Advertisement
০২ মে ২০২৪
Mulayan Singh Yadav

বন্ধ দরজা খুলতেই সামনে মুলায়ম

কর্মসূত্রে সদ্য দিল্লিতে আসা এক সাংবাদিকের স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছেন এখনও— দরজা খুলে হঠাৎ ঢুকে আসছেন গোবলয়ের সবচেয়ে বড় রাজ্যের রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রে থাকা নেতা।

সাল ২০০৩। দিল্লিতে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে (বাঁ দিক থেকে) জ্যোতি বসু, সীতারাম ইয়েচুরি, সনিয়া গান্ধীদের সঙ্গে মুলায়ম সিংহ যাদব। পিটিআইয়ের ফাইল চিত্র।

সাল ২০০৩। দিল্লিতে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে (বাঁ দিক থেকে) জ্যোতি বসু, সীতারাম ইয়েচুরি, সনিয়া গান্ধীদের সঙ্গে মুলায়ম সিংহ যাদব। পিটিআইয়ের ফাইল চিত্র।

অগ্নি রায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২২ ০৮:০৫
Share: Save:

লখনউয়ের বিক্রমাদিত্য মার্গে সমাজবাদী পার্টি অফিসের বাইরে তখন জনতার ঢল। দীর্ঘ আট বছর অপেক্ষার পর ক্ষমতার গন্ধে বুঁদ দলের নেতা, কর্মী, সমর্থকরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ‘নেতাজি’ দর্শনে। ঢাক ঢোল আবির সবই প্রস্তুত, কিন্তু না আঁচালে তখনও বিশ্বাস নেই। তাই ভিড়ের উসখুসে চরিত্র।

কিন্তু কোথায় নেতাজি? বাতাসের খবর, প্রতিপক্ষ মায়াবতীর বিএসপি-র জনা পনেরো বিধায়ককে ভাঙিয়ে নিয়ে গোপন ডেরায় রেখে দেওয়া হয়েছে। বিজেপি মায়াবতীর সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করল বলে। সব ভালয় ভালয় মিটলে, রাজ্যপাল বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রীর কাছে মুলায়ম সিংহ যাদব তাঁর শক্তি প্রদর্শন করে সরকার গড়বেন। এহেন চরম স্পর্শকাতর সময়ে গোটা দেশের সংবাদমাধ্যমই (তখন অবশ্য বৈদ্যুতিন চ্যানেল কম ছিল, সমাজ-মাধ্যমের প্রশ্নই নেই) উপস্থিত দলের সদর দফতরের সামনে। মুলায়মকে এক বার সামনে পাওয়ার জন্য অধীর সংবাদমাধ্যম।

এহেন ১৯ বছর আগে অগস্ট শেষের দুপুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি দলীয় দফতরের এ ঘর থেকে ও চাতালে। মাঝে একবার দেখা হয়ে গিয়েছে সিঁড়িতে দাঁড়ানো মুলায়ম-পুত্র অখিলেশের সঙ্গে। কিন্তু তখন সেই ২৯ বছরের যুবকের কী-ই বা গুরুত্ব! উল্টে তিনিই কলকাতার কাগজ শুনে জানতে চাইলেন রাজ্যে সিপিএম সরকারের খবর। জ্যোতি বসুর সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। অখিলেশ তখন অস্ট্রেলিয়া থেকে পড়াশোনা সেরে সদ্য দেশে ফিরেছেন।

এ ভাবেই কখন যে পায়ে পায়ে ভিতরের একটা ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম আমি এবং এক বন্ধু সাংবাদিক, খেয়াল নেই। হঠাৎ দেখি, সেই ঘরের দরজাটি (একটাই) বন্ধ করে দেওয়া হল বাইরে থেকে। এ বার উপায়? আমরা ছটফট করছি, বাইরে না কিছু ঘটে যায়। অর্থাৎ মুলায়ম এসে কিছু বলে না-চলে যান। আজকের মতো মোবাইল ফোনের যুগ নয়, আমার কাছে তা নেইও।

ছটফটানির মধ্যেই কাটল মিনিট দশেক। দরজাটা খুলে গেল বাইরে থেকে। হাঁফ ছেড়ে দৌড়ে বার হতে যাব, দেখি ঘরে ঢুকছেন ‘নেতাজি’, খোদ মুলায়ম সিংহ যাদব! সঙ্গে আরও দু’এক জন ছিলেন। যাঁর সঙ্গে সেদিন দু’মিনিট কথা বলার জন্য বাইরে অপেক্ষমান অন্তত হাজার জনতা এবং সংবাদমাধ্যম। আমাদের দু’জনকে দেখে কিছুটা বিস্মিত তবে অপ্রস্তুত নন পোড় খাওয়া ওই নেতা। জানতে চাইলেন, এখানে বসে কী করছি! আমরা কোনও মতে যা বললাম তার মর্মার্থ, অনেক দূর থেকে এসেছি, তাঁর সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলব বলে! অনুনকরণীয় উচ্চারণে ়অনুমতি দিলেন প্রশ্নের। আমাদের তখন হাতে চাঁদ! প্রায় ১৫ মিনিট কথা হল। জানালেন কত জন বিএসপি বিধায়ক তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন। তাঁরা কারা। কবে তিনি রাজভবন যাচ্ছেন। কবে শপথ নেবেন গোমতীর ধারে। আর বারবার বললেন, “লিখবেন আমরা ঘোড়া (বিধায়ক) বেচাকেনা করছি না, এঁরা এবং বেশ কিছু নির্দল বিধায়ক মায়াবতীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের দ্বারস্থ হয়েছেন।” তখনকার প্রেক্ষিতে আরও ়কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন, আজ আর মনে নেই। পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের খোঁজখবর নিয়েছিলেন।

ঠিক এক দিন পর সবাই সব জেনে গিয়েছিল, কিন্তু ওই দিন আমরা দু’জন ছাড়া আর কেউ টিকি পায়নি এসপি-র সর্বাধিনায়কের। আমরাও পেয়েছিলাম নেহাতই বরাতজোরে। তার চেয়েও বড় কথা, অনাহুত দুই সাংবাদিককে সেই ঘটমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে মুলায়ম যা বলেছিলেন তার মধ্যে এতটুকু খাদ ছিল না। রাজনীতিক হিসাবে তাঁকে বাইরে থেকে বোঝা বা তাঁর কথার উপর ভরসা করা যে সবসময় সম্ভব হত না, বারবার তার সাক্ষী লখনউ এবং দিল্লির রাজনৈতিক মহল। ২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটের কয়েক মাস আগে যখন ভাই শিবপাল এবং ছেলে অখিলেশের মধ্যে লড়াই প্রকাশ্যে, মুলায়ম সাংবাদিক সম্মেলন করে সবাইকে বোকা বানিয়ে ছেড়েছিলেন। ভাব দেখিয়েছিলেন যেন তিনি শিবপালেরই পক্ষে। তাঁর সেই সাংবাদিক সম্মেলনের পর অখিলেশের সমর্থকেরা দলীয় দফতরের বাইরে এমন ভাবে ঘেরাও করেন যে মুলায়ম বহুক্ষণ বেরোতে পারেননি। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল শিবপালকেই দলের এবং সরকারের সব পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হল! অতিমারি চলাকালীনও সংসদের অলিন্দে দেখা গিয়েছে হুইল চেয়ারে বসা মুলায়মকে। কথা প্রায় জড়ানো। কানের কাছে মুখ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করলে সাধ্যমতো জবাব দিয়েছেন। কিন্তু তখন তিনি উত্তরপ্রদেশের বা বিরোধী রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলোয় আর নেই।

কর্মসূত্রে সদ্য দিল্লিতে আসা এক সাংবাদিকের স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছেন এখনও— দরজা খুলে হঠাৎ ঢুকে আসছেন গোবলয়ের সবচেয়ে বড় রাজ্যের রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রে থাকা নেতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE