ছোটদের মানসিক সমস্যা জটিল হচ্ছে দিনে দিনে, যার তল পাওয়া কঠিন। বাচ্চাদের আচরণগত সমস্যা এখনকার মা-বাবাদের কাছে খুব পরিচিত। নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, আত্মবিশ্বাসের অভাব, ভয়, অত্যধিক রাগ... অনুভূতির এমন আরও বহু তীব্র বহিঃপ্রকাশ প্রায়ই প্রত্যক্ষ করেন অভিভাবকেরা। শিশুর চিন্তা, অনুভূতি ও তজ্জনিত আচরণে সমস্যা দেখা দিলে এবং তা নিজেরা সামলাতে না পারলে পেশাদারের সাহায্য নিতে পিছপা হবেন না। এই ধরনের সমস্যায় সাহায্য করতে পারে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি, সংক্ষেপে সিবিটি। কোনও থেরাপিস্টের সাহায্য নিয়ে এই চিকিৎসাপদ্ধতির দ্বারস্থ হলে সহজেই এই সমস্যা দূর করা সম্ভব।
সিবিটি-র গোড়ার কথা
ভাবনা (কগনিশন), অনুভূতি (ইমোশন) এবং আচরণ (বিহেভিয়র)— এই তিনটি পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এদের মধ্যকার যোগসূত্রে কোনও গোলমাল হলেই শুরু হয় সমস্যা। একটি শিশুর ভাবনাচিন্তার কী প্রভাব তার আচরণ বা কাজে পড়ছে, সে বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান কী ভাবে করছে, এই সবটাই তলিয়ে দেখা হয় থেরাপির মাধ্যমে। সাধারণত পাঁচ থেকে কুড়িটি সিটিং দরকার হয় সিবিটি-র ক্ষেত্রে। শিশুর বয়স, পরিণতমনস্কতা, সমস্যার গভীরতা ইত্যাদির উপরে ভিত্তি করে তা কমবেশি হতে পারে। এটি একটি টক থেরাপি, অর্থাৎ কথাবার্তা, প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমেই কাউন্সেলিং চলে। এই আদানপ্রদানের মাধ্যমেই সমস্যার গোড়ায় ঢোকার চেষ্টা করা হয়। বাচ্চাটি যাতে নিজের সমস্যার কারণ নিজেই চিনে উঠতে পারে এবং তা শুধরে নিতে পারে, সেই পথ দেখানো হয়।
সিবিটি যে কোনও বয়সেই কার্যকর হতে পারে। এখানে মূলত প্রাক্ কৈশোর বয়সটি আলোচ্য, যে বয়সে সাধারণত সমস্যা মাথাচাড়া দেওয়া শুরু করে। শিশুদের গড় বয়স যখন আট থেকে তেরো বা পনেরো, তাদের মনের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন চলে। নানা কারণে তাদের মধ্যে যদি অ্যাংজ়াইটি, ডিপ্রেশন, ট্রমা, ফোবিয়া দেখা যায়, সিবিটি এ সব ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
সমস্যা চিহ্নিত করা
কখন বুঝবেন আপনার সন্তানের থেরাপি দরকার? একটা খুব পরিচিত উদাহরণ দেওয়া যাক। অনেক বাচ্চারই স্কুল যাওয়ায় অনীহা থাকে। তার মানেই তার সমস্যা আছে, এমন নয়। কিন্তু কেন সে স্কুলে যেতে চাইছে না, সেটা চিহ্নিত করা প্রয়োজন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বললেন, “ধরুন, একটি শিশুর অঙ্ক পরীক্ষা নিয়ে ভীতি রয়েছে। তাই সে বিষয়টাকে এড়িয়ে চলছে। অঙ্ক না বুঝলে কিংবা অভ্যাস না করলে সে এমনিই কম নম্বর পাবে। ফলে ‘আমি অঙ্ক পারি না’, এই আশঙ্কাটা আরও সত্যি