন, তা হলে বলা যায় প্রযোজকদের কখনও ক্ষতি হয় না।”

কিন্তু টাকা ‘লস’ না করা মানে তো ছবির অ্যাভারেজ ব্যবসা। তাকে তো ‘হিট’ বলা যায় না। কারণ ১০০ কোটি দিয়ে কেউ ছবি বানালে তো ২০০ কোটি তুলতে হবে হিট হতে গেলে। “না, তা নয়। এই ১০০ কোটি সংখ্যা হল নেট বক্স অফিস অব ডোমেস্টিক থিয়েট্রিকাল অনলি। তাই যদি কোনও ছবি ১০০ কোটি এনবিওসি টাচ করে, প্রোডিউসর ৫০ কোটি পাবে শেয়ার হিসাবে। তার পরে তো ওভারসিজ রাইট আছে, স্যাটেলাইট, মিউজিক, হোম ভিডিয়ো আছে। তাই হিট বা অ্যাভারেজ বলার আগে মোট খরচ আর মোট রেভেনিউয়ের তুলনাটা করতে হবে। কেউ সফল বা ব্যর্থ বলে দিতে পারে না শুধু দেশীয় বক্স অফিস কালেকশন থেকে। পুরো লাভ-ক্ষতিকে বিবেচনা করতে হবে,” জানাচ্ছেন শিবাশিস।

তবে তাঁর মতে এখনও পর্যন্ত, দু’-একটা ছবি বাদ দিয়ে ১০০ কোটির সিনেমাগুলো প্রোডিউসরদের ভাল টাকাই এনে দিয়েছে।

বলিউড ছবির ওভারসিজ বাজার নিয়ে অনেক কথা হলেও খুব কম সংখ্যক তারকার বিদেশে কাটতি ভাল। এর মধ্যে রয়েছেন শাহরুখ খান, আমির খান, খানিকটা হৃত্বিক রোশন আর সলমন খান। কিন্তু বাকিদের সে সুযোগ নেই। তাই সব ছবিই বিদেশে দারুণ ব্যবসা করবে, এমন কল্পনা করা ঠিক নয়।

স্যাটেলাইট দুনিয়ায় এক সময় দারুণ রোজগার হত। “শাহরুখ, হৃতিক, আমির, সলমনের এক-একটা ছবির স্যাটেলাইট রাইটস প্রায় ৪০ কোটি ছুঁয়ে যায়। আমার ধারণা ‘পিকে’ আর ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ স্যাটেলাইট থেকেই ফিল্ম পিছু ৫০ কোটি রোজগার করবে,” বলছেন কোমল।


সলমন-জ্যাকেলিন। ‘কিক’য়ের এক দৃশ্যে

তবে স্যাটেলাইট বাজারেও মন্দা পড়েছে। “চ্যানেলগুলো এখন এক হয়ে ঠিক করেছে যে অস্বাভাবিক দামে ছবি তারা কিনে নিজেদের কবর খুঁড়বে না। তাই অনেক বলিউড ছবির স্যাটেলাইট রাইটস আজকাল বিক্রি হতে সময় লাগছে। ‘হায়দার’য়ের স্যাটেলাইট রাইটস এখনও বিক্রি হয়নি,” জানাচ্ছেন কোমল।

শুধু বলিউড নয়, টলিউডেও সেই একই গপ্প। ছবি মুক্তির দু’তিন দিনের মধ্যেই চারদিকে উত্‌সব শুরু হয়ে যায়। টুইটারে ‘সফল ছবির’ গুণগান। কিছু সপ্তাহ পরে দেওয়ালে দেওয়ালে পড়ে যায় পোস্টার। তাতে বড় বড় করে লেখা অমুক ছবি সগৌরবে ২৫ দিন চলছে। কেউ দাবি করেন ৫০ দিন চলছে ছবি। কিন্তু হলে ক’জন দর্শক থাকে, সেটা কেউ বলেন না।

তার থেকেও বড় ব্যাপার হল হিন্দি ছবি যেখানে ৩ দিনের মাথায় ৩০০০ স্ক্রিনে রিলিজ করে অনেক টাকা রোজগার করতে পারে, টলিউড সে দৌড়ে অনেক পিছিয়ে। বাংলার হলের সংখ্যা মাত্র ৩৫০। তার মধ্যে সব হলে বাংলা ছবি চলে না। তাই ছবি মুক্তি পেল আর সপ্তাহান্তে তা হিট হয়ে গেল এটা তো বাঘের পুঁই ডাঁটার চচ্চড়ি খাওয়ার মতো ব্যাপার। “তবে এখন সবটাই ওপেনিংয়ের খেলা। সেল-য়ের তিন দিন দেখে আমরা একটা ছবিকে ‘প্লাস ফিল্ম’ কি না, তা বলতে পারি। হিট বলতে পারি না। আর ছবি যদি ওপেনিং না নেয়, তা হলে ‘প্লাস ফিল্ম’ও বলা যায় না,” বলছেন ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কৃষ্ণ দাগা। তবে তার সঙ্গে এটাও বলছেন যে হিটের সংজ্ঞাটা এখন পাল্টে গিয়েছে। যদি লগ্নির তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি রোজগার করে, তা হলে সেটাকেই নাকি হিট বলা হয়। দ্বিগুণ রোজগারের স্বপ্ন এ মন্দার বাজারে এখন টলি-বলিতে আর কেউ দেখে না।

তবে বাংলার বাজারে এই ২০ শতাংশ বেশি রোজগার করাটাও চাট্টিখানি কথা নয়। মার্কেট এত ছোট যে সেটা করতেও অনেক কালঘাম ফেলতে হয়। কৃষ্ণর হিসেবে একটা ১০ কোটি টাকার বাংলা ছবিকে যদি ১২ কোটি টাকা রোজগার করতে হয়, তা হলে সেটা কমপক্ষে ৬ সপ্তাহ চলতে হবে। “১০ কোটির ছবি মানে তাতে বড় তারকা থাকবেই। পাবলিসিটিও ভাল হবে। তাই ওপেনিংও ভাল হবে। তবে ৬ সপ্তাহ হাউসফুল হবে, এটা চিন্তা করা যায় না। ১২ কোটি রোজগার করতে গেলে সংগ্রহ গড়ে ৬০ শতাংশ হলেই চলে। তাও কমপক্ষে ৮০টা হলে ৬ সপ্তাহ সেটা চলতে হবে। যদি ২ কোটির ছবি হয়, সেটাকে একই রকম কালেকশন রাখতে হবে ৪ সপ্তাহ ধরে। কারণ ২ কোটির ছবির ওপেনিং একটা ১০ কোটি টাকার ছবির ওপেনিংয়ের মতো হবে না,” জানাচ্ছেন কৃষ্ণ।

আর এই যে ‘মিডল অব দ্য রোড’ বাংলা ছবির রমরমা নিয়ে এত দিন মাতামাতি চলে এসেছে? ভাল রিভিউ আর কিছু দিন হাউসফুল বোর্ড দিয়েই তো টুইটারে ছবিগুলোকে হিট বলে দাবি করা হচ্ছে! “মাল্টিপ্লেক্স-য়ে ভর করে যে বাংলা ছবি হিটের গল্প বলে, তারা আসলে কেউ সিনেমা হল থেকে পুরো কস্ট কভার করতে পারে না। বাংলা মার্কেটটা এত ছোট যে সেটা করা সম্ভবই নয়,” বলছেন অরিজিত্‌ দত্ত, প্রিয়া এন্টারটেনমেন্টের কর্ণধার।

এই ছবিগুলো মুষ্টিমেয় সিঙ্গল স্ক্রিনে চলে। কলকাতার সব ক’টা মাল্টিপ্লেক্সেও বাংলা ছবির দর্শক হয় না। “মাল্টিপ্লেক্সের অঙ্কটা এমন যে দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে প্রযোজকের শেয়ারটা কমতে থাকে। দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে মাল্টিপ্লেক্সের রোজগার বাড়ে আর প্রযোজকের শেয়ার কমতে থাকে। চতুর্থ সপ্তাহে গিয়ে প্রযোজক মাত্র ৩০ শতাংশ পায় ছবির হল কালেকশন থেকে,” বলছেন কৃষ্ণ।

তবে বলিউডের সঙ্গে এখানকার একটা তফাত রয়েছে। এখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রযোজকেরাই ছবি বিতরণের কাজটা করেন। কিন্তু বলিউডে তা হয় না। আর সেখানেই হয় আরেকটা ঝামেলা। ছবি মুক্তি পাওয়ার আগেই প্রযোজক চড়া দামে তা ডিস্ট্রিবিউটরকে বিক্রি করে বসেন। এর ফলে ছবি মুক্তির আগে প্রযোজকের ঘরে ভাল টাকা আসে। হলে ছবি দারুণ ব্যবসা না করলেও প্রযোজক ভেঙে পড়েন না। “কিন্তু ক্ষতি হয়ে যায় ডিস্ট্রিবিউটরের। এ দিকে ১০০ কোটির গল্প ছড়িয়ে যায় বাজারে। আর ডিস্ট্রিবিউটরের নাক, মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। এমন ঘটনা কিছু টেরিটরিতে ‘কিক’য়ের ক্ষেত্রে হয়েছে,” জানাচ্ছেন কোমল।

‘ব্যাং ব্যাং’য়ের ক্ষেত্রেও কিছু অঞ্চলে তার পুনরাবৃত্তি হলেও আশ্চর্য হবেন না অনেকেই।

হিট-মিস

হিট

যে ছবি লগ্নির দ্বিগুণ রোজগার করে

সুপারহিট

যে ছবি লগ্নির দ্বিগুণ রোজগার করার পরে আরও ৫০ শতাংশ বেশি আয় করে

অ্যাভারেজ

যে ছবি শুধুমাত্র লগ্নির টাকাটা তুলতে পারে

প্লাস

যে ছবি লগ্নির টাকা রোজগার করার পর কিছুটা লাভের মুখ দেখে

ফ্লপ

যে ছবি লগ্নির টাকার ৫০ শতাংশ বেশি লস করে

লুজিং

যে ছবি লগ্নির টাকা তুলতে পারে না। তবে লস-টা ৫০ শতাংশের থেকে কম হয়

তথ্যসূত্র: কোমল নাহাতা (বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ)

hit movie bollywood tollywood priyanka dasgupta monetary returns monetary calculation profit
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy