আমাদের দেশের জলবায়ু এমন যে, তার সঙ্গে শরীরের তাপমাত্রার সমতা বজায় রাখতে ঘাম হওয়া একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অতিরিক্ত গরমে শরীরের উত্তাপ বেড়ে গেলে স্বেদগ্রন্থি থেকে ঘাম বেরোয়, যা ত্বক থেকে বাষ্পীভূত হয়ে শরীরকে ঠান্ডা করে। এই জন্য রোদে গেলে, অনেকক্ষণ ব্যায়াম করার পরে বা গরমে থাকলে শরীর নিজে থেকেই সেই তাপমাত্রার ব্যালান্স নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু অনেকের আবার বেশি ঘেমে যাওয়ার ধাত থাকে। ছোট থেকেই তারা বাকিদের তুলনায় বেশি ঘামে। এগুলো কেন হয় তা নিয়ে আলোচনা রইল বিশদে—
ঘাম কেন হয়?
ডা. সুবীর মণ্ডল বললেন, “আমাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস স্বেদগ্রন্থির ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের ত্বকে কিছু রিসেপটর আছে, তারা গরম লাগলে মস্তিষ্কে সিগনাল দেয় ঘাম নিঃসরণের জন্য। তখন হাইপোথ্যালামাস সেই সিগনাল সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমের মাধ্যমে স্বেদগ্রন্থির কাছে পৌঁছে দেয় যে, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়েছে। এ বার ঘাম নিঃসরণের মাধ্যমে তা কমাতে হবে। তখন ঘাম হয়। এই পদ্ধতিতেই শরীর কাজ করে। স্বাভাবিক ভাবে এক্রিন গ্রন্থির মাধ্যমে এ ভাবেই ঘাম বেরোয়। কিন্তু কোনও আপৎকালীন পরিস্থিতিতে, পরীক্ষার আগে বা কেউ ভয় পেলে তখন অ্যাপোক্রাইন গ্ল্যান্ড স্টিমুলেট হয়ে যায়। ফলে অতিরিক্ত ঘাম হয়।” ঝাল খেলেও এই গ্ল্যান্ড উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। তখনও ঘাম বেশি হয়।
হাইপারহাইড্রোসিসের সমস্যা থাকলে
অনেকের আবার হাইপারহাইড্রোসিসের সমস্যা থাকে। বাকিদের তুলনায় এদের ঘাম বেশি হয়। “অনেক বাচ্চাই এত ঘেমে যায় যে, পরীক্ষার সময়ে হাতের ঘামে খাতা ভিজে যায়। পরীক্ষা দিতে পারে না ভাল করে। এদের সিমপ্যাথেটিক নার্ভস অত্যন্ত সক্রিয়। তখন কিছু ওষুধ দিয়ে এই ঘাম কিছুক্ষণের জন্য নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তবে এই ওষুধ নিয়মিত দেওয়া যায় না। কারণ অ্যান্টিসিক্রেশনের ওষুধ দিলে অন্যান্য গ্রন্থি শুকিয়ে যায়। ফলে ড্রাই আইজ়ের মতো বা অন্যান্য গ্রন্থির ক্ষরণ কমে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে,” বলে জানালেন ডা. সুবীর মণ্ডল। তাই প্রয়োজন অনুযায়ী এই ধরনের সমস্যার চিকিৎসা করা হয়।
অতিরিক্ত ঘাম কখন চিন্তার?
যাঁরা সাধারণত খুব ঘামেন না, তাঁরা যদি হঠাৎ অতিরিক্ত ঘামতে শুরু করেন, তখন সতর্ক হতে হবে। এর পিছনে বিভিন্ন রোগবালাই থাকতে পারে। হঠাৎ রক্তে শর্করার মাত্রা কমতে শুরু করলে অস্বাভাবিক ঘাম হতে দেখা যায়। আবার স্ট্রোক হলেও অতিরিক্ত ঘামের উপসর্গ দেখা যায়। ডা. মণ্ডল বললেন, “হঠাৎ খুব ঘামতে শুরু করলে অনেকে ঠান্ডা পানীয় খান বা ঘাম মুছে ভাবেন কমে গিয়েছে। এ সবে সময় নষ্ট না করে, হঠাৎ অস্বাভাবিক বেশি ঘামতে শুরু করলে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন আছে কি না দেখতে হবে। খেয়াল করতে হবে, বুকের চারপাশে, কাঁধে, চোয়ালে, পিঠে ব্যথা বা অস্বস্তি, চাপ-চাপ ভাব আছে কি না। যদি ঘামের সঙ্গে এই ধরনের লক্ষণ থাকে তা হলে দেরি না করে হাসপাতালে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে ট্রপ-আই টেস্ট করে দেখলে বোঝা যাবে স্ট্রোক হয়েছে কি না।” আর মনে রাখতে হবে, জিমে বা শারীরচর্চার সময়ে ঘাম হয় বলে সে সময়ে অতিরিক্ত ঘাম হচ্ছে কি না তা নজর করা সব সময়ে সম্ভব হয় না। কিন্তু এক্সারসাইজ় করতে করতেও স্ট্রোক হয়েছে, এমন উদাহরণ রয়েছে। তাই ঘামের সঙ্গে বুকে অস্বস্তি হলেই সাবধান হতে হবে।
আর যদি দেখা যায়, বুকের চারপাশে কোনও ব্যথা বা অস্বস্তি নেই, শুধু অস্বাভাবিক ঘাম হচ্ছে, এমনকি ঠান্ডাতেও, তখন কাছেপিঠের দোকান থেকে লজেন্স বা মিষ্টি পানীয় খেয়ে নিন। মধুমেহ রোগীদের এই জন্যই সব সময়ে পকেটে দুটো লজেন্স রাখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। এ ছাড়াও হাইপারথাইরয়েডিজ়ম বা উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও অতিরিক্ত ঘাম হতে পারে।
অ্যান্টিপার্সপিরেন্ট কি কার্যকর?
অনেক সময়ে যাঁরা দীর্ঘ আলোয় কাজ করেন বা অভিনয় করেন, তাঁদের অতিরিক্ত ঘামের সমস্যা থাকলে অ্যান্টিপার্সপিরেন্ট দেওয়া হয়। তবে দীর্ঘ দিন এই ধরনের প্রডাক্ট ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে স্বেদগ্রন্থির মুখ আটকে যায়, ফলে স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়। অন্য দিকে বেশির ভাগ অ্যান্টিপার্সপিরেন্টে অ্যালুমিনিয়াম-বেসড কমপাউন্ড ব্যবহার করা হয়, যা অনেক সময়ে স্তনের কোষের ইস্ট্রোজেন রিসেপ্টরের ক্ষতি করে। তাই অতিরিক্ত ঘামে নিয়মিত অ্যান্টিপার্সপিরেন্টের ব্যবহার না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই শ্রেয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)