ভারতীয়দের খাদ্যাভ্যাসে দ্রুত বদল ঘটে চলেছে। তাল মিলিয়ে বাড়ছে স্বাস্থ্যহানির ঝুঁকি। এক সময়ের সুষম, ঘরোয়া আহার আজ বদলে গিয়েছে তেল-মশলায় ভরা ভাজাভুজি, জাঙ্ক ফুড, অতিরিক্ত মিষ্টিজাত খাবারে। এই পরিবর্তনই এখন ডায়াবিটিস, স্থূলত্ব আর হৃদ্রোগের মতো রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছে। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় এমনই তথ্য মিলেছে।
আইসিএমআর-ইন্ডিয়াবি (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ-ইন্ডিয়া ডায়াবিটিস প্রজেক্ট) থেকে দেশের নানা প্রান্তের ১৮,০৯০ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে নিয়ে এই সমীক্ষা করা হয়। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ‘নেচার মেডিসিন’ জার্নালে। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ঐতিহ্যবাহী খাদ্যাভ্যাস এবং সচল জীবনযাপন এখন উচ্চ কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার এবং স্থবিরতায় বদলে গিয়েছে। অংশগ্রহণকারীদের গড় বয়স ছিল ৪০ বছর। পুরুষ এবং নারীর সংখ্যা ছিল সমান সমান। দেখা গিয়েছে, প্রাপ্তবয়স্কদের এক তৃতীয়াংশ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, আর ৯ শতাংশ নতুন ভাবে টাইপ ২ ডায়াবিটিসে আক্রান্ত। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য, প্রায় ৪১ শতাংশ মানুষ প্রি-ডায়াবিটিসে ভুগছেন, অর্থাৎ ভবিষ্যতে তাঁদের ডায়াবিটিস হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
ভারতীয়দের গড় বিপাকহার এখন ২২.২। তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৪৩ শতাংশ মানুষের ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি এবং ২৬ শতাংশ স্থূলত্বের শিকার। তলপেটে অতিরিক্ত চর্বি জমেছে প্রায় ৩৬ শতাংশ মানুষের শরীরে, যা হৃদ্রোগের ঝুঁকি অনেকটা বাড়ায়। কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়েও আশঙ্কাজনক তথ্য মিলেছে। সব মিলিয়ে ভারত এখন এক নীরব অতিমারির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যার নাম কার্ডিয়ো-মেটাবলিক ডিজ়িজ়।
ডায়াবিটিস, স্থূলত্ব আর হৃদ্রোগের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। ছবি: সংগৃহীত।
সমীক্ষা বলছে, গ্রামের মানুষের তুলনায় শহরের মানুষ কম সক্রিয় জীবনযাপন করেন, বেশি সময় ধরে বসে কাজ করেন, আর বেশি ক্যালোরিযুক্ত খাবার খান। মহিলাদের মধ্যে কর্মহীনতা ও স্থূলত্বের সমস্যা বেশি, পুরুষদের মধ্যে রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের সমস্যা বেশি। যদিও গ্রামের তুলনায় শহরের জনসংখ্যার মধ্যে মদ্যপান এবং ধূমপানের প্রবণতা কম।
ভারতের দিকভেদেও রোগের প্রকোপের হেরফের রয়েছে। যেমন, ভারতের উত্তর ও পশ্চিম দিকে স্থূলত্ব ও ডায়াবিটিসের মাত্রা সবচেয়ে বেশি, পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব তেমন ক্ষতিগ্রস্থ নয় এ দিক থেকে। ডায়াবিটিসের কথা বললে, পশ্চিমে সর্বোচ্চ এবেং পূর্ব ও উত্তর-পূর্বে সর্বনিম্ন।
এই সমস্যার মূল কারণ এ দেশের খাবারের ধরনধারণ। প্রতি দিনের খাদ্যতালিকার বড় অংশ এখন নিম্নমানের কার্বোহাইড্রেট, যেমন সাদা ভাত, ময়দা ও চিনি। খাবারে প্রোটিনের পরিমাণ কমে গিয়েছে, বেড়েছে স্যাচুরেটেড ফ্যাট। খাদ্যাভ্যাসে ভারসাম্য হারানোর ফলেই ডায়াবিটিস এবং স্থূলত্বের সমস্যা বাড়তে শুরু করেছে। যাঁরা কার্বোহাইড্রেট বেশি পরিমাণে খান, তাঁদের মধ্যেই এই ধরনের রোগের ঝুঁকি বেশি লক্ষ করা গিয়েছে। শুধু সাদা ভাত বাদ দিয়ে অন্য শস্য খেলেই যে বড়সড় পার্থক্য দেখা যাবে, তা-ও নয়, কারণ মোট কার্বোহাইড্রেট গ্রহণের পরিমাণ বেশি থেকে যাচ্ছে। তবে যদি খাবারে কার্বোহাইড্রেটের একটি অংশের বদলে প্রোটিনের পরিমাণ বাড়ানো যায়, তা হলে সুফল মিলতে পারে বলে জানা গিয়েছে গবেষণায়। দুগ্ধজাত প্রোটিন প্রি-ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি কার্যকর, আর ডিমের প্রোটিন ডায়াবিটিস রোধে বিশেষ ভাবে সহায়ক বলে দেখা গিয়েছে।
তাই পুরো খাদ্যাভ্যাস বদলে ভারসাম্য আনতে হবে। অতিরিক্ত সাদা ভাত, গম ও মিষ্টি কমিয়ে দিতে হবে। তার জায়গায় রাখতে হবে দুধ, ডিম, মাছ আর শাকসব্জি। পাশাপাশি, প্রতি দিন অন্তত কিছুটা হাঁটাহাঁটি, সিঁড়ি ওঠা বা হালকা শরীরচর্চা করা জরুরি।