মানুষের হৃদ্পিণ্ডের সচলতা যখন কমে যায়, তখন যান্ত্রিক ভাবে সেটাকে পূর্ব অবস্থানে নিয়ে আসতে পেসমেকার ব্যবহার করা হয়। তেমনই আমাদের মস্তিষ্কের কোনও অংশ যদি ঠিক ভাবে কাজ না করে, তখন মানুষের হাত-পা কাঁপে, তিনি বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেন না, খেতেও সমস্যা হয়। এগুলি মূলত স্নায়ুজনিত রোগ। এর ফলে অনেকে পার্কিনসন’স, ডিসটোনিয়া, ট্রেমর বা এপিলেপ্সির মতো রোগে ভুগতে পারেন। মূলত মস্তিষ্কের সংশ্লিষ্ট অংশে ইলেকট্রিকাল ডিসচার্জ ঠিক মাত্রায় না হওয়ার ফলে দেখা দেয় এমন সমস্যা।
মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বললেন, “এই ডিসচার্জকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য একটি বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে ইলেকট্রিকাল ইমপাল্স দিতে হয়, যাকে বলে ‘ডিপ ব্রেন স্টিমুলেশন’ (ডিবিএস)। মস্তিষ্কের পিছন দিকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে দুটো বৈদ্যুতিন তার বসানো হয়। ওই তারের দুটো সূক্ষ্ম অংশ কানের পাশ দিয়ে বার করে, চামড়ার নীচ দিয়ে এনে কলার বোন-এর নীচে বসিয়ে দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী, ওই যন্ত্রটিই তার পরে গোটা প্রক্রিয়াটিকে চালনা করে। ছোটবেলায় যে ভাবে দুটো তার নিয়ে ইলেকট্রিক্যাল স্পার্ক করে ‘ফায়ারিং’ করা হত, ঠিক তেমনই এই যন্ত্রটি চালু করে মস্তিষ্কের সংশ্লিষ্ট স্থানে খুব সূক্ষ্ম মাত্রার ইলেকট্রিক্যাল ইমপাল্স পাঠানো হয়। এতে মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক্যাল ডিসচার্জকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।” মেশিনটি একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর ওই ইলেকট্রিক্যাল ইমপাল্স তৈরি করে, ফলে শরীরের কাঁপুনি নিয়ন্ত্রণে থাকে। ডা. তালুকদারের মতে, গত ৩০-৪০ বছর ধরে এই প্রক্রিয়া নিয়ে নানা কাজ হচ্ছে এবং যে সব রোগে হাত-পা কাঁপার লক্ষণ থাকে, তা নিরাময়ের চেষ্টা চলছে।
পার্কিনসন’স, ডিসটোনিয়া এবং ট্রেমরের ক্ষেত্রে স্পেসিফিক নিউক্লিয়াসকে টার্গেট করা হয়। যেমন, পার্কিনসন’স-এর ক্ষেত্রে মূলত সাব-থ্যালামিক নিউক্লিয়াসকে আর ডিসটোনিয়ার ক্ষেত্রে গ্লোবাস প্যালিডাস ইন্টারনাসকে টার্গেট করা হয়। আর ট্রেমর বা কাঁপুনির ক্ষেত্রে টার্গেট করা হয় ভেন্ট্রাল ইন্টারমিডিয়েট নিউক্লিয়াস অব থ্যালামাস (ভিম)।
এই ডিবিএস বসানোর পরে বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে জানাচ্ছেন ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস, কলকাতার মুভমেন্ট ডিজ়অর্ডার স্পেশালিস্ট জ্যাকি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “মূলত দুই থেকে তিন রকমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। একটা যেমন ইমিডিয়েট সাইডএফেক্ট, যেগুলো মূলত অস্ত্রোপচার সংক্রান্ত। এ ক্ষেত্রে রক্তক্ষরণ, সংক্রমণ বা হার্ডওয়্যার সংক্রান্ত সমস্যা হয় কখনও-সখনও। হয়তো রোগীর বুকে কোনও আঘাত লাগল, পেসমেকারের সঙ্গে কোনও তারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সে ক্ষেত্রে ওই তার বদলে নতুন তার লাগাতে হয়।” যদিও এগুলি বিরল বলেই দাবি ডা. গঙ্গোপাধ্যায়ের।
তবে সাধারণত এ ক্ষেত্রে স্টিমুলেশনের সমস্যাই বেশি দেখা যায়। সার্জনরা নির্দিষ্ট স্থানে ডিবিএস লাগিয়ে দেওয়ার পরে সেটা প্রোগ্রামিংয়ের মূল কাজটা করেন মুভমেন্ট ডিজ়অর্ডার স্পেশালিস্টরা। এই প্রোগ্রামিং-এর সময়ে যখন মেশিনটি চালু করা হয়, তখনই এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ধরা পড়ে। যেমন, সাবথ্যালামিক নিউক্লিয়াস-এর পাশ দিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ট্র্যাক্ট যায় মস্তিষ্কে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে পরিচিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হল কর্টিকো স্পাইনাল ট্র্যাক্ট সংক্রান্ত। এমনিতে যে দু’টি তার মস্তিষ্কের পিছনে শল্যচিকিৎসকরা আটকান, তার চারটে করে ‘কনট্যাক্ট পয়েন্ট’ বা যোগক্ষেত্র থাকে। এই আটটি কনট্যাক্ট পয়েন্টের মধ্য়ে সবচেয়ে কার্যকর পয়েন্টটি খুঁজে বার করার চেষ্টা করা হয় প্রোগ্রামিং-এর মাধ্যমে।
প্রসঙ্গত, এখানে সবচেয়ে কার্যকর কনট্যাক্ট পয়েন্ট হল সেটাই, যেটাতে কম বিদ্যুৎ দিয়ে সর্বাধিক ফল পাওয়া যায়। হতেই পারে দু’টি পয়েন্টে কারেন্ট বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রোগীর মুখ বেঁকে গেল, চোখে দুটো করে দেখতে লাগলেন, হাত-পা বেঁকে গেল। এগুলি হল ‘মোটর সিমটম’। সে ক্ষেত্রে যেখানে স্টিমুলেশন হচ্ছে, সেই কনট্যাক্ট পয়েন্ট থেকে কারেন্ট ঘুরিয়ে দিতে হয় (কারেন্ট স্টিয়ারিং) বা বাকি পয়েন্টগুলিকে দেখতে হয়। আর ‘সেন্সরি সিমটম’ দেখা যায় মিডিয়াল লেমনিস্কার প্রভাবিত হওয়ার কারণে। এই ট্র্যাক্ট দিয়ে বিভিন্ন সেন্সরি ফাইবার যায়। এখানে কারেন্ট গেলে অনেক সময়ে হাত-পা চিনচিন করতে শুরু করে। সে ক্ষেত্রেও ওই কনট্যাক্টপয়েন্ট বদলানোর প্রক্রিয়াটা ব্যবহার করতে হয়।
এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সংশ্লিষ্ট রোগীর উপরেও নির্ভর করে বলে জানালেন ডা. গঙ্গোপাধ্যায়। সাধারণত এই চিকিৎসার আগে রোগীকে ভাল করে স্ক্রিনিং বা পরীক্ষা করে নেওয়া হয়। পার্কিনসন’স-এর রোগীদের যেমন তাঁদের ‘অন’ (যখন সমস্যা নেই) এবং ‘অফ’ (যখন সমস্যা আছে) পিরিয়ডে পরীক্ষা করা হয়। এ ছাড়া একটা বিস্তারিত কগনিটিভ স্ক্রিনিং-ও করা হয়। ডিবিএস-এর একটা সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হল, কিছু রোগীর এ ক্ষেত্রে ডিমেনশিয়া বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রাথমিক স্তরে এটা নির্ণয় না করে নিলে পরবর্তী কালে ডিবিএস প্রক্রিয়ার পরে রোগী হ্যালুসিনেশন, ডিলিউশনের মতো সমস্যায় ভুগতে পারেন। অনেকের হাঁটাচলা, কথা বলা, খাবার খাওয়ার মতো অ্যাক্সিয়াল সিমটমস-ও থাকতে পারে। ফলে সিভিয়র ডিমেনশিয়া, সাইকায়াট্রিক বা অ্যাক্সিয়াল সিমটম থাকলে সেই সব রোগীর ডিবিএস না করানোর পরামর্শ দিলেন ডা. গঙ্গোপাধ্যায়। অর্থাৎ সব পার্কিনসন’স-এর রোগীকে ডিবিএস করা যায় না। এ ক্ষেত্রে বয়সেরও একটা ব্যাপার থাকে। বয়স ৭২ বছরের নীচে হলে, সেই ব্যক্তির ডিবিএস সাধারণত ভাল কাজ করে।
ডা. গঙ্গোপাধ্যায় জানালেন, এ ক্ষেত্রে দু’টি মেশিন পাওয়া যায়। একটি রিচার্জেবল, অন্যটি নন-রিচার্জেবল। নন-রিচার্জেবলটি সাধারণত পাঁচ বছর চলে। তার পরে ব্যাটারি পাল্টাতে হয়। এখনকার দিনে মূলত রিচার্জেবলই বেশি পাওয়া যায়। এগুলি সাপ্তাহিক দু’বার করে চার্জ দিতে হয় ব্লুটুথ-এর মাধ্যমে। এগুলি চলে ১০-১৫ বছর। এই মেশিন লাগানোর আনুমানিক খরচ শুরু হয় ১৪ লক্ষ টাকা থেকে।
এমনিতে ডিবিএস-এর অস্ত্রোপচার করতে লাগে মাত্র একদিন। তার পরে প্রায় এক মাস কিন্তু মেশিনটা বন্ধ থাকে। এই মেশিনটি বসানোর পরে কিছু সুফল পান রোগীরা। যদিও সেটা স্বল্পমেয়াদি। এই ‘হানিমুন পিরিয়ড’ শেষ হয়ে গেলে, প্রায় এক মাস পরে প্রোগ্রামিং করে মেশিনটিকে চালু করা হয়। ডা. তালুকদারের মতে, এমনিতে ডিবিএস লাগানো রোগীরা সাধারণ জীবনযাপন করতে পারেন। তবে কিছু জিনিস মাথায় রাখা প্রয়োজন। যেমন কোনও ধরনের চৌম্বক ক্ষেত্র (এয়ারপোর্ট বা শপিং মলে যেমন থাকে) ডিবিএস রোগীদের এড়িয়ে চলতে হয়। এর ইতিবাচক দিক হল, ওষুধের পরিমাণ অনেক কমে যায়। জীবন অনেক উন্নত হয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)