বলে মনে হবে তার কাছে। এ ভাবেই একটা দুষ্টচক্রের মধ্যে ঢুকে পড়বে সেই শিশুটি।” সিবিটি শেখায়, ‘চেষ্টা করলে তুমি পারবে’। “সেই শিশুর সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাকে বোঝানো হয়, যদি সে বিষয়টা বুঝে নিয়ে ভাল ভাবে অভ্যাস করে, তা হলেই রেজ়াল্ট আপনিই ভাল হবে,” বললেন ডা. মুখোপাধ্যায়। এ ছাড়া শিশুদের মধ্যে ওসিডি-র ক্ষেত্রেও এক্সপোজ়ার এবং রেসপন্স বলে এক বিশেষ ধরনের সিবিটি কার্যকর বলে জানালেন তিনি।
হারানো শৈশব
সমস্যা আরও জটিল হওয়ার অন্যতম কারণ প্রযুক্তির প্রভাব, শিশুদের একা হয়ে যাওয়া। চিকিৎসকদের মতে, ছোটদের আচরণগত সমস্যা তৈরি হওয়ার মূলে একাকিত্ব। নিজেকে প্রকাশ করতে না পেরে গুটিয়ে যাওয়া, গ্যাজেটনির্ভরতা বেড়ে চলা, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা, নেতিবাচক চিন্তা বাড়তে বাড়তে ক্ষতিকারক চিন্তা মাথায় চেপে বসা… এই উপসর্গগুলি চোখে পড়তেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
থেরাপির ভূমিকা
থেরাপির মাধ্যমে প্রথমেই নেতিবাচক চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করতে শেখানো হয়। জীবনের প্রতি সদর্থক মানসিকতা গড়ে তোলার জন্য নিজের ভিতরে থাকা সমস্যাগুলিকে নাম দিতে বলা হয় শিশুটিকেই। খাতায়-কলমে লিখে, ছবি এঁকে কিংবা খেলার মাধ্যমেও এই চিহ্নিতকরণ করা সম্ভব। এর পরে যে ভাবনাটি সবচেয়ে বেশি ডিস্টার্ব করছে, সেটিকে বাদ দিতে বলা হয়। এড়িয়ে যাওয়া যে সমাধান নয়, তা বোঝানো হয়। নিজের ভাবনাকে ঠিক ভাবে প্রকাশ করা, নিজের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করা, মানসিক দৃঢ়তা তৈরি করতে সাহায্য করা হয়। ডা. মুখোপাধ্যায় বললেন, “অনেক ক্ষেত্রে কোনও বিশেষ ঘটনা থেকে শিশুমনে ট্রমা তৈরি হতে পারে। আবার কখনও তেমন কিছু না ঘটলেও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সেই বাচ্চাটিকে মানসিক সমস্যার মধ্যে ধীরে ধীরে ঠেলে দিতে পারে। আবার ছোটরা নিজেরাই অনেক কিছু ধরে নিয়ে সেই মতো আচরণ করে। অর্থাৎ অ্যাজ়াম্পশন। এই সব ক্ষেত্রেই থেরাপি কার্যকর।”
অভিভাবকদের ভূমিকা
খারাপ কাজ করলে শাসন করার পাশাপাশি ভাল কাজের প্রশংসা করাও জরুরি। অভিভাবকেরা অনেক সময়েই ছোটদের বক্তব্যটি উড়িয়ে দিয়ে নিজের মতটি চাপিয়ে দেন। সেটা করলে আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি তৈরি হবে। কোনও নেতিবাচক চিন্তা মাথায় এলে তা খারিজ করে না দিয়ে বরং কেন তা এল, সেটা খোঁজ করতে হবে। সন্তানের প্রথম আশ্রয় তার মা-বাবা। তাই তাদের সংবেদনশীলতা সবচেয়ে আগে প্রয়োজন।
ছবি: অমিত দাস; মডেল: রাইমা গুপ্ত, অভিরূপ সেন, মোনালিসা পাহাড়ি শতপথী
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)