যে কোনও অসুস্থতাতেই খাওয়াদাওয়ার দিকে নজর দেওয়া জরুরি। বিশেষত কিডনির সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে ঠিকঠাক খাদ্যাভ্যাস রোগকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। পুষ্টিবিদ কোয়েল পালচৌধুরী বলছেন, “সাধারণত কিডনির সমস্যা দু’টি কারণে হতে পারে। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবিটিসের সমস্যা থেকে কিডনির ক্ষতি হয়। একে বলে ক্রনিক কিডনি ডিজ়িজ়। তা ছাড়া, কোনও সংক্রমণ থেকে, দুর্ঘটনায় চোট পাওয়ার কারণে কিংবা অতিরিক্ত কোনও ওষুধ নেওয়ার ফলেও কিডনির সমস্যা হতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি। এই দ্বিতীয় ধরনের সমস্যা সাময়িক। চিকিৎসকের নজরদারিতে থাকলে, নিয়ম মেনে চললে নির্দিষ্ট সময় পরে এ ধরনের রোগীদের সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চিন্তা বেশি ক্রনিক কিডনি ডিজ়িজ়ে ভোগা রোগীদের ক্ষেত্রে।”
খাওয়াদাওয়ার আগে
কিডনির সমস্যায় সাধারণ ভাবে কী খাবেন, কী খাবেন না, তা এক কথায় বলে দেওয়া যায় না। সবটাই নির্ভর করে ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার উপরে। কোয়েল বলছেন, “প্রথমেই জরুরি মূত্র ও রক্ত পরীক্ষা করে প্রোটিন, ক্রিয়েটিনিন, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ফসফরাস, শর্করা ইত্যাদির পরিমাণ দেখে নেওয়া। অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরি নাকি ক্রনিক কিডনি ফেলিয়োর, তা চিহ্নিতকরণও জরুরি। সেই অনুযায়ী খাবার তালিকা তৈরি করা হয়।” যেমন— অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরির সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের প্রোটিন খাওয়ার বিষয়ে অতিরিক্ত কড়াকড়ি করা হয় না। তবে ক্রনিক কিডনি ডিজ়িজ়ে প্রোটিনের সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। আবার রোগীর ডায়ালিসিস চললে তখন খাবারে প্রোটিনের মাত্রা বাড়ানো হয়।
প্রথম-চতুর্থ স্টেজের মধ্যে কিডনির সমস্যা ধরা পড়লে চিকিৎসকেরা চেষ্টা করেন খাবারে থাকা প্রোটিন, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ফসফরাসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই রোগীকে সুস্থ করে তুলতে, যাতে তাঁর ডায়ালিসিসের প্রয়োজন না হয়। রোগ যদি পঞ্চম স্তরে ধরা পড়ে, সে ক্ষেত্রে ডায়ালিসিসই ভরসা। কোয়েল বলছেন, “একই কিডনির সমস্যা হলেও ডায়ালিসিসের রোগীর ক্ষেত্রে কিন্তু ডায়েটে পার্থক্য আছে।”
কী খাবেন, কী খাবেন না?
কিডনি রোগীদের শরীরে জলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে জরুরি। চিকিৎসকের নির্দিষ্ট করে দেওয়া জলের চেয়ে বেশি পরিমাণ তরল কখনওই খাওয়া যায় না। যে কোনও রকম নরম বা অ্যালকোহল-যুক্ত পানীয়, এনার্জি ড্রিঙ্ক খাওয়াও বারণ।
- এই রোগীদের সাধারণত কম সোডিয়াম-যুক্ত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। রান্নায় নুনের পরিমাণ মেপে দেওয়া হয়। খাবারে স্বাদ আনতে লেবু, লবঙ্গ, ভিনিগার ব্যবহার করতে পারেন। সস, আচার, চিপস বা চিজ়ের মতো প্রিজ়ারভেটিভ দেওয়া প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার একেবারেই চলবে না।
- প্রোটিন খাওয়ার অনুমতি থাকলেও মাটন, চর্বিযুক্ত মাছ, ডিমের কুসুম কিডনি রোগীদের খাওয়া বারণ। নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে ডিমের সাদা অংশ, অল্প পরিমাণে চিকেন, মাছ খাওয়া যেতে পারে।
- এ ক্ষেত্রে কম পটাশিয়াম-যুক্ত সবজি (যেমন— বাঁধাকপি, গাজর ইত্যাদি) ও ফল (যেমন— আপেল, শসা, নাশপাতি, আঙুর ইত্যাদি) খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। অ্যাভোকাডো, রসুন, বেলপেপার, অ্যাসপারাগাসও খেতে পারেন। উচ্চমাত্রায় পটাশিয়াম থাকে যে সব ফলে যেমন কলা, আম, খেজুর, কমলালেবু ইত্যাদি এবং সবজিতে আলু, টোম্যাটো, পালং শাক খাওয়া চলবে না।
- সাদা ভাত, রাইস ফ্লেক্স, কর্নফ্লেক্স, সাদা পাঁউরুটির মতো কম ফসফরাসযুক্ত খাবার খেতে পারেন। বাদাম, দুধ, চকলেট, ব্রাউন ব্রেড, চিংড়ির মতো খাবার এড়িয়ে চলা ভাল।
- দুধ বা ফ্যাট জাতীয় খাবার, চিয়া, ফ্ল্যাক্স ইত্যাদি বীজ খাওয়া চলবে না।
খেয়াল রাখবেন
ক্রনিক ডায়াবিটিসের সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে রক্তে শর্করার পরিমাণ হঠাৎ কমে যাওয়া কিংবা নিয়ন্ত্রণে চলে আসাও কিন্তু কিডনির সমস্যার আভাস হতে পারে। একই ভাবে কিডনির সমস্যার কারণে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমতে পারে। এ ক্ষেত্রে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার, যেমন খেজুর, চিঁড়ে ইত্যাদি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
তবে মনে রাখবেন এ ক্ষেত্রে কিন্তু রোগের মাত্রা বুঝে খাদ্যতালিকা তৈরি করা হয়। এক একজনের জন্য এক এক রকম ডায়েটের পরামর্শ দেওয়া হয়। পুষ্টিবিদ কিংবা নেফ্রোলজিস্টের পরামর্শ ছাড়া কিডনি রোগীদের খাদ্যতালিকায় কোনও রকম বদল আনা বিপজ্জনক হতে পারে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)