বাংলার ফেলুদা-ব্যোমকেশ বা বিলেতের শার্লক হোমসের মতো ঝকঝকে শান দেওয়া দৃষ্টি, ক্ষুরধার মগজ আর আলোর গতিতে ছুটে চলা চিন্তাভাবনাই বিস্মিত করে পাঠকদের। পেশি-সর্বস্ব পুরুষের সেখানে ঠাঁই নেই। বুদ্ধির ঝকঝকে প্রতিফলনই আসল ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’ বলে মনে করেন অনেকেই। কিন্তু সেই বুদ্ধিই বুড়িয়ে যায় দিনে দিনে। ঝাপসা হয় স্মৃতির পাতা, মরচে ধরে স্মৃতির কুঠুরিতে। ক্ষয়ে যাওয়া মস্তিষ্কের কোষের ফাঁক গলে অবাধে ঢুকে পড়ে ডিমেনশিয়া-অ্যালঝাইমার্সের মতো অসুখ, যার সম্পূর্ণ নিরাময় পদ্ধতি এখনও অজানা। মগজের অলিগলিতে কী ঘটছে, তা দেখতে গিয়েই চমকে ওঠেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা দেখেন, মস্তিষ্কে বার্ধক্য আসার কারণই হল একটিমাত্র প্রোটিন। ওই প্রোটিনের কলকাঠিতেই বুড়িয়ে যায় মস্তিষ্কের কোষ, ধুলো জমে স্মৃতির পাতায়।
হিপ্পোক্যাম্পাসেই ঘটছে যত ঘটনা
মস্তিষ্কের জটিল ধাঁধা ভেদ করা খুবই কঠিন। বছরের পর বছর এই নিয়ে গবেষণা চলছে। মস্তিষ্কের আসল রহস্য নাকি লুকিয়ে হিপ্পোক্যাম্পাসেই। স্মৃতিকে বেঁধে রাখার কাজটি করে মাথার এই অংশটিই। মস্তিষ্কের মধ্যে কয়েক লক্ষ কোটি স্নায়ুকোষের (নিউরন) আদানপ্রদানের মাধ্যমে স্মৃতি তৈরি হয়। যে কোনও কোষের মতো, স্নায়ুকোষও তৈরি হয় প্রোটিন দিয়ে। যখন এই কোষগুলির প্রোটিন ভাঙতে থাকে, তখন তাদের দ্বারা নির্মিত স্মৃতিও টালমাটাল হয়ে যায়। মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস অংশে এমন অদলবদল হয় যে, স্মৃতির পাতাই ধূসর হতে থাকে। হিপ্পোক্যাম্পাস হল মস্তিষ্কের সেই কুঠুরি, যেখানে স্মৃতি জমা থাকে। ওই অংশের সঙ্গেই যুক্ত থাকে ‘এনটোরিনাল কর্টেক্স’ নামে আর একটি অংশ। স্মৃতি জমিয়ে রাখা, স্থান-কালের পরিচয়, সময়ের হিসেব ওই অংশই নিয়ন্ত্রণ করে। কী ভাবে মানুষের স্মৃতি তৈরি হয়, পুরনো কথা ছবির মতো ভেসে ওঠে মাথায় আর কী ভাবেই বা তা হারিয়ে যায়— এই সব রহস্যই লুকিয়ে আছে ওই অংশে। আর সেখানেই চুপিচুপি বাসা বেঁধে থাকে ওই প্রোটিন।
আরও পড়ুন:
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকেরা হিপ্পোক্যাম্পাসের রহস্য ভেদ করতে গিয়ে সেই প্রোটিনের খোঁজ পেয়েছেন, যার নাম ‘এফটিএল১’। এই প্রোটিনের কারণেই শরীরের মতো বার্ধক্য আসে মস্তিষ্কেও। মগজের কোষকে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দুর্বল করে দেয় ওই প্রোটিন। এর কারণেই গুলিয়ে যায় চিন্তাভাবনা, বাড়ে ভুলে যাওয়ার সমস্যা, পুরনো অনেক স্মৃতিই হারিয়ে যায় চিরতরে। এই প্রোটিনকেই যদি ধরেবেঁধে রাখা যায়, তা হলে বুদ্ধি ও স্মৃতি যৌবনের মতোই তরতাজা থাকবে বলে দাবি বিজ্ঞানীদের।
বুড়ো ব্রেনে ফিরবে যৌবন
ধূসর হয়ে আসা স্মৃতিকে আবার রঙিন করে তোলার উপায় মনে হয় পেয়ে গিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তার জন্য থামিয়ে দিতে হবে ‘এফটিএল১’ প্রোটিনের গতি। এর মাত্রা কমে গেলেই বুদ্ধির ধার বাড়বে, ফিরে আসবে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিও, এমনটাই দাবি ক্যালোফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এজিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর গবেষক সল ভিলেদার। ইঁদুরের উপর দফায় দফায় পরীক্ষা করে এমনই দেখা গিয়েছে। ইঁদুরের ব্রেনে আরও বেশি পরিমাণে ওই প্রোটিন ঢুকিয়ে দেখা গিয়েছে, তার বার্ধক্য এসেছে খুব তাড়াতাড়ি। দুর্বল হয়েছে স্মৃতি। একই ভাবে বয়স্ক ইঁদুরের ব্রেন থেকে প্রোটিনের মাত্রা কমিয়ে দেখা গিয়েছে, উল্টো ঘটনা ঘটেছে। সেই ইঁদুরের স্মৃতি আবার আগের মতো তরতাজা হয়েছে। পিছিয়ে গিয়েছে বয়সের চাকাও।
আরও পড়ুন:
গবেষকের দাবি, স্মৃতিনাশ, অ্যালঝাইমার্সের মতো জটিল ব্যাধির সঙ্গে যদি লড়তে হয়, তা হলে আগে বশে আনতে হবে ওই প্রোটিনকে। তা হলেই স্নায়ুর উপরে নিয়ন্ত্রণ আসবে। হারিয়ে দেওয়া যাবে মস্তিষ্কের দুরারোগ্য সব অসুখকে। তবে তার জন্য এখনও লম্বা সময়ের গবেষণা প্রয়োজন।