যাদের কোলে করে বিমানবন্দরে ছেড়ে এসেছিলাম, তাদেরই মরদেহ কোলে নিয়ে কী করে ফিরব জানি না। আর ভাল লাগছে না। এই অপেক্ষা আর শেষ হচ্ছে না। গুজরাত প্রশাসনের কাছে হাতজোড় করে প্রার্থনা করছি, দয়া করে আমাদের দিকটা ভাবুন।
পরিবারের লোকগুলোর নাওয়া-খাওয়া, ঘুম উড়ে গিয়েছে। আপনজনের মৃত্যুর চেয়েও এখন বড় হয়ে গিয়েছে কখন তাঁদের মরদেহটা অন্তত পাওয়া যাবে সেই অপেক্ষা। কখন মৃতদেহ পাব জানতে চাইলেই প্রতি ঘণ্টায় আপনারা মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছেন, আর আমাদের পরিবার বাড়িতে বসে একই প্রশ্ন করে চলেছে। ছেলে, বৌমা, নাতি-নাতনির শোকে আমার দিদি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। এ ভাবে ওকেই বা কত দিন বাঁচাতে পারব জানি না।
আমাদের বাড়ি মুম্বইয়ের গোরেগাঁও। দিদিকে দেখতেই ইদের ছুটিতে লন্ডন থেকে পরিবার নিয়ে এসেছিল ছোট ভাগ্নে জাভেদ আলি। ছুটি কাটিয়ে সেখানে ফিরছিল। ওরা ফিরে যাচ্ছে বলে আমার খুব মন খারাপ। কিন্তু ভাগ্নে-বউ মারিয়াম কিছুতেই ছাড়বে না। ওদের বিমানে তুলতে তাই যেতে হয়েছিল। মারিয়াম আর জাভেদের আট বছরের ছেলে আর চার বছরের মেয়ে। মনে হচ্ছে এই তো ওদের দু’জনকে কোলে নিয়ে বিমানবন্দরে নামালাম। তারপর হঠাৎ করে আমদাবাদের এক আত্মীয় ফোন করলেন। জানতে চাইলেন, যে বিমান ভেঙে পড়েছে তাতে আমার ভাগ্নেরা আছে কি না। তখনও আমি কিছুই জানি না।
তড়িঘড়ি জাভেদের দাদা, আমার বড় ভাগ্নে ইমতিয়াজকে নিয়ে এখানে ছুটে এলাম। বৃহস্পতিবার রাতেই ইমতিয়াজ ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা দিল। কিন্তু তারপর থেকে আর কিছুই জানতে পারছি না।
রোজ ভোরে উঠে এই বি জে মেডিক্যাল কলেজে এসে বসে থাকছি। ডাক্তারদের কাছে বারবার ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করছি। কিন্তু কোনও রকম রিপোর্ট দেওয়ার কোনও ব্যাপার দেখছি না। কখনও কোনও ডাক্তার বা পুলিশের কাউকে হাত চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা উপরের কাউকে দেখিয়ে দিচ্ছেন। তিনি আবার কোনও কথাই বলতে চাইছেন না। কখনও খুব দয়া হলে বলে দেওয়া হচ্ছে, অন্তত ৭২ ঘণ্টা লাগবেই। রিপোর্ট এলে, আর সেই রিপোর্ট যদি মিলে যায় তবে ফোন করা হবে।
কিন্তু বুঝতে পারছি না, রিপোর্ট পেতে এত দেরি হবে কেন? তারপর রিপোর্ট না মিললেই বা কী হবে? ডাক্তার-বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারছি, ডিএনএ নমুনা দূষিতও হয়ে যেতে পারে। এমনটা হলে নাকি ওদের মরদেহ পাওয়া আরও কঠিন হয়ে যাবে। কোথায় যাব, কী করব বুঝতে পারছি না।
আমার এখন আশঙ্কা হচ্ছে, ৭২ ঘণ্টা সময় লাগার কথাটা শুধুই আশ্বাস নয় তো? এখানকার প্রশাসন কি পরিস্থিতি ঠান্ডা হওয়ার অপেক্ষা করছে? এরপর সংবাদমাধ্যমের নজর ঘুরে যাবে, একে একে সকলেই বাড়ি চলে যাবেন। এরপর ধীরেসুস্থে হয়তো বা মৃতদেহ দেওয়া হবে। তারপর কোনও গাফিলতি হলেও আর সুরাহা পাওয়া যাবে না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)