E-Paper

হাত কাঁপার সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়

কয়েকটি বিশেষ ধরনের ব্রেন স্ট্রোকে তার পরবর্তী জটিলতা থেকে হাত কাঁপতে পারে। দীর্ঘ দিন ধরে নানা ধরনের মাদক দ্রব্য সেবনের ফলেও বেশি বয়সে হাত কাঁপার কথা শোনা যায়।

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২৫ ০৮:৫৩

পারকিনসন’স ছাড়াও আরও নানা রোগে হাত কাঁপার সমস্যা দেখা দিতে পারে। সমাধান কোন পথে?

প্রাতঃভ্রমণের পরে আজকাল চায়ের আড্ডা এড়িয়ে চলেন পঁচাত্তরের বিমল। এর মধ্যে একদিন তাঁর হাত থেকে গরম চা চলকে পাশের জনের গায়ে পড়ে গিয়েছিল। আসল কারণ তাঁর হাত কাঁপা। চায়ের কাপ, জলের গ্লাস বা কোনও কিছু ধরতে গেলে তাঁর হাত কাঁপে, যা ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রায় একই সমস্যা আটষট্টির রমার। কারণে অকারণে তাঁর হাত কেঁপেই চলেছে। কোনও জিনিস ধরাই সমস্যা। না পারছেন চেকে সই করতে, শাড়ি পরতে, না পারছেন বোতাম লাগাতে। এঁদের মতো বহু বয়স্ক মানুষ প্রতিনিয়ত সম্মুখীন হচ্ছেন এমন সমস্যার। এই না পারার অসহায়তা তৈরি করছে অবসাদ। কিন্তু এমন সমস্যার সমাধান যে নেই, তা নয়।

সমস্যাটি কেন হয়?

অধিকাংশের ধারণা হাত কাঁপা মানেই বার্ধক্যজনিত সমস্যা। যার পরিচিত নাম পারকিনসন’স। মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার এই প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘বার্ধক্য একটা কারণ, কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। হাত কাঁপার অনেক ধরন আছে। অনেকের হাত অনবরত কাঁপে, কোনও জিনিস ধরার শক্তি পান না, লিখতেও পারেন না। এর উল্টোটাও হয়, অনবরত হাত কাঁপছে কিন্তু কাজের সময়ে স্টেডি। কারও শুধু কোনও জিনিস তুলতে গিয়ে বা লেখার সময়ে হাত কাঁপে, অন্য সময় নয়। অনেকের হাতের সঙ্গে মাথাও কাঁপে। অনেকের আবার কথা বলার সময়ে হাত উপরে ওঠে-নামে। ব্যক্তিটির কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না হাতের উপরে! এগুলো নার্ভের সমস্যা। একত্রে বলে ইনভলান্টারি মুভমেন্ট ডিজ়অর্ডার।কোরিয়া, পারকিনসন’স, অ্যাথেটোসিস, মায়োক্লোনাস, হান্টিংটন’স ডিজ়িজ় ইত্যাদি এই ডিজ়অর্ডারের অন্তর্গত।’’

সব হাত কাঁপা যে পারকিনসন’স নয়, সেই ব্যাপারে সহমত নিউরোলজিস্ট ও স্ট্রোক স্পেশ্যালিস্ট ডা. জয়ন্ত রায়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘হাত কাঁপলেই চিন্তা হয়, পারকিনসন’স নয় তো! এই চিন্তা নিয়েই অধিকাংশ জন আমাদের কাছে আসেন। কিন্তু পারকিনসন’স বাদ দিলে হাত কাঁপার পরিচিত যে সমস্যা, তাকে বলে, এসেনশিয়াল ট্রেমর বা বিনাইন ফেমিলিয়াল ট্রেমর। এর কারণ জেনেটিক। বাবা, মা বা পরিবারে রক্তের সম্পর্কের কারও মধ্যে এই রোগ থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তা চলে আসার সম্ভাবনা থাকে। এটার মতোই আর একটি হাত কাঁপার অসুখ হল, স্পাইনোসেরেবেলর এটাক্সিয়া বা এসসিএ। এটাও জেনেটিক অসুখ। এর ১২ নম্বর ভেরিয়েন্ট, এসসিএ-১২ অনেকটা এসেনশিয়াল ট্রেমরের মতো দেখতে লাগে। এই সমস্যা ভারতীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। আমি মনে করি, জিনগত কারণ বা অটোসোমাল ডমিন্যান্ট হাত কাঁপার প্রধান কারণ।’’ এ ছাড়া আরও অনেক রকম নিউরোলজিক্যাল ডিজ়অর্ডার আছে, যার জন্য হাত কাঁপতে পারে। সে ক্ষেত্রে মেডিক্যাল টেস্ট ও পারিবারিক ইতিহাস জানা ছাড়া শনাক্ত করা মুশকিল।

বয়সজনিত ও বংশগত সমস্যার বাইরে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হাইপারথাইরয়েডিজ়ম। এর জন্য হাত কাঁপে, বুক ধড়ফড় করে, কারও শরীর কাঁপে, মাথা কাঁপে। শরীরে মাত্রাতিরিক্ত তামার পরিমাণ বেড়ে গিয়েও এই সমস্যা হয়। যাকে বলে উইলসন’স ডিজ়িজ়। এই রোগের অন্যতম লক্ষণ নিয়ন্ত্রণহীন নড়াচড়া, খাবার চিবোনোয় সমস্যা, কথা বলায় জড়তা। শরীরে হঠাৎ করে সংক্রমণ হলেও হাত কাঁপতে পারে। ‘‘বেশ কিছু ওষুধ, বিশেষ করে মানসিক সমস্যা নিরাময়ের ওষুধ দীর্ঘ দিন ধরে খেলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় হাত কাঁপে। তখন ওষুধ বদলে দিয়ে সমস্যার সমাধান করা যায়,’’ বললেনডা. রায়।

কয়েকটি বিশেষ ধরনের ব্রেন স্ট্রোকে তার পরবর্তী জটিলতা থেকে হাত কাঁপতে পারে। যদিও এ সমস্যা সকলের হয় না। দীর্ঘ দিন ধরে নানা ধরনের মাদক দ্রব্য সেবনের ফলে বেশি বয়সে হাত কাঁপার কথা শোনা যায়। সমস্যা হয় নেশামুক্তির সময়ে। দীর্ঘ দিন ধরে নেশার দ্রব্য সেবন করার পরে হঠাৎ বন্ধ করে দিলে হরমোনে ক্যাফেন না যাওয়ার ফলে শরীর প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। তখন হাত কাঁপার মতো সমস্যা হয়। আবার বহু দিন ধরে মদ্যপান করার ফলে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে লিভারের অসুখ থেকে মস্তিষ্কে সমস্যা তৈরি হয়।

চিকিৎসা

হাত কাঁপার শিকার শুধু বয়স্করা নন, অল্পবয়সি-মধ্যবয়সিরাও। কম্পনের মাত্রা, রোগীর পারিবারিক ইতিহাস, তাঁর নিজের ব্যাধির ইতিহাসের উপরে নির্ভর করে এর চিকিৎসা। হাত কাঁপার যেমন রকমফের আছে, তেমন ব্যক্তি ও বয়স বিশেষে চিকিৎসার পার্থক্য হয়। ‘‘অনেক বয়স্ক মানুষ আসেন যাঁদের হাত মৃদু কাঁপে। এর জন্য তাঁদের কাজেকর্মে বিশেষ সমস্যা হয় না। সে ক্ষেত্রে আমরা কোনও ওষুধ দিই না। তবে ফলোআপে থাকতে বলি। আবার অনেকে আসেন, যাঁদের জিজ্ঞেস করে জানা যায়, অনেক কম বয়স থেকে অল্প-অল্প হাত কাঁপে। সে সময়ে যেহেতু সমস্যা হয়নি তাই চিকিৎসার প্রয়োজন মনে করেননি। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা বেড়েছে, তার প্রভাব পড়ছে কাজে। এ সব ক্ষেত্রে অবশ্যই ওষুধ দেওয়া হয়। তবে ওষুধ রোগ নির্মূল করে না, নিয়ন্ত্রণ করে,’’ বললেন ডা. রায়। সমস্যার সমাধানে ওষুধের পাশাপাশি অবস্থা বুঝে হাঁটা-চলা, ব্যায়াম, ফিজ়িয়োথেরাপি করানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।

‘‘এ ছাড়া মধুমেহ, উচ্চ রক্তচাপ, হাইপারথাইরয়েডিজ়ম ইত্যাদি কোমর্বিডিটি থাকলে সেগুলো ওষুধ ও ডায়েটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। অনেকে বিপদ এড়াতে বাড়ির বয়স্ক মানুষটিকে রান্না করা, সাইকেল চালানো ইত্যাদি নিত্য দিনের কাজ থেকে বিরত রাখেন। ধরে নেন তাঁদের কাজ না করাতেই সমাধান। এখানেই ভুল হয়ে যায়। তিনি আরও অথর্ব হয়ে পড়েন। মানুষটি নিজেও তাঁর এই পরিণতি বয়সের দোহাই দিয়ে মেনে নেন। তৈরি হয় মানসিক অবসাদ। শিশুদের মতো বয়স্কদের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা বাড়ির লোকেদের নজর করা জরুরি,’’ বললেন ডা. তালুকদার। নিরাময়ের জন্য ডিপ ব্রেন স্টিমুলেশন বা ব্রেনে পেসমেকার বসানোর পথ খোলা থাকে। পারকিনসন’স ডিজ়িজ় বা এসেনশিয়াল ট্রেমরের ক্ষেত্রে খুব সমস্যা হলে তবেই এই পথ বাতলানো হয়।

ঊর্মি নাথ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Parkinson's disease

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy