ভাই তেজস্বী যাদব এবং তাঁর ঘনিষ্ঠদের কাঠগড়ায় তুলে বাড়ি ছেড়েছেন লালুপ্রসাদ যাদবের কন্যা রোহিণী আচার্য। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই রবিবার পটনার বাড়ি ছাড়লেন লালুর আরও তিন কন্যা রাজলক্ষ্মী, রাগিনী এবং চন্দা। যাদব পরিবারের ঘনিষ্ঠমহল সূত্রে খবর, বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে আরজেডির খারাপ ফলাফলের পর ঘরের কোন্দল যে ভাবে প্রকাশ্যে চলে এসেছে, তাতে তিতিবিরক্ত তাঁরা। সেই কারণেই তাঁরা বাড়ি ছেড়ে দিল্লি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে ওই সূত্রের দাবি।
বছর দুয়েক আগে নিজের কিডনি অসুস্থ লালুকে দান করে ‘পুনর্জীবন’ দিয়েছিলেন কন্যা রোহিণী। সেই রোহিণী শনিবার সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করে পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা জানান। রাজনীতির সংস্রব ত্যাগের কথাও জানান তিনি। এখানেই শেষ নয়, রোহিণী দাবি করেন, বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে তাঁকে গালিগালাজ করা হয়েছে। মারার জন্য তোলা হয়েছে জুতোও। রবিবার সকালে সমাজমাধ্যমে আরও এক ধাপ এগিয়ে রোহিণী জানান, বাবাকে কিডনি দেওয়া নিয়েও তাঁকে খোঁটা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তাঁর কিডনি ‘নোংরা’। রোহিণী লেখেন, ‘‘আমাকে গালিগালাজ করে বলা হয়েছে, আমি নোংরা। আমি আমার নোংরা কিডনি বাবাকে দিয়েছি। কোটি কোটি টাকা নিয়েছি। টিকিট কিনেছি।’’
ইতিমধ্যেই রোহিণীর পাশে দাঁড়িয়ে বোনের অপমান সহ্য করা হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন লালুর ত্যাজ্যপুত্র তেজপ্রতাপ। রবিবার তেজপ্রতাপ সমাজমাধ্যমে লেখেন, ‘‘যখন থেকে শুনেছি, আমার বোনকে মারার জন্য জুতো তোলা হয়েছে, আমার মনের ব্যথা আগুনে পরিণত হয়েছে। জনগণের আবেগে যখন ধাক্কা দেওয়া হয়, তখন বোধশক্তির উপরে যে ধুলো জমে, তা উড়ে যায়। কিছু মুখ তেজস্বীর বোধশক্তিও মেঘাচ্ছন্ন করে রেখেছে।’’ এর পরিণাম ভাল হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তেজপ্রতাপ।
যাদব পরিবারে গোলযোগের সূত্রপাত অবশ্য এই তেজপ্রতাপকে কেন্দ্র করেই। দল এবং পরিবার থেকে বিতাড়িত লালুর জ্যেষ্ঠপুত্র তেজপ্রতাপকে নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয় গত ২৪ মে। ওই দিন সন্ধ্যায় তেজপ্রতাপের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে তাঁর সঙ্গে অনুষ্কা যাদব নামের এক মহিলার একটি ছবি পোস্ট করা হয়। সেই পোস্টে দাবি করা হয়, তেজপ্রতাপ এবং অনুষ্কা গত ১২ বছর ধরে প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ। দীর্ঘ দিনের সেই সম্পর্কের কথা এখন তিনি প্রকাশ্যে আনছেন। সেই পোস্ট প্রকাশ্যে আসতেই শোরগোল পড়ে যায় বিহারের রাজনীতিতে। যদিও তেজপ্রতাপ পরে দাবি করেন, তাঁর ফেসবুক প্রোফাইল হ্যাক করা হয়েছে। তাঁর এবং তাঁর পরিবারের মানহানির লক্ষ্যেই এই সব ছবি পোস্ট করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
গুজবে কান না-দেওয়ার আহ্বানও জানান তিনি। তবে তাতে চিঁড়ে ভেজেনি। ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ’ এবং ‘পারিবারিক মূল্যবোধ ক্ষুণ্ণ’ করার কারণে তেজপ্রতাপকে দল এবং পরিবার থেকে বিতাড়িত করেন লালু। তার পরেই ‘জনশক্তি জনতা দল’ গঠন করেছন তেজপ্রতাপ। ২২টি আসনে প্রার্থীও দেন। কিন্তু একটি আসনেও জয়ী হয়নি তাঁর দল। এমনকি নিজের মহুয়া কেন্দ্রে লড়তে নেমে হেরে যেতে হয়েছে তেজপ্রতাপকেও।
তেজপ্রতাপ দল এবং পরিবার থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরেই যাদব পরিবারে বিভাজনরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। লালু-পুত্র তেজস্বী কিংবা কন্যা মিসা ভারতী যেমন এই বিষয়ে নীরব থাকলেও ভাই তেজপ্রতাপের সমর্থনে একাধিক বার কথা বলতে দেখা গিয়েছে রোহিণীকে। এমনকি বিহারে প্রথম দফার ভোটের দিনও তেজপ্রতাপকে আশীর্বাদ করার কথা জানান রোহিণী। সেই সময় এক বারও ছোট ভাই তেজস্বীর নাম করতে শোনা যায়নি তাঁকে। মা রাবড়ী দেবী অবশ্য নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা দুই পুত্র (তেজস্বী এবং তেজপ্রতাপ)-কেই আশীর্বাদ করার কথা জানান।
২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভায় শেষ বার ৭৫টি আসন পেয়েছিল লালু-তেজস্বীর দল। এ বার সেই সংখ্যা কমে হয়েছে মাত্র ২৫। মনে করা হচ্ছে, আরজেডির এই টালমাটাল সময়ে যাদব পরিবারের ঘরোয়া কোন্দল, যা এত দিন কোনও রকমে গোপন রাখা হয়েছিল, তা প্রকাশ্যে চলে আসছে।
লালু-রাবড়ীর নয় সন্তান। সাত কন্যা এবং দুই পুত্র। প্রত্যেকেরই বিয়ে হয়েছে কোনও না কোনও প্রভাবশালী পরিবারে। তেজপ্রতাপ যখন বিতর্কে জড়ান, তখন অবশ্য স্ত্রী ঐশ্বর্য রাইয়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চলছে। নয় সন্তানের মধ্যে তেজস্বী, তেজপ্রতাপ এবং মিসাই রাজনীতিতে সক্রিয়। কিন্তু পারিবারিক রাজনীতি লালুর পরিবারে দীর্ঘ ছায়া ফেলতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। রোহিণীর অভিযোগ থেকে স্পষ্ট, তিনি দলের শোচনীয় পরাজয়, পারিবারিক বিরোধী— এই সব কিছুর জন্য দায়ী করছেন ছোট ভাই তেজস্বীকে। নির্দিষ্ট দু’জনকে। তাঁদের এক জন হলেন তেজস্বী-ঘনিষ্ঠ আরজেডি সাংসদ সঞ্জয় যাদব। অপর জন তেজস্বীর পুরনো বন্ধু রমীজ়। তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল গোটা বিতর্কে এখনও পর্যন্ত প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি তেজস্বী।
মহাভারতের মুষলপর্বের আখ্যান অনুযায়ী, কৃষ্ণের যদুবংশ ধ্বংস হয়েছিল। বিহারের যাদববংশ বিভক্ত হতে হতে ধ্বংস হয়ে যাবে কি না, তার উত্তর অবশ্য ভবিষ্যতের গর্ভে। রাজনীতিতে নানা অসাধ্যসাধন করা ৭৭ বছর বয়সি লালু পরিবারের ফাটল মেরামত করতে সফল হন কি না, তা-ই এখন দেখার।