আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সারভাইক্যাল ক্যানসার মুক্ত বিশ্ব গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। গত বছর বাজেট অধিবেশনে এ দেশের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনও ৯-১৪ বছরের কিশোরীদের সারভাইক্যাল ক্যানসার বা জরায়ুমুখের কর্কটরোগের টিকা বিনামূল্যে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। তবে চিকিৎসকেরা বলছেন, শুধু মেয়েদের নয়, এই সমস্যাকে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলতে হলে ছেলেদেরও ভ্যাকসিন নেওয়া দরকার।
সারভাইক্যাল ক্যানসারের মূল কারণ হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি)। এ দেশে যে ধরনের কর্কটরোগে মহিলারা বেশি আক্রান্ত হন, তার মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জরায়ুমুখ কর্কটরোগ। প্রতি বছর প্রায় লক্ষাধিক মহিলা এতে আক্রান্ত হন। অথচ একটু সতর্ক হলেই এই কর্কটরোগের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। এই ভাইরাসের প্রায় শতাধিক স্ট্রেন রয়েছে। তার মধ্যে স্ট্রেন নম্বর ১৬ ও ১৮-র জন্য ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে কর্কটরোগ হয়। এইচিপিভি ৬ ও ১১ থেকে সংক্রমিত হলে জেনিটাল ওয়ার্টস অর্থাৎ আঁচিলের মতো উপবৃদ্ধি হতে পারে। এইচপিভির অন্যান্য স্ট্রেনে আক্রান্ত হলেও কর্কটরোগ হওয়ার আশঙ্কা ততটা থাকে না। এই টিকা এইচপিভি ১৬, ১৮ কিছু ক্ষেত্রে ৬ ও ১১-র বিরুদ্ধেও সুরক্ষা দেয়।
ছেলেদের কেন নেওয়া দরকার?
প্রশ্ন হল, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস থেকে যখন মেয়েদেরই সমস্যা বেশি, তখন ছেলেদের টিকা নেওয়া জরুরি কেন? চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের গাইনো-অঙ্কোসার্জন দীপান্বিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “ছেলেরা এই ভাইরাসের বাহক হতে পারেন। যৌন সংসর্গের সময়ে ছেলেদের শরীর থেকে এই ভাইরাস মেয়েদের শরীরে প্রবেশ করে। তাই ছেলেদের টিকা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।” যৌন সংসর্গ ছাড়াও, ওরাল সেক্স-সহ আরও কিছু কারণে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। তবে শুধু মেয়েদের নয়, এই ভাইরাসের কারণে ছেলেদেরও অ্যানাল, জেনিটাল, হেড অ্যান্ড নেক, ওরো-ফ্যারিঞ্জাল কর্কটরোগের সম্ভাবনা থাকে। টিকাকরণের মাধ্যমে এগুলো থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়।
ছেলেদের টিকা কখন দেবেন?
ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এর প্রফেসর জয়দীপ চৌধুরী বলছেন, “মেয়েদের মতো ছেলেদের স্ক্রিনিংয়ের সুবিধে নেই। তাই সতর্কতাও বেশি দরকার।” মেয়েদের ক্ষেত্রে ৯ থেকে ৪৫ বছর অবধি টিকা দেওয়া গেলেও ছেলেদের ক্ষেত্রে এই সময়সীমা কম। “৯ থেকে ২৬ বছর অবধি ছেলেদের টিকা দেওয়া যায়। ১৪ বছর বয়সের মধ্যে নিলে দুটো ডোজ়ে ছেলেদের টিকা দেওয়া হয়। প্রথম ডোজ় নেওয়ার ছ’মাস পরে দ্বিতীয়টি নিতে হয়। ১৫ থেকে ২৬ বছর বয়সিদের ক্ষেত্রে তিনটি ডোজ়। প্রথম ভ্যাকসিনের দু’মাস পরে দ্বিতীয়টি এবং ছ’মাস পরে তৃতীয় ডোজ় দেওয়া হয়।” ইমিউনো-কম্প্রোমাইজ়ড অসুখ অর্থাৎ অল্প বয়সে এইচআইভি আক্রান্ত কিংবা রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট হয়ে থাকলে, সে ক্ষেত্রে যে কোনও বয়সেই ছেলেদের তিনটি ডোজ়ে এই টিকা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে যত কম বয়সে এই ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে, তত তাড়াতাড়ি অনাক্রম্যতা তৈরি হবে।
ইউরোপ ও আমেরিকার বহু দেশেই এখন ছেলে-মেয়ে উভয়েরই এইচপিভি ভ্যাকসিন নেওয়া বাধ্যতামূলক। লিঙ্গ-নির্বিশেষে এই উদ্যোগ নেওয়ায় সে সব দেশে সারভাইক্যাল ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে। বিদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এই টিকা নেওয়া না থাকলে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয় না। সেখানকার স্কুলগুলি থেকেই নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে এই টিকা দিয়ে দেওয়া হয়। তবে এ দেশে এখনও মেয়েদের টিকাকরণেই সরকার সম্পূর্ণ উদ্যোগ নিয়ে উঠতে পারেনি। সুতরাং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ রাখতে ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিতে হবে।
সমস্যা কী?
আর্থিক সমস্যা তো রয়েছেই। সঙ্গে সচেতনতার অভাবও রয়েছে। অধ্যাপক চৌধুরী বলছেন, “বিনামূল্যে যে সব জায়গায় মেয়েদের টিকাকরণ করা হয়েছে, সেখানেও টিকা নেওয়ার সংখ্যা খুব বেশি নয়। আর ছেলেদের ক্ষেত্রে তো এখনও অধিকাংশ পরিবার বিশ্বাসই করে না তাঁদের মাধ্যমে কোনও রোগ ছড়াতে পারে। আবার ‘রোগ হতে পারে’ এই ভেবে টিকা নেওয়ার জন্য খরচ করতেও অনেকে রাজি থাকেন না। ‘হলে তখন দেখা যাবে’ এ ধরনের মনোভাব এড়িয়ে সার্বিক ভাবে সচেতনতা গড়ে তোলাটাই কঠিন।” দেশ জুড়ে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উদ্যোগ নিচ্ছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগী হচ্ছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরাও। এইচপিভি ভ্যাকসিন সম্পর্কে কন্যাসন্তানের অভিভাবকদের পাশাপাশি পুত্রসন্তানের অভিভাবকদেরও সতর্ক করছেন তাঁরা।
টিকাকরণের খরচ
চিকিৎসকদের মতে, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের বয়সে পৌঁছনোর আগে ছেলে, মেয়ে উভয়ের টিকাকরণ হয়ে যাওয়া ভাল। আগে বিদেশ থেকে এই কর্কটরোগ প্রতিরোধক টিকা আনতে হত, দুটো ডোজ়ের দাম পড়ত প্রায় আট হাজার টাকা। এখন ভারতে এই টিকা তৈরি হয়। ফলে খরচ কমে প্রায় অর্ধেক হয়েছে। এই টিকা পুরোপুরি সুরক্ষিত, কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
খুব কম কর্কটরোগের ক্ষেত্রেই আগে থেকে প্রতিরোধ করার সুযোগ রয়েছে। সুস্থ সমাজ গড়তে তাই ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই উদ্যোগ নিতে হবে। কর্কটরোগ-মুক্ত বিশ্ব গড়ার যুদ্ধে তাই প্রত্যেক অভিভাবকেরই সচেতন হওয়া জরুরি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)