E-Paper

বাচ্চাদের উচ্চ রক্তচাপ

এটি লুকোনো বিপদ, সচেতনতা এড়াতে পারে জটিলতা

সুনীতা কোলে

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:৫২

উচ্চ রক্তচাপ— শব্দ দু’টি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মধ্যবয়সি বা বৃদ্ধ কারও ছবি। কিন্তু বাচ্চা বা কিশোর-কিশোরীদের রক্তচাপ বাড়বে কেন? পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধবের মধ্যে তাদের তো ‘প্রেশার’ বাড়ার কথা নয়! কিন্তু চিকিৎসকেরা বলছেন, বিষয়টি এতটাও সরল নয়। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কয়েকটি কারণের জন্য এই বয়সেও বেশি থাকতে পারে রক্তচাপ। তা যে খুব বিরল, তেমনও নয়। বরং বিষয়টি ধরা না পড়লেই বাড়তে পারে জটিলতা। স্কুলে বাচ্চার ক্লান্তি, মাথাব্যথা, ঘুমে ব্যাঘাত, মনোযোগের অভাব— এ সব ক্ষেত্রে অভিভাবকেরা ভাবছেন হয়তো শরীর একটু খারাপ বা পড়াশোনার চাপ। অথচ নেপথ্যে থাকতে পারে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা। এ ছাড়া, বর্তমানে পরিবর্তিত জীবনযাপনের জন্যও একদম কমবয়সিদের মধ্যে ধীরে ধীরে বাড়ছে এই সমস্যা।

উচ্চ রক্তচাপের কারণ

শিশুরোগ চিকিৎসক দিব্যেন্দু রায়চৌধুরী জানাচ্ছেন, অল্প বয়সে রক্তচাপ বেশি থাকার মূল কারণ কিডনির নানা সমস্যা।

  • অ্যাকিউট গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস, যার জেরে শরীরে জল-লবণের ভারসাম্য নষ্ট হয়। এতে রক্তচাপ দ্রুত বেড়ে যেতে পারে।
  • নেফ্রোটিক সিনড্রোম— এই রোগের চিকিৎসায় স্টেরয়েড দিতে হয়, যা দীর্ঘ দিন ব্যবহারের জেরে রক্তচাপ বাড়তে পারে।
  • ক্রনিক কিডনি ডিজ়িজ়— দীর্ঘ দিন ধরে কিডনির কর্মক্ষমতা কমে গেলে পরিশোধন ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়। রক্তচাপের হেরফের তারই প্রতিফলন। কিডনিতে টিউমার বা জন্মগত ত্রুটি থাকলেও তা রক্তচাপকে প্রভাবিত করতে পারে।
  • রেনাল আর্টারি স্টেনোসিস রোগে কিডনির ধমনি সরু হয়ে গেলেও রক্তচাপ বাড়তে পারে।

এর বাইরেও রয়েছে প্রাইমারি হাইপারটেনশন, যে ক্ষেত্রে কোনও স্পষ্ট কারণ চিহ্নিত করা যায় না। যদিও এটি প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। বাড়িতে পূর্বজদের কারও যদি কিডনির অসুখ, ডায়াবিটিস বা উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তবে বাচ্চার ঝুঁকিও বাড়ে।

বদলে যাওয়া জীবনযাপন

চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বর্তমান জীবনযাত্রা বাচ্চাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। কম শারীরিক পরিশ্রমের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে প্যাকেটজাত, জাঙ্ক খাবার খাওয়ার প্রবণতা ও অতিরিক্ত স্ক্রিনটাইম। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে মানসিক চাপেরও প্রভাব রয়েছে অনেকটাই। শিশুরোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ জানাচ্ছেন, প্রভাব ফেলছে অনিয়মিত ও কম ঘুমের বিষয়টিও। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, সকালে স্কুলে গেলেও বড়দের মতো বাচ্চারাও বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকছে। এই ধরনের জীবনযাপন বাচ্চাদের মেটাবলিক সমস্যা তৈরি করে। অতিরিক্ত ওজন, ফ্যাটি লিভার, ইনসুলিন রেজ়িস্ট্যান্সের সমস্যা দেখা দেয়। যার হাত ধরে আসতে পারে উচ্চ রক্তচাপ।

রক্তচাপ মাপার প্রয়োজনীয়তা

শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের রক্তচাপ মাপার প্রবণতা কিছুটা কম বলে জানাচ্ছেন ডা. রায়চৌধুরী। তিনি বলছেন, “এর জন্য প্রেশার মাপার যন্ত্রে ঠিক মাপের কাফ থাকা প্রয়োজন, না হলে রিডিং ভুল আসবে। সদ্যোজাত, শিশু, কিশোর-কিশোরী— বিভিন্ন বয়সের জন্য উপযুক্ত কাফ দরকার। এ ছাড়া, অন্তত ৫ মিনিট বিশ্রামে থাকার পরে রক্তচাপ মাপা উচিত।” কোনও কারণে রিডিং বেশি এলে আরও দু’-এক বার মাপার পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি। ছ’মাস অন্তর রুটিন চেক আপে একবার রক্তচাপ মাপার পরামর্শ তাঁর। তবে বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা আগের চেয়ে অনেকটাই বেড়েছে। যার জন্য কম বয়সে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যার বিষয়টি ধরাও পড়ছে এখন। ফলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যাচ্ছে।

চিকিৎসা

চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এই ক্ষেত্রে কারণভিত্তিক চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি কিডনির অসুখ বা জন্মগত ত্রুটি থাকে, তবে সেগুলির চিকিৎসাই প্রথম লক্ষ্য। এর পরে প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে হবে ওষুধ। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না রাখলে পরবর্তী ক্ষেত্রে বাড়ে হৃদ্‌রোগ, কিডনি ফেলিয়োর, স্লিপ ডিসঅর্ডার, ওবেসিটির আশঙ্কা।

কী করণীয়

কম বয়সে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়লে পরবর্তী জীবনেও সেই সমস্যা রয়ে যায়। ফলে সুস্থ থাকার জন্য সংযত জীবনযাত্রা মেনে চলা জরুরি। প্রাথমিক ভাবে জীবনযাত্রার পরিবর্তনই রোগের প্রভাব অনেকটা কমাতে পারে। খাবারের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত নুন, ভাজাভুজি, প্যাকেটজাত খাবার, ফাস্ট ফুড এড়াতে হবে। পর্যাপ্ত ঘুম খুব জরুরি। চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ বিশেষ জোর দিচ্ছেন শিশুদের নির্দিষ্ট ঘুমের সময় বজায় রাখার দিকে। রোজ অন্তত৮-৯ ঘণ্টা ঘুম তাদের প্রয়োজন। এ ছাড়া, পড়াশোনা বা কাজ ছাড়া স্ক্রিনটাইম বেঁধে রাখতে হবে ১-২ ঘণ্টার মধ্যে। পর্যাপ্ত জলপান, আনাজপাতি খাওয়া ও প্রতিদিন অন্তত ৪০ মিনিট সক্রিয় শারীরচর্চার পরামর্শও দিচ্ছেন তিনি।

শিশুদের রক্তচাপ বাড়ে না, এই ভুল ধারণা থেকেই বিপদ শুরু হয়। সমস্যা সময়মতো চিহ্নিত হলে সামান্য চিকিৎসাতেই তা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তাই নিয়মিত চেক-আপ, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও সক্রিয় জীবনযাত্রাই নিরাপদে রাখবে ছোটদের।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Blood Pressure

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy