পহেলগাঁও কাণ্ডের পর প্রায় ২৫ দিন কেটে গিয়েছে। হামলাকারী জঙ্গিরা কোথায়, সেই প্রশ্নে নিরুত্তর নিরাপত্তাবাহিনী এবং জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)।
কাশ্মীরে স্বর্গের মতো বৈসরন উপত্যকায় কারা সে দিন নিরীহ পর্যটকদের বেছে বেছে হত্যা করেছিল, তাদের চিহ্নিত করতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বৈসরন উপত্যকা তোলপাড় করেছে এনআইএ। তথ্যপ্রমাণ জোগাড় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং তদন্তকারীদের নিজস্ব সূত্রে এনআইএ জানতে পেরেছে, বৈসরনের হত্যালীলায় অন্ততপক্ষে পাঁচ থেকে সাত জন জঙ্গির যোগ ছিল। তাদের চিহ্নিত করেছে এনআইএ। চার জঙ্গির স্কেচও প্রকাশ করা হয়েছিল। তদন্তকারী সংস্থা এ-ও জানতে পেরেছে, পাকিস্তানে বসেই পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার ষড়যন্ত্র করেছে ‘দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ)-এর নেতা বছর পঞ্চাশের শেখ সাজ্জাদ গুল। কিন্তু তারা কেউই এখনও তদন্তকারী সংস্থার হাতের নাগালে আসেনি।
পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেশ কিছু কড়া কূটনৈতিক পদক্ষেপ করেছে ভারত। তার পর পাক অধিকৃত কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের ভিতরে থাকা জঙ্গিশিবিরগুলি ধ্বংস করতে গভীর রাতে ভারতের আচমকা হামলা— ‘অপারেশন সিঁদুর’। ভারতের প্রত্যাঘাতের পর কয়েক দিন ধরে দিনে-রাতে পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই এবং অবশেষে সংঘর্ষবিরতির ঘোষণা। এ সবের মধ্যেই উপত্যকায় ধরপাকড় এবং তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ এবং নিরাপত্তাবাহিনী। ইতিমধ্যেই সোপিয়ান এবং পুলওয়ামায় অভিযান চালিয়ে ছয় জঙ্গিকে নিকেশ করা হয়েছে। শুক্রবারও জঙ্গি সংগঠন লশকর-এ-ত্যায়বার সহযোগী দু’জন পুলিশের জালে ধরা পড়েছে। তবে তদন্তকারী সংস্থার নজরে এখনও আট জঙ্গি। সূত্রের খবর, তাদের খোঁজে শনিবারও উপত্যকার কুপওয়ারা, শ্রীনগর, বারামুলা-সহ ১০ জায়গায় তল্লাশি অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেউই আটক বা গ্রেফতার হননি।
পহেলগাঁও কাণ্ডের পর স্থানীয় জঙ্গিদের তালিকা তৈরি করে তাদের অনেকের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে সেনা এবং প্রশাসন। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পুলওয়ামার বাসিন্দা আসিফ শেখ ও অনন্তনাগের বাসিন্দা আদিল ঠোকারের বাড়ি। তাদের স্কেচও প্রকাশ করা হয়েছিল। এর পর গত মঙ্গলবার শোপিয়ানে তিন জঙ্গির উপস্থিতির খবর পায় সেনা এবং পুলিশ। তার পরেই অভিযান। দু’পক্ষের মধ্যে গুলির লড়াই চলে। সেনা সূত্রে জানানো হয়, ওই অভিযানে তিন জঙ্গি নিহত হয়েছে। তারা হল, শাহিদ কুট্টে, আদনান শফি দার, এহসান আহমেদ শেখ।
তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, ওই তিন জনই লশকর-এ-ত্যায়বার সঙ্গে যুক্ত। ঘটনাচক্রে, পহেলগাঁওয়ে হামলার ঘটনার দায় স্বীকার করেছিল টিআরএফ। এই ‘টিআরএফ’ লশকর-এ-ত্যায়বার ছায়া সংগঠন বলেই পরিচিত। অন্য দিকে, পুলওয়ামা জেলার ত্রালে নিরাপত্তাবাহিনীর অভিযানে যে তিন জঙ্গি নিহত হয়েছে, তারা জইশ-ই-মহম্মদের সঙ্গে যুক্ত। তারাও কোনও না কোনও ভাবে পহেলগাঁওয়ের হামলাকারীদের সাহায্য করে থাকতে পারে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।
তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, তল্লাশি অভিযানে কিছু মোবাইল ফোন উদ্ধার হয়েছে। নিহত জঙ্গিদের সঙ্গে পহেলগাঁও কাণ্ডের হামলাকারীদের কোনও যোগ রয়েছে কি না, তা উদ্ধার হওয়া সেই সব মোবাইল ফোন থেকে জানা গেলেও যেতে পারে। মোবাইলগুলিকে ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে খবর, পহেলগাঁও কাণ্ডে আদিলদের জড়িত থাকার বিষয়ে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছিলেন জঙ্গি জুনায়েদ ভাটের মোবাইল ফোন ঘেঁটে। সোনমার্গ সুড়ঙ্গে হামলা চালানোর ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে আগেই জুনায়েদকে নিকেশ করেছিল নিরাপত্তাবাহিনী। সেই একই ভাবে পহেলগাঁও কাণ্ডে জড়িত বাকি জঙ্গিদেরও খোঁজ মিলতে পারে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।
ভারতীয় সেনার ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে হইচইয়ের মধ্যে এনআইএ-র তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন, শেখ সাজ্জাদ গুলই পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডের মূল মাথা। টিআরএফ-এর এক শীর্ষ পদে সে-ই বসে রয়েছে। তদন্তকারীরা আরও জানতে পেরেছেন, পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির বাসিন্দা শেখ সাজ্জাদ গুল, নাম ভাঁড়িয়ে সাজ্জাদ আহমেদ শেখ নামেও পরিচিত। কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে তার। ২০২০ ও ২০২৪ সালে মধ্য ও দক্ষিণ কাশ্মীরে রক্ত বইয়েছে সে। এ ছাড়াও ২০২৩ সালে মধ্য কাশ্মীরে গ্রেনেড হামলা কিংবা অনন্তনাগে পুলিশকর্মী হত্যা— একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে গিয়েছে শেখ সাজ্জাদ গুল। এনআইএ তার মাথার দাম ঘোষণা করেছে ১০ লক্ষ টাকা। কিন্তু পহেলগাঁও হামলার মূল চক্রী এখন কোথায়— সেই খবর তদন্তকারীদের কাছে নেই।
গোয়েন্দাদের কেউ কেউ মনে করছেন, ঘটনার এত দিন পরেও জঙ্গিরা যে ভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তা থেকে স্পষ্ট, ওই এলাকায় স্থানীয় পর্যায়ে সাহায্য পাচ্ছে জঙ্গিরা। আপাতত সেই স্থানীয় সাহায্যকারীদের চিহ্নিত করাই সবচেয়ে বড় লক্ষ্য গোয়েন্দাদের।
সেই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই স্থানীয় জঙ্গিদের একটি ‘হিট লিস্ট’ তৈরি করেছে তদন্তকারী সংস্থা। সেই তালিকায় ১৪ জন রয়েছে। শোপিয়ান এবং পুলওয়ামার তল্লাশি অভিযানে যে ছ’জনকে নিকেশ করা হয়েছে, তারাও সেই তালিকায় ছিল। এ বার বাকি আট জনের খোঁজ চলছে। সেই আট জনের মধ্যে রয়েছে আদিল রহমান দেন্তু (সোপোরে লশকর কমান্ডার), হরিশ নাজির (পুলওয়ামার লশকর জঙ্গি), আসিফ আহমেদ কন্ডে (হিজবুল জঙ্গি), নাসির আহমেদ ওয়ানি (লশকর জঙ্গি), আমির আহমেদ দার (লশকর সহযোগী), জুবের আহমেদ ওয়ানি (অনন্তনাগে হিজবুলের অপারেশনাল কমান্ডার), হারুন রশিদ গনি (অনন্তনাগে হিজবুলের সক্রিয় সদস্য) এবং জুবেইর আহমেদ গনি (কুলগামে সক্রিয় লশকর জঙ্গি)।
পাশাপাশি স্কেচ ধরেও জঙ্গিদের খোঁজে তল্লাশি অভিযান জারি। কিন্তু সূত্রের মতে, প্রত্যক্ষদর্শীদের মারফত জঙ্গিদের যে বিবরণ এনআইএ-র কাছে জমা পড়েছে, তার সঙ্গে আগের স্কেচের ফারাক রয়েছে। সম্ভবত সংশয় এড়াতে ফের প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে নতুন করে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। হামলার সময়ের একাধিক ছবি, ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ঘোরাফেরা করছে। এনআইএ সেই সব ভিডিয়ো, ছবি খতিয়ে দেখার পক্ষপাতী। যাতে কোনও তথ্য তদন্তের পরিধির বাইরে না থেকে যায়। এনআইএ-এর মতে, পর্যটক এবং সেখানে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে ঘটনার দিনে, ঘটনা ঘটার আগে বা পরে কিছু শুনেছেন, দেখেছেন, ছবি তুলেছেন। এ ধরনের যে কোনও তথ্য তদন্তে সাহায্য করবে বলেই মনে করে এনআইএ।