কাছাকাছি: (বাঁ দিকে) সোমবার দিল্লির আকাশে বৃহস্পতি ও শনি। পিটিআই। ( ডান দিকে) নীচে বৃহস্পতি ও তার চারটি উপগ্রহ, উপরে শনি ও তার চারটি উপগ্রহ। ছবি: ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজ়িক্সের সৌজন্যে
বৃহস্পতিকে ছাড়িয়ে শনির উদ্দেশে উড়ে চলেছে মহাকাশযান ভয়েজ়ার-২। এমন সময় তার চোখে পড়ল বৃহস্পতির লেজ যেন শনিকে ছুঁয়ে ফেলেছে! এমন দৃশ্য আগে দেখা যায়নি। কিন্তু সত্যিই কি বৃহস্পতির লেজ আছে? সত্যিই কি শনিকে ছুঁয়ে থাকে? বৃহস্পতির এই লেজের মতো বস্তুটি আসলে ঠিক লেজ নয়। সূর্য থেকে নির্গত তড়িদাহত কণা বৃহস্পতির প্রবল চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে আটকে পড়ে লেজের মতো বস্তু তৈরি করে। সে লেজের বিস্তার বহুদূর।
সোমবার যখন একই আকাশে বৃহস্পতি ও শনিকে সব থেকে কাছাকাছি দেখা গিয়েছে, তখন এই ১৯৮২ সালের ভয়েজ়ার-২ থেকে ধরা পড়া দৃশ্যের কথা কেন বললাম, তা ব্যাখ্যা করার আগে কতগুলি তথ্য জানানো প্রয়োজন। এই প্রথম টেলিস্কোপের দৃশ্যপটে একইসঙ্গে বৃহস্পতি ও শনি ধরা দিল। ১২২৬ সালের ৫ মার্চ যখন এই ঘটনা ঘটেছিল। ১৬১০ সালে গ্যালিলিয়ো টেলিস্কোপ আবিষ্কারের ১৩ বছর পরে ১৬২৩ সালের ১৬ জুলাই দুটি গ্রহ কাছাকাছি এলেও সূর্যের খুব কাছে থাকায় দেখা যায়নি। তাই এ বারই প্রথম। তবে এই নান্দনিক দৃশ্যের পাশাপাশি বিজ্ঞানীদের আরও যে আগ্রহটি রয়েছে তা বলতেই ভয়েজ়ারের ঘটনাটি বললাম।
১৯৮২ সালে ভয়েজ়ার বৃহস্পতির লেজের খবর দেওয়ার পর থেকেই তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছিল এবং সেটাও বোঝা গিয়েছিল, বৃহস্পতির ওই লেজ তখনই শনির কাছে যাবে যখন সূর্য, বৃহস্পতি এবং শনি একই সরলরেখায় থাকবে। বৃহস্পতির ওই বহুদূর বিস্তৃত তড়িদাহত লেজ শনিকে ছুঁয়ে ফেলতে পারে। সেই পুচ্ছ শনিকে ছুঁয়ে ফেললে কী ঘটে, তা জানার চেষ্টা বহু দিন আগেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু এই মহাজাগতিক পরীক্ষা তো গবেষণাগারে সম্ভব নয়। এ ধরনের ঘটনার সময়েই তা জানা সম্ভব। কিন্তু একই সরলরেখায় তিন জনের আগমন দুই দশক পরে একবার ঘটে। সেই হিসেবে ২০২০ সালেও দুজনে একই সরলরেখায় এসেছিল। কিন্তু তখনও তেমন টেলিস্কোপ ছিল না যা এই দৃশ্য ধরে বিজ্ঞানীদের দিতে পারে। সময়ের সঙ্গে প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে। তাই এ বার সেই পরীক্ষা হয়েছে। গত ২৩ নভেম্বর সূর্য, বৃহস্পতি ও শনি একই সরলরেখায় এসেছিল। নাসার চন্দ্র নামে কৃত্রিম উপগ্রহ সেই দৃশ্য ধরেছে। তবে গবেষণার ফল এখনও অজানা। হয় তো ভবিষ্যতে তা জানা যাবে, বৃহস্পতির ‘হৃদয়ের কথা’ আদৌ শনি শুনতে পেল কিনা!
আরও পড়ুন: বৈঠক-প্রস্তাবে নীরব চাষিরা
বিজ্ঞানের গবেষণার এ সব দিক রয়েছে। কিন্তু এই মহাজাগতিক নান্দনিকতার রূপ আমজনতার মধ্যে যে উৎসাহের সঞ্চার ঘটিয়েছে তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। আকাশে এমন জ্বলজ্বলে দুই জ্যোতিষ্ক এত কাছাকাছি এবং আটশো বছর পরে তা মানুষের চোখে ধরা দেবে (১৬২৩ সালে তা দেখা যায়নি), এ কথা ভাবতেই তো শিহরণ জাগে। বিজ্ঞানী হিসেবে বলতে পারি, আমজনতার এই উৎসাহে আমি পুলকিত। পুণেতে জ্যোতির্বিদ্যা পরিসংস্থা ছটি টেলিস্কোপ বসিয়েছিল। অতিমারি পরিস্থিতিতে সুরক্ষা বিধি মেনে অনেকে এসেছিলেন। সকাল থেকে পুণের পুর-কমিশনার, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফোন করে জানতে চেয়েছেন, কী ভাবে, কখন দেখতে পাওয়া যাবে। আমি তো অনলাইন ক্লাসের মাঝে দশ মিনিটের ছুটি দিয়েছিলাম। ক্লাসঘরের পাঠের বাইরেও যাতে আকাশে চোখ রাখতে পারে পড়ুয়ারা। ইন্ডিয়ান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি লাদাখ, মুম্বই, বেঙ্গালুরু-সহ ১২টি জায়গায় টেলিস্কোপ বসিয়ে ইন্টারনেটে সরাসরি দেখিয়েছে।
অস্বীকার করার উপায় নেই, আর পাঁচটা মহাজাগতিক ঘটনার মতো এই বৃহস্পতি-শনি সংযোগ ঘিরেও প্রচুর রটনা, কুসংস্কার ছড়িয়েছিল। যার বিজ্ঞানগত ভিত্তি নেই। জ্যোতিষশাস্ত্রে বৃহস্পতি ও শনির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে কিন্তু বিজ্ঞানী হিসেবে বলতে পারি, এই দুটি গ্রহ অভিকর্ষ বলের মাধ্যমে কোনও প্রভাব ফেলে না। তা ছাড়া, পৃথিবী থেকে বৃহস্পতি যত দূরে অবস্থিত, বৃহস্পতি থেকে শনি ততটাই দূরে অবস্থিত। চাঁদ ও সূর্যের প্রভাবে জোয়ার-ভাটা হয় বটে কিন্তু বৃহস্পতি ও শনি এতটাই দূরে এবং তাদের অভিকর্ষ বলের প্রভাব এতটাই কম যে এক দিকে থাকলেও প্রভাব পড়বে না।
অধিকর্তা, ইন্টার-ইউনিভার্সিটি অব অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজ়িক্স, পুণে
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy