এক সময়ে মানুষ মিউজ়িক সিস্টেমে গান শুনত। সেখানে যন্ত্রটির সঙ্গে শ্রবণযন্ত্রের দূরত্ব বজায় থাকত। এখন প্রযুক্তির সুবিধা অনুযায়ী দিনের একটা বড় অংশ প্রত্যেকেই হেডফোন বা ইয়ারফোন ব্যবহার করছেন। অফিসের কল থেকে শুরু করে বাড়িতে বা পথে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে ছোট্ট ডিভাইসগুলি। কিন্তু তার ফলে শ্রবণশক্তির ক্ষতি হচ্ছে। একই সঙ্গে অল্প বয়সেই অনেকেই বধির হয়ে যাচ্ছেন। হেডফোন বা ইয়ারফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সময় থাকতেই সতর্ক হওয়া উচিত।
আরও পড়ুন:
সমস্যা কোথায়
‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেল্থ অ্যান্ড কেয়ার এক্সেলেন্স’ (ব্রিটেন)-এর একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ৫০ বছর বয়সের পর মানুষের শ্রবণশক্তি ৪২ শতাংশ কমে যায়। ৭০ বছরের বেশি বয়সের মানুষদের ক্ষেত্রে তা প্রায় ৭১ শতাংশ। প্রতি দিন দীর্ঘ সময় ধরে ইয়ারফোন ব্যবহারের ফলে যে বধিরতা ক্রমশ ঊর্ধমুখী, সে কথাই জানালেন নাক, কান ও গলার চিকিৎসক অরিন্দম দাস। বললেন, ‘‘এক সময়ে বয়স্কদের ক্ষেত্রে শোনার সমস্যা বেশি হত। কিন্তু এখন অল্পবয়সিদের মধ্যেও এই সমস্যা দ্রুত বাড়ছে। তার একটা বড় কারণ ইয়ারফোন।’’
অরিন্দম জানালেন, অনেক ক্ষণ ধরে অল্প শব্দমাত্রা (৫০ থেকে ৬০ ডেসিবেল) এবং কয়েক সেকেন্ডের জন্য উচ্চ শব্দমাত্রা (১০০ ডেসিবেল) ব্যক্তির শ্রবণশক্তি মুহূর্তে নষ্ট করে দিতে পারে (সাডেন সেন্সরিনিউরাল হিয়ারিং লস)। অর্থাৎ কানের স্ট্রোক। অরিন্দম বললেন, ‘‘অল্পবয়সিদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ঘটনা বেশি দেখা যাচ্ছে। ফলে যে কোনও একটি কানে তৎক্ষণাৎ তারা আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না।’’
হঠাৎ করে কানে তালা বা ঝিঁঝি ধরলে বা কানে শুনতে না পারলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে, তা সারিয়ে তোলা সম্ভব বলে জানালেন অরিন্দম। কিন্তু দেরি হলে ব্যক্তি ওই কানে শ্রবণশক্তি চিরকালের জন্য হারাতে পারেন। অরিন্দমের কথায়, ‘‘সারা দিন হেডফোন রয়েছে। বাস, ট্রেন, চারপাশের এত সাউন্ড। এখন মিউজ়িক কনসার্টেও উচ্চস্বরে শব্দ ব্যবহার করা হয়। সব মিলিয়ে প্রতি দিন আমাদের কানের উপরে চাপ সৃষ্টি হয়।’’ কানে হঠাৎ করে তালা লাগলে চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে কোনও ড্রপ ব্যবহার না করার পরামর্শ দিলেন অরিন্দম।
কেন বাড়ছে উচ্চ স্বর
একটি সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, ভারতে ২.৯ শতাংশ জনগণ কোনও না কোনও সময়ে শ্রবণশক্তি সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগেছেন। মোবাইল এবং ল্যাপটপ আসার পর হেডফোনের ব্যবহারও বেড়েছে। তার সঙ্গেই দৈনন্দিন জীবনে কাজ এবং বিনোদনের ক্ষেত্রে হেডফোনের ব্যবহারের নেপথ্যে অতিমারি এবং লকডাউন অনেকাংশে দায়ী বলেই মনে করছেন অরিন্দম।
ক্যাসেটের ক্ষেত্রে সঙ্গীত খুব জোরে শুনলে তা খারাপ শোনাত। তাই ক্যাসেট প্লেয়ারে খুব বেশি শব্দ বাড়ানো সম্ভব ছিল না। সিডি প্লেয়ারে শব্দ আরও কিছুটা বাড়ে। এখন ইয়ার বাডসের ‘ইন-ইয়ার’ প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর সঙ্গে সঙ্গীত বা কথোপকথনের অভিজ্ঞতাকে আরও ‘পার্সোনাল’ করে তুলেছে। কারণ, তা আশপাশে অন্য কারও বিরক্তির কারণ হচ্ছে না। পাশাপাশি, উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে ৭০ ডেসিবেল অতিক্রম করলেও গান বা কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। ফলে অনেকেই উচ্চৈস্বরে ইয়ারফোন ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন।
‘নয়েজ় ক্যানসেলিং’ প্রযুক্তি
এখন বাজারের বেশির ভাগ ইয়ারফোনে উন্নত নয়েজ় ক্যানসেলিং প্রযুক্তি রয়েছে। অর্থাৎ, যার সাহায্যে বাইরের শব্দ ব্যবহারকারীর সঙ্গীত বা কথোপকথনের অভিজ্ঞতাকে নষ্ট করে না। অরিন্দম বললেন, ‘‘নয়েজ় ক্যানসেলেশন তৈরি করতেও তো একটা বিশেষ মাত্রার শব্দের প্রয়োগ করা হয়। পাশাপাশি, এই ধরনের ইয়ারফোন বেশি ক্ষণ ব্যবহার করলে মাথাব্যথা শুরু হতে পারে।’’
আরও পড়ুন:
কোন ইয়ারফোন ব্যবহার করা উচিত
বাজারে এখন ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ১ লক্ষ টাকার ইয়ারফোন পাওয়া যায়। কিন্তু খরচ কমাতে অনেকেই সস্তার ইয়ার বাড্স ব্যবহার করেন। অরিন্দমে মতে, এই ধরনের ডিভাইসে নিরাপত্তা সুরক্ষিত থাকে না। তাই দীর্ঘ ব্যবহারে অন্তঃকর্ণের ক্ষতি হতে পারে। তাঁর কথায়, ‘‘এই ধরনের ইয়ারফোনে সেফটি ফিচার থাকে না। সেগুলি কী দিয়ে তৈরি বা ভলিউম বাড়ানোর সঙ্গে আদতে কত ডেসিব্ল শব্দ তৈরি করছে, তা জানারও কোনও উপায় নেই।’’ তাই শ্রবণশক্তি ভাল রাখতে নামী কোম্পানির ইয়ার বাড্স বা হেডফোন ব্যবহার করা উচিত।
কত ক্ষণ ব্যবহার করা উচিত
অরিন্দম জানালেন, দিনের মধ্যে ৮ ঘণ্টার বেশি ইয়ারফোন ব্যবহার করা উচিত নয়। তার মাঝেও বিরতি নিতে পারলে ভাল হয়। ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজ়েশন (হু) এই প্রসঙ্গে মানুষের জন্য সর্বাপেক্ষা ৮৫ ডেসিবেল শব্দমাত্রাকে নিরাপদ হিসেবে উল্লেখ করেছে। হেডফোনের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশের নীচে শব্দমাত্রা রাখা উচিত। কিন্তু ১ ঘণ্টার পরে বিরতি নেওয়া উচিত। চিকিৎসকদের মতে, সারা দিন ব্যবহার করলে শব্দমাত্রা ৬৫ ডেসিবেল অতিক্রম না করাই শ্রেয়।