পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিহানার পর ভারতের প্রত্যাঘাত এবং পাকিস্তানের আক্রমণ, ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পাল্টা ‘অপারেশন বুনিয়ান-আন-মারসুস’ (বুনিয়ান মারসুস)। শনিবার বিকেল ৫টার আগে সংঘর্ষবিরতির সূচনা পর্যন্ত প্রাণহানি থেকে সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে দুই দেশেরই। এই ‘লড়াই’-এর পরে ভারতের দাবি, কয়েক জন কুখ্যাত জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে সেনার ‘প্রত্যাঘাতে।’ পাকিস্তানের দাবি, ভারতীয় সেনার আক্রমণে বেশ কয়েক জন পাক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। তবে সংঘর্ষবিরতির সমঝোতাকে তাদের ‘সাফল্য’ বলে তুলে ধরে দেশব্যাপী উৎসবের ডাক দিয়েছেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। তার আগে প্রায় ১০০ ঘণ্টায় দুই দেশের মধ্যে উদ্ভূত চাপানউতরে কী কী ঘটল?
এই বার ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতের শুরু দিন ২০ আগে— জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিহামলার প্রেক্ষিতে। গত ২২ এপ্রিল দুপুরে ২৬ জন নিরাপরাধ মানুষের প্রাণ নেয় জঙ্গিরা। অভিযোগ, ধর্ম দেখে খুন করা হয়েছে। এই জঙ্গিহামলার নেপথ্য পাক-যোগ রয়েছে বলে জানায় ভারত। উদাহরণ টানা হয় ২০১৯ সালের পুলওয়ামা জঙ্গিহামলার। তার পরেই ‘অপারেশন সিঁদুর’।
৭ মে
৭ মে, মঙ্গলবার গভীর রাতে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাধ্যমে জঙ্গিহানার জবাব দেয় ভারতীয় সেনা। পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরের বিস্তীর্ণ অংশে জঙ্গিঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। দাবি, বেশ কয়েক জন জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের উপর হামলা হয়নি। আঘাত হানা হয়নি পাকিস্তানের সামরিক পরিকাঠামোতেও। যদিও এই দাবি উড়িয়ে দিয়ে বুধবার রাত থেকে ভারতে আক্রমণ শুরু করে পাকিস্তানি সেনা।
৮ মে
বৃহস্পতিবার, ৮ মে-র রাতে ৩০০-৪০০ ড্রোন হামলা করে পাকিস্তান। জম্মু, রাজস্থান, পঞ্জাব— সব মিলিয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রায় ৩৬টি শহর এবং ঘনবসতি এলাকায় আক্রমণের চেষ্টা হয়। পঞ্চাশের বেশি ড্রোন আকাশে থাকতে থাকতেই ধ্বংস করে দেয় ভারত। বেশ কয়েকটি নামানোর পর ‘নিউট্রিলাইজ়’ করে দেওয়া হয়। দুই দেশই দাবি করে তারা একে অন্যের একাধিক যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে দিয়েছে। পাকিস্তান জানিয়ে দেয় তারা ‘আলোচিত’ রাফাল যুদ্ধবিমানও গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ভারত জানায়, পাকিস্তানের বায়ুসেনার আমেরিকায় তৈরি এফ-১৬ এবং চিনে নির্মিত জে-১৭ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
৯ মে
৯ মে শুক্রবার দিনভর চাপানউতর ছিল। তীব্র হল রাত সওয়া ৮টা নাগাদ। তখন জম্মু সীমান্তে আবার গুলি চালাতে শুরু করে পাক বাহিনী। শুক্রবার রাতে পঞ্জাবের ফিরোজ়পুরে উড়ে আসা পাক ড্রোনে ঝলসে যান তিন ভারতীয়। তাঁরা একই পরিবারের সদস্য। দু’জন অল্পবিস্তর জখম হলেও এক মহিলার অবস্থা শঙ্কাজনক। এখনও হাসপাতালে রয়েছেন তিনি। অন্য দিকে, পাকিস্তানের অভিযোগ, ভারতের ‘অনর্থক আগ্রাসনে’ ১১ জন পাক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে এক শিশুও রয়েছে। রাতভর ভারতের আক্রমণে ৫০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। ড্রোন হামলার মাঝে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায় জঙ্গিরা। যদিও তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। সিয়ালকোটের লুনিতে জঙ্গিদের ‘লঞ্চ প্যাড’ উড়িয়ে দেয় বিএসএফ। কাশ্মীরের বারামুল্লা থেকে গুজরাতের ভুজ পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গার মোট ২৬টি এলাকায় ড্রোন হামলা করে পাকিস্তান। তার মধ্যে ১৪টি জায়গা মূলত নিশানা করা হয়েছিল। জম্মু, বারামুলা, শ্রীনগর, অবন্তীপোরা, নাগরোটা যেমন ছিল, তেমনই ছিল পঞ্জাবের ফিরোজ়পুর, পঠানকোট, ফাজিলকা এবং রাজস্থানের লালগড় জাটান, জৈসলমের, বাড়মের, গুজরাতের ভুজ, কারবেট ও লাখিনালা। ‘ব্ল্যাকআউট’ ছিল জম্মু-কাশ্মীরের বিস্তীর্ণ অংশ। হরিয়ানার অম্বালাতেও ব্ল্যাকআউট ছিল। ৫৪ বছর পরে অন্ধকারে ডোবে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির।
১০ মে
১০ মে, শনিবার দুপুরেও জম্মু-কাশ্মীর থেকে পাক-অধিকৃত কাশ্মীর, দুই তরফ থেকে সাইরেন বাজানো, ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার অভিযোগ ওঠে। কাকভোর থেকে ভারতে হামলা শুরু করে পাকিস্তান। জম্মু-কাশ্মীরের একাধিক জায়গায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এই অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘বুনিয়ান-আন-মারসুস’। পাক সেনার বক্তব্য, ভারতের হামলার পর প্রত্যাঘাত করতেই হত। সেই কারণেই এই আক্রমণ। পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে রাজৌরীতে সরকারি আধিকারিক-সহ তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। পাক গোলা এসে পড়ে জম্মুর শম্ভু মন্দিরেও।
আরএস পুরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বিএসএফের সাব-ইনস্পেক্টর মহম্মদ ইমতিয়াজ়। বিএসএফ জানিয়েছে, একটি বর্ডার আউটপোস্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইমতিয়াজ় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বাহিনীকে। রাত ৯টা নাগাদ শ্রীনগরের লালচকের পাশাপাশি বাদামিবাগের সেনা ক্যান্টনমেন্ট, সাফাপোরার মতো এলাকায় শোনা যায় বিস্ফোরণের শব্দ।
বস্তুত, গত কয়েক দিনের পাক-হামলায় জম্মু-কাশ্মীরে অন্তত কুড়ি জন মারা গিয়েছেন বলে অসমর্থিত সূত্রে খবর। শনিবার ভোরে পাক সেনার গোলা সটান এসে পড়ে রাজৌরীর অতিরিক্ত জেলা উন্নয়ন কমিশনার (এডিডিসি) রাজকুমার থাপার বাড়িতে। বছর পঞ্চান্নর রাজকুমার গুরুতর আহত হন। পরে তাঁর মৃত্যু হয়। মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার খেদোক্তি, ‘‘গতকালই উনি উপমুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। আমার একটি বৈঠকেও যোগ দেন। আর আজ (শনিবার) পাকিস্তানি গোলাবর্ষণে ওঁকে হারালাম।’’ রাজকুমার ছিলেন এক জন ডাক্তারও। ওমর তাঁর বাড়িতে গিয়ে পরিজনদের সঙ্গে দেখা করেন। জম্মুর উপকণ্ঠে রাইপুরের একটি বাড়িতেও পাকিস্তানের গোলার আঘাতে জ়াকির হুসেন নামে এক ব্যক্তি মারা যান।
যুদ্ধবিরতি
গত শনিবার বিকেলেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রথম সমাজমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির কথা ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরে এক্স হ্যান্ডলে একটি দীর্ঘ পোস্ট করেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা শান্তির জন্য তাঁর নেতৃত্ব এবং সক্রিয় ভূমিকার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানাই। আঞ্চলিক শান্তি এবং স্থিতিশীলতার স্বার্থে আমরা যে পদক্ষেপ (সংঘর্ষবিরতি) গ্রহণ করেছি, তা সহজতর করার জন্য আমেরিকার প্রশংসা করি।’’ ভারতের বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, ‘‘আজ (শনিবার) বিকেল ৫টা থেকে ভারত আর পাকিস্তান সব ধরনের সংঘর্ষ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’’ ভারতের তরফে যুদ্ধবিরতির আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পরেই সাংবাদিক বৈঠক করে সেনাবাহিনী। সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন ভারতীয় সেনার তিন আধিকারিক সোফিয়া কুরেশি, রঘু নায়ার এবং ব্যোমিকা সিংহ। ভারত জানায়, আগে থেকে নিশানা স্থির করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে হামলা করা হয়েছে। ভারত পারিপার্শ্বিক ক্ষয়ক্ষতিকে যৎসামান্য রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বিকেলে সংঘর্ষবিরতিকে স্বাগত জানিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর বলেন, ‘‘আলোচনার পথ আগে খুললে অনেক প্রাণ বেঁচে যেত।’’ পিডিপি নেত্রী তথা জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির প্রতিক্রিয়া, ‘‘অবশেষে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবে মানুষগুলো।’’
কিন্তু কোথায় কী! রাতেই ওমর জানান, আবার উপত্যকা জুড়ে বিস্ফোরণের শব্দ পাচ্ছেন। হামলা জারি রেখেছে পাকিস্তান! সংঘর্ষবিরতি ‘চুক্তি’ লঙ্ঘনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে পাকিস্তান পাল্টা ভারতের দিকে আঙুল তুলেছে। ইসলামাবাদ জানিয়েছে, এই সংক্রান্ত যে কোনও সমস্যার সমাধান আক্রমণে নয়, আলোচনার মাধ্যমে করা উচিত।
কী হল সেই ৫-৭ জঙ্গির?
মঙ্গলবার এবং বুধবারের রাতে ‘অপারেশন সিঁদুর’ চলাকালীন নিহত পাঁচ জঙ্গির পরিচয় প্রকাশ্যে এনেছে ভারত। ওই পাঁচ জনের মধ্যে দু’জন লশকর-এ-ত্যায়বা এবং তিন জন জইশ-ই-মহম্মদ জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। জইশ জঙ্গিনেতা মৌলানা মাসুদ আজ়হারের দুই আত্মীয় রয়েছে ওই তালিকায়। তার মধ্যে এক জন কন্দহর বিমান অপহরণকাণ্ডে অন্যতম ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় ছিল। কিন্তু বৈসরন উপত্যকায় পর্যটকদের রক্তস্রোত বইয়ে দিয়ে পালিয়ে যাওয়া পাঁচ জঙ্গি?
ভারতের প্রত্যাঘাতের পর কয়েক দিন ধরে দিনে রাতে পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই এবং অবশেষ সংঘর্ষবিরতির ঘোষণা। কিন্তু এত কিছুর পরেও অধরা থেকে গেল পহেলগাঁওয়ের জঙ্গিরা। বৈসরনের হত্যালীলায় অন্ততপক্ষে পাঁচ থেকে সাত জন জঙ্গির যোগ ছিল। তাদের চিহ্নিতও করেছে এনআইএ। ঘটনার পর যে সব জঙ্গির স্কেচ প্রকাশ করেছিল এনআইএ, তাদের মধ্যে পুলওয়ামার বাসিন্দা আসিফ শেখ ও অনন্তনাগের বাসিন্দা আদিল ঠোকারের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়ে অবশ্য সরকারি ভাবে কিছু জানানো হয়নি। তবে যে দিন পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জঙ্গিদের আস্তানা ক্ষেপণাস্ত্র হানায় গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভারত, সে দিনই এনআইএ-র তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ৫০ বছর বয়সি শেখ সাজ্জাদ গুল পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডের মূল মাথা। লস্কর-এ-ত্যায়বার ছায়া সংগঠন ‘দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) সংগঠনের শীর্ষ পদে সে-ই বসে রয়েছে। তদন্তকারীরা আরও জানতে পেরেছেন, পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির বাসিন্দা শেখ সজ্জাদ গুল (সাজ্জাদ আহমেদ নামেও পরিচিত) ওই জঙ্গি বৈসরনেই প্রথম বার হত্যালীলা চালায়নি। কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে তার। ২০২০ ও ২০২৪ সালে মধ্য ও দক্ষিণ কাশ্মীরে রক্ত বইয়েছে সে। এ ছাড়া, ২০২৩ সালে মধ্য কাশ্মীরে গ্রেনেড হামলা কিংবা অনন্তনাগে পুলিশকর্মী হত্যা— একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে গিয়েছে শেখ সাজ্জাদ গুল। এনআইএ তার মাথার দাম ঘোষণা করেছে দশ লক্ষ টাকা। কিন্তু পহেলগাঁও হামলার মূল চক্রী এখন কোথায়, সেই খবর তদন্তকারীদের কাছে নেই।