Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

প্রায় ৯৯ শতাংশ বাতিল নোট ফেরত, কালো টাকা গেল কোথায়

কালো টাকা, জাল নোট ও দুর্নীতি বিনাশের লক্ষ্য নিয়ে গত বছর ৮ নভেম্বরের রাতে নোট বাতিলের চমক দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগি সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছিলেন, তিন থেকে লক্ষ কোটি টাকা মূল্যের বাতিল নোট আর ব্যাঙ্কের ঘরে জমা পড়বে না বলে আশা করছে সরকার।

মগ্ন: দিল্লির এক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। বুধবার। ছবি: পিটিআই।

মগ্ন: দিল্লির এক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। বুধবার। ছবি: পিটিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৭ ০৪:১০
Share: Save:

কালো টাকার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর লড়াইয়ে সামিল হতে এত দিন ধরে এত মানুষের এত কষ্ট, ব্যাঙ্ক এবং এটিএমের লাইনে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকা, এমনকী লাইনে দাঁড়িয়ে শতাধিক মানুষের মৃত্যুর অভিযোগ, নগদের অভাবে ব্যবসা বন্ধ, রুজিতে টান, ব্যাঙ্কে এবং স্বল্প সঞ্চয়ে সুদের হার কমা— এত কিছুর পরে লাভ কী হলো?

কালো টাকা, জাল নোট ও দুর্নীতি বিনাশের লক্ষ্য নিয়ে গত বছর ৮ নভেম্বরের রাতে নোট বাতিলের চমক দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগি সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছিলেন, তিন থেকে লক্ষ কোটি টাকা মূল্যের বাতিল নোট আর ব্যাঙ্কের ঘরে জমা পড়বে না বলে আশা করছে সরকার। অর্থাৎ, ওই পরিমাণ কালো টাকার হাত থেকে রেহাই পাবে অর্থনীতি। জব্দ হবেন কালো টাকার কারবারিরা। দশ মাস পরে আজ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বার্ষিক রিপোর্টে দেখা গেল, বাতিল হওয়া ৫০০-১০০০ টাকার নোটের প্রায় ৯৮.৯৬ শতাংশই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে ফেরত এসেছে। সব মিলিয়ে তার ‘লাভ’ মাত্র ১৬ হাজার কোটি টাকা। নতুন নোট ছাপা ও বণ্টন এবং অর্থনীতির সামগ্রিক ক্ষতি বিবেচনা করলে অবশ্য সেই লাভের গুড় পিঁপড়েয় খেয়ে যাবে!

আরও পড়ুন: পানাগড়িয়ার বিদায়ী তোফায় বিদ্ধ মোদী

অথচ, নোটবন্দির পরে আমজনতা দাঁতে দাঁত চেপে হাজার যন্ত্রণা সহ্য করেছিল শুধু এই আশায় যে, দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ হবে। ব্যাঙ্কের লাইনে অসুস্থ হয়েও বৃদ্ধ নাগরিক বলেছিলেন, তাতে কী, দেশের তো ভাল হবে। মোদী তাঁদের সেই স্বপ্নই দেখিয়েছিলেন। স্বাধীনতা দিবসেও লালকেল্লা থেকে তিনি দাবি করেছেন, উদ্ধার হওয়া কালো টাকার মূল্য ৩ লক্ষ কোটি টাকা। আজ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট সেই দাবিতে জল ঢেলে দিয়েছে।

স্বাভাবিক ভাবেই সরব বিরোধীরা। চিদম্বরমের প্রশ্ন, ‘‘৯৯ শতাংশ নোটই বদলে ফেলা হয়েছে। নোট বাতিল কি তা হলে কালো টাকা সাদা করার প্রকল্প ছিল?’’ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘নোট বাতিল ফ্লপ শো ছিল। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য কি কোনও দুর্নীতির ইঙ্গিত করছে?’’ সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরির মন্তব্য, ‘‘গরিব মানুষ সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দেশ মোদীকে কখনও এই রাষ্ট্রবিরোধী কাজের জন্য ক্ষমা করবে না।’’

এই অবস্থায় নতুন যুক্তির ঢাল ধরেছেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। তাঁর দাবি, ‘‘নোট বাজেয়াপ্ত করা আমাদের লক্ষ্য ছিল না। যারা কালো টাকার বিরুদ্ধে কখনও লড়াই করেনি, তারা এই সব বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। নোট বাতিলের ফলে ওই সব নোট ব্যাঙ্কে এসেছে। কোন নোটের মালিক কে, তা এখন জানা। তাদের আয়ের সঙ্গে জমা নোটের হিসেব মিলিয়ে লক্ষ লক্ষ আয়কর নোটিস পাঠানো হয়েছে।’’

হিসেবের কড়ি

• নোটবন্দির দিন ১,৭১৬.৫ কোটি পাঁচশো এবং ৬৮৫.৮ কোটি হাজার টাকার নোট বাজারে ছিল

• ওই দুই ধরনের নোটের মোট মূল্য ১৫.৪৪ লক্ষ কোটি টাকা

• এর মধ্যে ১৫.২৮ লক্ষ কোটি মূল্যের বাতিল নোট ফিরে এসেছে ব্যাঙ্কের হাতে

• তার মধ্যে ৫০০-র নোটে রয়েছে ৮,১০০ কোটি, হাজারের নোটে রয়েছে ৭,৯০০ কোটি

• নয়া নোট ছাপতে খরচ হয়েছে ৭,৯৬৫ কোটি টাকা

• আগের বছরে খরচ হয়েছিল ৩,৪২১ কোটি টাকা

• চলতি বছরে মোট জাল নোট ধরা পড়েছে ৭,৬২,০৭২টি

জেটলির দাবি, নোট বাতিলের ফলে আয়করদাতার সংখ্যা বেড়েছে, রাজস্ব বেড়েছে ২৫%। নোট বাতিলের ফলে নগদ লেনদেন কমেছে, তাতেও দীর্ঘ মেয়াদে কালো টাকা কমবে। সমস্যা হলো, দীর্ঘ মেয়াদের সময়সীমা কত দিন, তা স্পষ্ট নয়। ভবিষ্যতে যে কালো টাকা উদ্ধার হবে, তার কতখানি নোট বাতিলের ফলে, তা-ও বোঝা মুশকিল। যত সময় যাবে, ততই এ নিয়ে সংশয় বাড়বে। অর্থনীতিবিদ এম গোবিন্দ রাওয়ের মতে, ‘‘কালো টাকা যে শুধুমাত্র নোটে ধরা থাকে না, তা বাজারে ঘুরতে থাকে, অন্য কোথাও মজুত থাকে, তা এখন স্পষ্ট।’’

বস্তুত, নোট বাতিলের ফলে কালো টাকা বা জাল নোট কতখানি উদ্ধার হবে, তা নিয়ে সংশয় আগেই ছিল। হিসেবের থেকেও বেশি নোট জমা পড়েছে, এই আশঙ্কায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে দু’বার করে গুনতে নির্দেশ দেয় অর্থ মন্ত্রক। তার পরেও মুখরক্ষা হলো না সরকারের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE