রাতে ঘুমের মধ্যে মাসল ক্র্যাম্পের যন্ত্রণা অনেকেরই হয়। সবাই ভাবেন, জলশূন্যতার জন্য এমনটা হচ্ছে। কিন্তু জল খেয়েও সব সময়ে সমস্যা মেটে না। অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো দেখা যাবে পায়ের পাতা, গোড়ালির কাছে ত্বকের রং কালচে হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি বললেন, শিরা-ধমনিতে রক্তচলাচল ব্যাহত হচ্ছে। ডাক্তারি ভাষায় একে বলে ভ্যাসকুলোপ্যাথি।
ভ্যাসকুলোপ্যাথির অর্থ
আমাদের শরীরের শিরা, উপশিরা, ধমনিকে এক কথায় বলা হয় ভ্যাসকুলা। প্যাথি-র অর্থ রোগ, অর্থাৎ শিরা-উপশিরা-ধমনি সংক্রান্ত সমস্যাকে বলা হয় ভ্যাসকুলোপ্যাথি। হৃৎপিণ্ড থেকে ধমনির মাধ্যমে অক্সিজেনপূর্ণ রক্ত বুক-পেট, হাত হয়ে পায়ে পৌঁছয়। শরীরের প্রতিটি কোষ রক্ত থেকে অক্সিজেন নেওয়ার পরে অক্সিজেনমুক্ত বা কার্বনডাইঅক্সাইড পূর্ণ রক্ত শিরার মাধ্যমে আবার হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে। ভ্যাসকুলোপ্যাথির কারণ যদি শিরা হয়, তা হলে সেটি হল ভেনাস ভ্যাসকুলোপ্যাথি। আর কারণ যদি ধমনি সংক্রান্ত হয়, তা হলে আর্টেরিয়াল ভ্যাসকুলোপ্যাথি।
পেরিফেরাল আর্টেরিয়াল ডিজ়িজ়
ভ্যাসকুলোপ্যাথি শরীরের যে কোনও অংশে হতে পারে, তবে বেশি লক্ষ করা যায় পায়ে। এ প্রসঙ্গে মেডিকেল কলেজের জেরিয়াট্রিক মেডিসিনের চিকিৎসক ডা. অরুণাংশু তালুকদার বললেন, “হৃৎপিণ্ড থেকে ধমনিগুলো যত নীচের দিকে যায়, তত তার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম শাখাপ্রশাখার বিস্তার হয়। প্রতিটি ধমনির মধ্য দিয়ে রক্ত পায়ের দিকে যায়। এখন কোনও কারণে যদি নীচের দিকের ধমনিগুলো ব্লক হয়ে যায়, তা হলে রক্তপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। যেখানে বাধা পায় সেই অংশে অক্সিজেন না পাওয়ার জন্য কোষগুলো প্রাণহীন হয়ে যায়। একে বলে পেরিফেরাল আর্টেরিয়াল ডিজ়িজ়। হাত ও পায়ের অংশকে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় পেরিফেরি। তবে এক দিনে এই সমস্যা হয় না। ধীরে ধীরে অক্সিজেন প্রবাহ কমে রোগ দেখা দেয়। পেরিফেরাল আর্টেরিয়াল ডিজ়িজের প্রধান কারণ, ধমনির ভিতরের দেওয়ালে কোলেস্টেরল জমা হওয়া, যা রক্ত চলাচলের পথ সরু করে দেয়।” হাই কোলেস্টেরল, থাইরয়েড, ওবেসিটি, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ থাকলে আর্টেরিয়াল ভ্যাসকুলোপ্যাথির আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। ডা. তালুকদারের কথায়, “গবেষণায় দেখা গিয়েছে যাঁদের ডায়াবিটিস আছে এবং অতিরিক্ত ধূমপান করেন তাঁদের আর্টেরিয়াল ডিজ়িজ়ের আশঙ্কা অন্যদের চেয়ে আটগুণ বেশি।”
ক্রনিক ভেনাস কনজেশন
অনেক সময়ে ধমনিতে বাধাহীন ভাবে রক্তচলাচল হয়, কিন্তু পায়ের দিক থেকে শিরাবাহিত হয়ে রক্ত হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসার সময়ে সমস্যা হচ্ছে। “পায়ের মধ্যে ছোট ছোট ভালভ আছে, সেগুলো স্কুইজ় করে রক্ত উপর দিকে তুলে দেয়। কোনও কারণে ভালভগুলির ক্ষতি হলে সে আর উপরের দিকে রক্ত তুলতে পারবে না। ফলে নীচের দিকে রক্ত জমে থাকবে, শিরায় কনজেশন হবে। রক্ত বেশি জমে গেলে তার থেকে জলের অংশ বাইরে বেরিয়ে আসে। এতে পা ফুলে যায়। জমাট রক্তের মধ্যে থাকা হিমোগ্লোবিন বেরিয়ে চামড়ার নীচে কালশিটের মতো হয়ে যায়। এই সমস্যার নাম ক্রনিক ভেনাস কনজেশন।”
ভেনাস কনজেশন গর্ভাবস্থায় খুব স্বাভাবিক। এই সময়ে জরায়ুর আয়তন বাড়ে, তার চাপ পড়ে জরায়ুর শিরার উপরে। তাই ছ’-সাত মাসের গর্ভবতী মায়েদের পা ফুলে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। সন্তান প্রসবের পরে এই সমস্যা আবার মিটে যায়। “যাঁরা প্রতি দিন দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে কাজ করেন, তাঁদেরও ভেনাস কনজেশন হয়ে পা ফুলে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। আর একটি বড় কারণ ওবেসিটি। শরীর ভারী হয়ে পায়ের উপরে অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এ ছাড়া টিউমার হলে, লিভার খারাপ হলে শিরার উপরে চাপ পড়লে ভেনাস কনজেশন হতে পারে,” বললেন ডা. তালুকদার।
বুঝবেন কী করে
পায়ে ভ্যাসকুলোপ্যাথির একাধিক উপসর্গ রয়েছে। আর্টেরিয়াল ডিজ়িজ়ের ক্ষেত্রে পায়ের পাতায় অতিরিক্ত ঠান্ডা অনুভব করা, অসাড়তা, হাঁটার সময়ে ঝিনঝিন করা... এই ধরনের সমস্যা ফেলে রাখলে ধমনিতে রক্তপ্রবাহ কমে গিয়ে কোষগুলো মারা যাবে এবং কালসিটের মতো ছাপ পড়বে। “ডায়বেটিক রোগীর পায়ের পাতা, গোড়ালির দু’পাশে, আঙুলে কালো দাগ, ঘা হয়। একে বলে ডায়াবেটিক ফুট আলসার। এটি পায়ে ভ্যাসকুলোপ্যাথির পরিচিত সমস্যা,” বললেন ডা. তালুকদার।
ভেনাস কনজেশন হলে পায়ের পাতা ভারী লাগবে। হাঁটুর নীচ থেকে গোড়ালি অবধি বা থাইয়ের পাশে শিরা দড়ির মতো পাকিয়ে যাবে, যা চামড়ার উপর থেকে দেখা যাবে। পায়ে ব্যথা হবে, পেশিতে টান লাগবে। পা থেকে রক্ত হার্টে পৌঁছতে পারছে না, ফলে জমে থাকছে এবং তাতে ক্র্যাম্প হচ্ছে। ভেনাস আলসার হওয়ার প্রবণতা আবার গোড়লির দু’পাশে। ডা. তালুকদার বলছিলেন, “পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে হবে ভ্যাসকুলোপ্যাথির কারণ ধমনি না শিরা। সেটা জানার পরেই চিকিৎসা সম্ভব। শিরা ও ধমনির কাজ যেমন আলাদা, তেমন এদের থেকে উদ্ভূত সমস্যার চিকিৎসাও আলাদা।”
এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা ক্ষত সারানোর ওষুধ দেওয়ার পাশাপাশি জীবনযাত্রা বদলানোর পরামর্শও দেন। ধূমপান, মদ্যপান বন্ধ করতে হবে। ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টরেল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ডায়েট, শারীরচর্চা ও চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধের মাধ্যমে। নিতে হবে পায়ের যত্ন। রোজ বাইরে থেকে এসে পা পরিষ্কার করতে হবে। বিশেষত যাঁরা ডায়াবেটিক। খেয়াল রাখতে হবে, পা যেন ভিজে না থাকে, পায়ে যেন ঘাম না জমে। পা গরম রাখা প্রয়োজন। ডায়েটে প্রচুর পরিমাণে ফল খাওয়া দরকার, পরামর্শ চিকিৎসকদের।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)