অধিনায়ক হিসেবে এটাই তাঁর শেষ ম্যাচ।
চাইলে আরও এক দফা অধিনায়ক থেকে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারতেন। কিন্তু নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন, আর নয়।
কিন্তু বিপক্ষ সে কথা শুনবে কেন? প্রকাশ কারাটের জন্য তাই বিশাখাপত্তনমের পিচে বিষাক্ত বাউন্সার অপেক্ষা করছে। বিপক্ষের ড্রেসিংরুম থেকে অন্তত এমনটাই খবর।
আগামিকাল থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের এই শহরেই শুরু হচ্ছে সিপিএমের ২১-তম পার্টি কংগ্রেস। ১৯ এপ্রিল, পার্টি কংগ্রেসের শেষ দিনে দলের নতুন সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা হবে। তার আগে হবে দীর্ঘ আলোচনা-সমালোচনা। সিপিএমের চরিত্রেই রয়েছে ইতিহাসের মন্থন। পার্টি কংগ্রেসের দলিলেও তাই ভুল-ত্রুটি-ব্যর্থতার দীর্ঘ তালিকা এবং তা নিয়ে হাজারো বিশ্লেষণ। প্রকাশ কারাট নিজেই স্বীকার করেছেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরও ভুল হয়েছে এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনিও তার অংশ। কিন্তু সেই হাজারো ভুল স্বীকার করে নেওয়ার পরেও সমালোচনা পিছু ছাড়ছে না তাঁর। সোমবার ভোরবেলা দিল্লি থেকে বিশাখাপত্তনমের যে বিমানে প্রকাশ উঠলেন, সেই একই বিমানে বসে তাঁরই এক সতীর্থ নেতা বললেন, ‘‘সমালোচনা বন্ধ হবে কী করে? যে সব ভুল-ত্রুটি স্বীকার হয়নি, তার তালিকাটাও তো কম লম্বা নয়!’’
দশ বছর আগে প্রকাশ যখন দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন, তখন তিন রাজ্যের বাইরে প্রভাব বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়েছিল দল। সেই লক্ষ্য পূরণ তো হয়ইনি, উল্টে এই দশ বছরে দলের জনসমর্থন কমেছে বিপুল। পাল্লা দিয়ে কমেছে দলের সদস্য সংখ্যা। আর সব চেয়ে বেশি কমেছে রাজনৈতিক প্রভাব। পরমাণু চুক্তি প্রশ্নে প্রথম ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে কেন্দ্রে বিকল্প সরকারের ডাক দিতে গিয়ে লোকসভায় বিপুল শক্তি খুইয়েছে সিপিএম। শুধু তাই নয়। তাঁর আমলেই বাংলার ৩৪ বছরের বাম দুর্গের পতন হয়েছে। যার পিছনে অন্যান্য কারণের পাশাপাশি আলিমুদ্দিনের নেতারা মনে করেন প্রকাশেরও একটা বড় ভূমিকা আছে। কী সেটা? প্রকাশের জন্যই কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের রাস্তা খুলে গিয়েছিল। এই পার্টি কংগ্রেসে অনেকেই সে প্রসঙ্গ তুলবেন।
সমালোচকদের বক্তব্য, প্রকাশ-জমানার আর একটি ব্যর্থতা হল, দলে নতুন রক্ত টানতে না পারা। তাঁরা বলছেন, মানষের সমস্যা নিয়ে মাঠে নামার চেয়ে তত্ত্বের কচকচিতে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে তরুন প্রজন্মকে সে ভাবে আর উদ্বুদ্ধ করতে পারছে না সিপিএম। এই প্রসঙ্গেই উঠছে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি প্রকাশ কারাটের কথা। তখন প্রকাশ থাকতেন কলকাতায় এসএফআই-এর দফতরের একটা ছোট্ট ঘরে। ঘর ভর্তি শুধু বই আর বই। তারই মধ্যে একটা ছোট্ট খাটে শুতেন বিমান বসু। আর মেঝেতে প্রকাশ। সে সময় দলের অনেকেই এমন জীবনযাপন করতেন। এখন দলে এমন নিষ্ঠাবান কর্মীর সংখ্যা ক্যাডার হাতে গোনা! ফলে বেড়েছে সংগঠনের দুর্বলতা। অধিকাংশ রাজ্যে সিপিএমের গণ সংগঠনগুলো আন্দোলন করতেই ভুলে গিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ সব ভুল অবশ্য দলিলে স্বীকার করা হয়েছে। যা স্বীকার হয়নি বলে অভিযোগ, তা হল, কারাটের জমানায় দলীয় নেতৃত্বের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে দায়িত্ব বণ্টন হয়েছে, যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়। এমনকী ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে এই প্রকাশ-জমানাতেও। সংগঠন সামলানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতার নমুনা হিসেবে রয়েছে নিজের রাজ্য কেরলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামলাতে না পারা। ২০০৯ ও ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে নিজের ও বিপক্ষের রাজনৈতিক শক্তি ঠিক মতো না মেপেই লড়াই করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে দল। পার্টি কংগ্রেসের আগে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পাল্টা নোট দিয়ে এই সব অভিযোগ তুলেছেন দলের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি। পার্টি কংগ্রেসের মঞ্চেও অনেকে একই কথা বলার প্রস্তুতি নিয়ে বিশাখাপত্তনমে হাজির।
অন্য বাম দলের নেতারা বলছেন, আরেকটি জায়গায় প্রকাশ কারাটের খামতি রয়েছে। হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ যেমন অন্যান্য আঞ্চলিক দলের নেতাদের নিয়ে চলতে পারতেন, তাঁদের মধ্যে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে ফেলেছিলেন, প্রকাশ তা পারেননি। এখন শেষ বেলায় বাম ঐক্য মজবুত করতে মরিয়া প্রকাশ পার্টি কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুরনো সঙ্গী সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক এবং আরএসপি-র শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি হাজির করেছেন এসইউসি-র প্রভাস ঘোষ ও সিপিআই (এম-এল)-এর কবিতা কৃষ্ণণকে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, অবাম দলগুলির কাছে তাঁর সে রকম গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়নি। উত্তরপ্রদেশের মুলায়ম সিংহ যাদবই হোন বা অন্ধ্রের চন্দ্রবাবু নাইডু— বারবারই এঁরা প্রকাশকে ধোঁকা দিয়েছেন। পরমাণু চুক্তিতে সমর্থন প্রত্যাহারের পর মুলায়মের ভরসাতেই অনাস্থা প্রস্তাব এনে মনমোহন-সরকার ফেলতে গিয়েছিলেন প্রকাশ। কিন্তু মুলায়ম শেষ মুহূর্তে ডিগবাজি খান!
কারাটের সেই ঘা যে এখনও শুকোয়নি, বিদায়বেলায় তা স্পষ্ট। কারাট বলেছেন, মুলায়ম বারবার তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। মুলায়মকে বিশ্বাস করা খুব শক্ত। কারাট এ কথা বলার পরই পাল্টা আক্রমণে গিয়ে সমাজবাদী পার্টি বলেছে, পশ্চিমবঙ্গের হার থেকে কোনও শিক্ষাই যে সিপিএম নেয়নি, তা বোঝা যাচ্ছে। দলের এক পলিটব্যুরো নেতার কথায়, ‘‘সুরজিতের আমলে এটা ভাবাই যেত না। সপা-নেতাদের এ হেন আক্রমণ থেকেই স্পষ্ট, এত দিন সাধারণ সম্পাদক পদে থেকেও প্রকাশ অন্য রাজনৈতিক দলের সম্ভ্রম আদায় করতে পারেননি।’’
বিদেশি ক্রাইম ফিকশনের পোকা প্রকাশ কারাটের পক্ষে আন্দাজ করা কঠিন নয়, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর দিকে ধেয়ে আসবে আক্রমণ। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে তিনি ভাবলেশহীন। গায়ের পরিচিত সাদা হাফ শার্টের মতোই! সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরলেও পলিটব্যুরোতে থেকে যাবেন তিনি। নতুন পলিটব্যুরো-কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিজের প্রভাব বজায় রাখারও চেষ্টা করবেন। ওই ভাবলেশহীন মুখেই তিনি কী ভাবে সমালোচকদের সামলে নিজের ঘুঁটি সাজান, আগামী ছ’দিন সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy