আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। শরীরে কোনও সমস্যা নেই। হঠাৎ করেই চিকিৎসক সতর্ক করে বলেন মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। অতি দ্রুত অস্ত্রোপচার না হলে মা ও সন্তান, প্রাণের ঝুঁকি দু’জনেরই। পর্দায় তিনি ‘ওয়্যান্ডার ওম্যান’, কিন্তু বাস্তবে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে হলিউড অভিনেত্রী গ্যাল গ্যাডটকে। চতুর্থ সন্তানের জন্ম দেওয়ার আগে তাঁর ‘ব্রেন ক্লট’ ধরা পড়ে। যদিও অস্ত্রোপচারের পরে গ্যাল ও তাঁর সন্তান দু’জনেই সুস্থ আছেন। তবে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা সত্যিই বিপজ্জনক। এটি কেন হয় এবং কী ভাবে মায়েরা সাবধানে থাকবেন, তা জেনে রাখা জরুরি।
অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ‘ব্রেন ক্লট’ হওয়ার কারণ কী?
সন্তান গর্ভে থাকাকালীন যদি মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধে, তা হলে সেই অবস্থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘সেরিব্রাল ভেনাস সাইনাস থ্রম্বোসিস’ (সিভিএসটি)। এর কিছু লক্ষণ আগে থেকেই বোঝা যায়।
স্নায়ুরোগ চিকিৎসক অনিমেষ কর জানিয়েছেন, প্রচণ্ড মাথাযন্ত্রণা, কথা জড়িয়ে আসা, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হতে শুরু করে। এমনকি শরীরে খিঁচুনি, আসাড়তাও দেখা দিতে পারে। অন্তঃসত্ত্বা পর্বের শারীরিক সমস্যা ভেবে অনেকেই সেগুলিকে গুরুত্ব দেন না। বিশেষ করে তৃতীয় ট্রাইমেস্টারের পরে এমন সমস্যা হতে পারে। আবার প্রসবের চার থেকে পাঁচ সপ্তাহ পরেও মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধার লক্ষণ দেখা দেয় অনেকের।
মস্তিষ্কের ভিতরে রক্ত জমাট বাঁধতে থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়ে। দেহের রক্তের মাত্র দুই শতাংশ মস্তিষ্ক ব্যবহার করে। কিন্তু মস্তিষ্কের কোষ অত্যন্ত সংবেদনশীল, সেই কারণে অক্সিজেন বা শর্করা সরবরাহে সমস্যা হলে দ্রুত এই কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ফলে মস্তিষ্কের ওই কোষগুলো শরীরের যে যে অংশ নিয়ন্ত্রণ করত, ওই সব অংশ তাদের ক্রিয়াশীলতা হারিয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় শরীরে হরমোনের ওঠানামা চলে। এই সময়ে শারীরিক কসরত কম হয়, ফলে অনেকের ক্ষেত্রেই রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা দেখা দেয়। তা ছাড়া জরায়ুর আকার যত বাড়ে, ততই শরীরের নিম্নাংশে বা পেলভিস অঞ্চলে রক্ত সরবরাহ কমতে থাকে। সে কারণেও রক্ত জমাট বাঁধার লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
আরও পড়ুন:
আরও কিছু কারণ থাকতে পারে। অনেক সময়ে বেশি স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খেলে শরীরে খনিজ উপাদানের ভারসাম্য নষ্ট নয়। রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা কম হলে তাকে বলে হাইপোনেট্রিমিয়া। তখন পেশিতে টান ধরা, পেশির অসাড়তা, খিঁচুনি, রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা হতে পারে। আবার পটাশিয়ামের মাত্রা কমে গেলে যে রোগ হয় তাকে বলে হাইপোক্যালিমিয়া। দীর্ঘ দিন ধরে পটাশিয়ামের মাত্রা কম হলে পক্ষাঘাত, রক্ত জমাট বাঁধার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মনের উপর অত্যধিক চাপ, অতিরিক্ত উদ্বেগও ভয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে। আগে থেকে যদি উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেন থাকে, তা হলেও সেটি চিন্তার।
কী ভাবে সাবধানে থাকবেন?
অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ও প্রসবের পরে নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা জরুরি।
এক জায়গায় শুয়ে বা বসে না থেকে হাঁটাহাঁটি করা বা হালকা শারীরিক কসরত করলে ভাল। ফিটনেট প্রশিক্ষকের পরামর্শ নিয়ে সহজ কিছু ব্যায়ামও করা যেতে পারে।
অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় নিজে থেকে কোনও ওষুধ খাওয়া ঠিক হবে না। সামান্য অসুস্থতাতেও চিকিৎসকের পরামর্শ মতোই ওষুধ খেতে হবে। শরীরে যেন জলের ঘাটতি না হয়, তা খেয়াল রাখতে হবে। চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করে পরিমাণ মতো জল ও তরল খাবার খেতে হবে।
পরিবারে যদি কারও উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস, স্ট্রোক, রক্ত জমাট বাঁধা বা থ্রম্বোসিসের ইতিহাস থাকে, তা হলে অবশ্যই চিকিৎসককে জানানা। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় শরীরে হরমোন ও খনিজ উপাদানগুলির বদল হতে থাকে। কাজেই আগে থেকে সতর্ক না হলে বিপদ বাড়তে পারে।
মাথাযন্ত্রণা একটানা হতে থাকলে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলে, সারা ক্ষণ শরীরে অস্বস্তি হতে থাকলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনে এমআরআই করে দেখে নিতে হবে কোনও অস্বাভাবিকতা আছে কি না।
অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কোনও রকম জ়াঙ্ক ফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার, নরম পানীয় খাওয়া চলবে না। ধূমপান ও মদ্যপান বন্ধ করতে হবে।