E-Paper

স্বরযন্ত্রে টিউমার

গলার স্বর দীর্ঘ দিন ধরে বসে থাকলে, তা চিন্তার কারণ হতে পারে। কোন উপসর্গ দেখলে সাবধান হবেন, জানালেন বিশেষজ্ঞ।

ঊর্মি নাথ

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২৫ ১০:১২

ঋতু পরিবর্তনের সময়ে আবহাওয়ার বদলে অনেকের জ্বর, সর্দিকাশি, গলাব্যথা হয়, গলার স্বর বসে যায়। এই সমস্যাগুলি দীর্ঘস্থায়ী হয় না, কিছু দিন পরে শরীর আবার সুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু যদি দেখা যায় কয়েক সপ্তাহের বেশি সময় গলার স্বর বসে আছে তা হলে ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন আছে বইকি। সর্দিকাশি না হয়েও যদি সপ্তাহখানেক ধরে গলার স্বর বসে যায়, তা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

এই প্রসঙ্গে ইএনটি বিশেষজ্ঞ ডা. অর্জুন দাশগুপ্ত বললেন, “ঠান্ডা লেগে বা না লেগেও গলার স্বর বসে যেতে পারে, তবে স্বর যদি দু’-তিন সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না আসে, তা হলে ল্যারিংক্স বা স্বরযন্ত্রে টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ল্যারিঞ্জিয়াল টিউমার বিনাইন হোক বা ম্যালিগন্যান্ট, তার অন্যতম উপসর্গ গলার স্বর বসে যাওয়া!” গলার ভিতরে থাকে ল্যারিংক্স বা স্বরযন্ত্র, এটির জন্যই আমাদের গলা দিয়ে শব্দ বার হয়। এ ছাড়া ল্যারিংক্স শ্বাসপ্রশ্বাস পরিচালনা করে। ল্যারিংক্সের এপিগ্লোটিস শ্বাসনালিতে খাবার প্রবেশে বাধা দেয়।

স্বরযন্ত্রে টিউমার মানেই কর্কটরোগ নয়

ল্যারিঞ্জিয়াল টিউমার হওয়া মানেই ক্যানসার নয়। টিউমারটি বিনাইন নাকি ম‍্যালিগন‍্যান্ট তা বোঝা যায় বায়পসি করার পরে। যদিও তার আগে বিশেষ কিছু উপসর্গ দেখে চিকিৎসকেরা আন্দাজ করতে পারেন। তবে টিউমার বিনাইন বা ম্যালিগন্যান্ট যেটাই হোক, উপসর্গগুলি হল— গলার স্বর বসে যাওয়া, কিছু ক্ষেত্রে খাবার খেতে অসুবিধা, শ্বাস নিতে সমস্যা ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে ডা. দাশগুপ্ত বললেন, “গলার স্বর বসে যাওয়ার সঙ্গে যদি কাশি হয়, কানে ব্যথা হয়, শ্বাস নিতে বেশ অসুবিধা হয়, ওজন কমতে থাকে তা হলে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে নিশ্চিত হতে বায়পসি করা হয়।”

বিনাইন টিউমার সাধারণত রক্ত জমাট বেঁধে হতে পারে। আঘাত থেকে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। বিশেষ করে যাঁরা অনেকক্ষণ উচ্চস্বরে চিৎকার করে কথা বলেন, চিৎকার করে গলা দিয়ে নানা আওয়াজ বার করেন বা গলার স্বরের উপরে যাঁদের প্রতিনিয়ত অত্যধিক চাপ পড়ে তাঁদেরও রক্ত জমাট বেঁধে ফোসকার মতো হতে পারে, যাকে হেমাটোমা বলে। “এ সবের বাইরে ল্যারিঞ্জিয়াল প্যাপিলোমা হতে পারে, অর্থাৎ ল্যারিংক্সে আঁচিলের মতো টিউমার জন্ম নেয় এবং ক্রমশ তা বড় হয়। এতে শুধু স্বর বসে যাওয়া নয়, শ্বাস নিতেও বেশ কষ্ট হয়, এক কথায় ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হয়। ঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ল্যারিঞ্জিয়াল প্যাপিলোমা বয়স্কদের হতে পারে, আবার ছোটদেরও। গর্ভবতী মায়ের জরায়ুতে প্যাপিলোমা থাকলে ও তাঁর সন্তানের স্বাভাবিক প্রসব হলে শিশুটির ল্যারিঞ্জিয়াল প্যাপিলোমা হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়,” বললেন ডা. দাশগুপ্ত। সাধারণত দেখা যায় শিশুটির তিন-চার বছর বয়সেই ল্যারিংক্সে আঁচিলের মতো তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে একাধিক বার অপারেশন করতে হয়। কারণ এক বার অপারেশন করে নির্মূল করে দেওয়ার পরে আবার প্যাপিলোমা হতে পারে। একটা বয়স পর্যন্ত এটি বারবার হয়। এক একজনের সাত-আটবার পর্যন্ত অস্ত্রোপচার করাতে হতে পারে। ১২-১৫ বছরের পর থেকে প্যাপিলোমার বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণত তার পর আর কোনও সমস্যা থাকে না।

শৈশবে এত বার অস্ত্রোপচার হলে মা-বাবার মনে চিন্তা জন্মায়, শিশুটি আদৌ কথা বলতে পারবে কি না, তা নিয়ে। এ ব্যাপারে ডা. দাশগুপ্ত বললেন, “বারবার অস্ত্রোপচার হওয়ায় প্রভাব পড়ে কণ্ঠস্বরে। তাই খুব জোরে চেঁচিয়ে কথা বলা বা আওয়াজ করতে পারবে না। কিন্তু কথা বলতে সমস্যা হবে না। এক কথায় স্বাভাবিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে না।”

ল্যারিঞ্জিয়াল টিউমারের ক্ষেত্রে ম্যালিগন্যান্সি পাওয়া যায় সাধারণত বয়স্কদের মধ্যে। তাঁদের মধ্যে আবার পুরুষের সংখ্যা বেশি। অতিরিক্ত ধূমপান এর অন্যতম কারণ। এ ছাড়াও প্রতিনিয়ত কোনও ধাতু, কাঠ, কয়লা পোড়ার ধোঁয়া ও ধুলোর মধ্যে থাকলে, শ্বাসের মধ্য দিয়ে তা গ্রহণ করলে কর্কটরোগের আশঙ্কা বাড়ে। মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানও ক্ষতিকর বলে জানালেন চিকিৎসক।

চিকিৎসা পদ্ধতি

ল্যারিঞ্জিয়াল টিউমারের চিকিৎসা অস্ত্রোপচার। “টিউমার নিরাময় শুধু ওষুধ দিয়ে সম্ভব নয়। টিউমার যেমনই হোক না কেন, মাইক্রোসার্জারি করে বাদ দেওয়া হয়। লেজ়ার ব্যবহার করা হয়। এটা বেশ সূক্ষ্ম অপারেশন, আলট্রা থিন নাইফ ব্যবহার করা হয়। অস্ত্রোপচারের পর সে দিনই রোগীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ম্যালিগন্যান্সি থাকলে অস্ত্রোপচারের পরে প্রয়োজন মতো কেমোথেরাপি বা রেডিয়োথেরাপি দেওয়া হয়। ল্যারিঞ্জিয়াল টিউমার এক বার সার্জারির পরে ফিরে আসার সম্ভাবনা কম, যদি না প্যাপিলোমা বা আঁচিল হয়,” ব্যাখ্যা করে বললেন ডা. দাশগুপ্ত।

ল্যারিঞ্জিয়াল টিউমারের রোগীরা মনে করেন, আগের মতো গলার স্বর হয়তো ফিরে পাবেন না। বিশেষ করে সঙ্গীতশিল্পী, বাচিকশিল্পী, রেডিয়ো জকি, অধ্যাপক, অভিনেতা... যাঁদের জীবিকার সঙ্গে গলার স্বরের প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে। ডা. দাশগুপ্তর কথায়, “অস্ত্রোপচারের পরে গলার স্বরের একদম ক্ষতি হবে না বললে মিথ্যা বলা হবে। টিউমার বিনাইন হলে রোগীর কণ্ঠস্বরের বিশেষ তফাত হবে না। কণ্ঠস্বর বাঁচানোর জন্য সব রকম সাবধানতা নেওয়া হয়। কিন্তু টিউমার ম্যালিগন্যান্ট হলে তখন চিকিৎসকদের কাছে গলার স্বর বাঁচানো সেকেন্ডারি হয়ে যায়। রোগীকে ক্যানসার থেকে মুক্ত করাই প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া ভয়েস প্রিজ়ার্ভিং সার্জারি হয় অর্থাৎ কণ্ঠস্বর সংরক্ষণ করে অপারেশন করা যায়।”

সার্জারির পরের সময়টাও সাবধানে থাকতে হয়। ৪৮ ঘণ্টা কথা বলা যাবে না। সেই সময়ে হালকা খাবার খেতে হয়। খেয়াল রাখতে হবে, যাতে কণ্ঠস্বরের উপরে বেশি চাপ না পড়ে। গলার স্বর আগের অবস্থায় নিয়ে আসার জন্য, এখন স্পিচ থেরাপির ব্যবস্থাও রয়েছে। গলার স্বর আগের অবস্থায় আসবে না এই চিন্তা রোগীর মনের উপরেও চাপ ফেলে। সে ক্ষেত্রে মনোবিদের পরামর্শ নিতে হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

ENT ENT specialist

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy