Advertisement
E-Paper

সেনা-এনএসজি দ্বন্দ্বে জঙ্গি দমন অভিযান শুরুতে অযথা দেরি পঠানকোটে

পঠানকোটের বায়ুসেনা ঘাঁটিতে জঙ্গি হামলার মোকাবিলা ভারত করেছে। কিন্তু যে কৌশলে মোকাবিলা, তাকে ১০-এর মধ্যে ৫-এর বেশি নম্বর দেওয়া সম্ভব নয়। নজরদারিতে গাফিলতি, সমন্বয়ের অভাব আর অচেনা পরিস্থিতিতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রস্তুতি না থাকা— এই তিনটি কারণে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে পঠানকোটে জঙ্গি দমনের অভিযান।

কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) সৌমিত্র রায়

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৬ ২১:২৯

পঠানকোটের বায়ুসেনা ঘাঁটিতে জঙ্গি হামলার মোকাবিলা ভারত করেছে। কিন্তু যে কৌশলে মোকাবিলা, তাকে ১০-এর মধ্যে ৫-এর বেশি নম্বর দেওয়া সম্ভব নয়। নজরদারিতে গাফিলতি, সমন্বয়ের অভাব আর অচেনা পরিস্থিতিতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রস্তুতি না থাকা— এই তিনটি কারণে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে পঠানকোটে জঙ্গি দমনের অভিযান। মাল্টিরোল এয়ারক্র্যাফট এবং বহুমূল্য অ্যাটাক হেলিকপ্টারে জঙ্গিরা শেষ পর্যন্ত আঁচড় কাটতে পারেনি, সেটুকুই একমাত্র সাফল্য।

বায়ুসেনার ঘাঁটিতে শত্রুপক্ষের আক্রমণ সাধারণত আকাশপথেই হয়। অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফট ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র এবং অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফট গান বায়ুসেনা ঘাঁটির বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট বা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোতায়েন করা থাকে। কিন্তু পঠানকোটে যে আক্রমণ হল, তা আকাশপথে হল না। হল গ্রাউন্ড অ্যাটাক। জঙ্গিরা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পঠানকোট এয়ারবেস পর্যন্ত কীভাবে পৌঁছল, সে এখন সকলেরই জানা। কিন্তু আগে জানা ছিল না যে স্থলপথে বিমানঘাঁটিতে হানা দেওয়ার চেষ্টা করবে জঙ্গিরা। এই ধরনের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাও ছিল না। যে কোনও আপৎকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য যদি প্রস্তুত থাকত বায়ুসেনা কর্তৃপক্ষ, তা হলে এই আক্রমণকেই গোড়াতেই রুখে দেওয়া যেত।

বায়ুসেনা ঘাঁটির নিরাপত্তার দায়িত্ব কার? এই দায়িত্ব মূলত বায়ুসেনারই। বায়ুসেনার গরুড় কম্যান্ডো এবং ডিফেন্স সিকিওরিটি কোর বা ডিএসসি বায়ুসেনা ঘাঁটির নিরাপত্তা ব্যবস্থার দেখভাল করে। পঠানকোটে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তার মোকাবিলার জন্য এই দুই বাহিনীর কোনওটিই যথার্থ নয়। গরুড় কম্যান্ডো অত্যন্ত দক্ষ এবং ক্ষিপ্র বাহিনী। কিন্তু তারা মূলত অফেন্সিভ ফোর্স। অর্থাৎ দ্রুত আক্রমণ চালিয়ে শত্রুর এলাকা তছনছ করতে তারা বেশি পারদর্শী। স্থলযুদ্ধের প্রশিক্ষণ থাকলেও আকাশপথে যুদ্ধবিগ্রহ চালানোয় তারা বেশি দক্ষ। বায়ুসেনার বিমানঘাঁটিতে স্থলপথে আক্রমণ হলে, তা প্রতিরোধ করা গরুড়ের কাজ নয়। পড়ে রইল ডিএসসি। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর জওয়ানরা এই ডিএসসি-তে যোগ দেন। ফলে ডিএসসি-কে খুব ক্ষিপ্র বাহিনী হিসেবে ধরা যায় না। এই বাহিনীর প্রশিক্ষণও মূলত ডিফেন্সিভ বা আত্মরক্ষামূলক। তাই এক বার জঙ্গিরা বায়ুসেনা ঘাঁটিতে ঢুকে পড়ার পর, তাদের বিরুদ্ধে অফেন্সিভ বা আক্রমণাত্মক লড়াই দেওয়া ডিএসসি-র পক্ষেও সম্ভব নয়। কারণ সেই ধরনের সরঞ্জাম বা অস্ত্রশস্ত্রও ডিএসসি-র কাছে থাকে না। জঙ্গি আক্রমণকে কিছুক্ষণ বা অনেকক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা ছাড়া খুব বেশি ছিল না করার নেই ডিএসসি-রও।

এই সংক্রান্ত আরও খবর...
সীমান্তের গুরুদ্বারে সেই রাতেই প্রথম যান এসপি

ডোভালই ডোবালেন পঠানকোটে

অভিযানের নেতৃত্ব নিয়ে বেনজির সঙ্কট

দুই জঙ্গির খোঁজে চলছে তোলপাড়

প্রশ্ন উঠছে, জঙ্গিরা পঠানকোটের বায়ুসেনার বিমানঘাঁটিতে ঢুকল কীভাবে। এই বিষয়টি বোঝার জন্য বায়ুসেনা ঘাঁটির নকশা বোঝা জরুরি। প্রায় ২০ কিলোমিটার বা তারও বেশি ব্যাসের এলাকা জুড়ে অবস্থিত পঠানকোটের বায়ুসেনা ঘাঁটি। অধিকাংশ বায়ুসেনা ঘাঁটির আকারই এই রকম হয়। এই এলাকা তিনটি ভাগে বিভক্ত থাকে— ডোমেস্টিক এরিয়া, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যান্ড টেকনিক্যাল এরিয়া এবং অপারেশনাল এরিয়া। বায়ুসেনার কর্মীদের আবাসন, ক্যান্টিন, স্কুল, বাজার, হাসপাতাল-সহ বিভিন্ন অসামরিক পরিকাঠামো থাকে ডোমেস্টিক এরিয়ায়। এই এলাকার নিরাপত্তা খুব জোরদার হয় না। এর চেয়ে কিছুটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যান্ড টেকনিক্যাল এরিয়া। এই এলাকায় বায়ুসেনা ঘাঁটির মূল প্রশাসনিক দফতর থাকে। থাকে রেডার, জ্বালানি তেলের মজুত রাখায় জায়গা এবং অস্ত্রশস্ত্রের গুদাম। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হল অপারেশনাল এরিয়া। সেখানে সার সার হ্যাঙ্গারের মধ্যে রাখা থাকে ফাইটার জেট এবং হেলিকপ্টারগুলি। হ্যাঙ্গারগুলিকে এমন ভাবে ক্যামোফ্লাজ করা থাকে যে আকাশ থেকেও কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় কোথায় হ্যাঙ্গার রয়েছে। রানওয়ে-ও থাকে অপারেশনাল এরিয়াতেই। রানওয়ের দু’পাশে মাটির নীচে তৈরি থাকে অপারেশনাল রেডিনেস প্ল্যাটফর্ম বা ওআরপি। এই ওআরপি-তে ফাইটার জেট সব সময় প্রস্তুত থাকে যে কোনও আপৎকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য। মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে গোপন ডেরা থেকে বেরিয়ে আকাশে উড়ে যাতে শত্রুর পিছু দাওয়া করা যায়, তার জন্য সব ব্যবস্থা থাকে ওআরপি-তে। এই গোটা অপারেশনাল এরিয়াতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে সবচেয়ে কঠোর। তবে বায়ুসেনা ঘাঁটির অন্যান্য অংশের নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র থাকাই দস্তুর। তার জন্য গোটা এলাকা ঘিরে পাঁচিল থাকে, কাঁটাতারের ঘেরাটোপ থাকে, ওয়াচ টাওয়ার থাকে, অন্ধকারে নজরদারির জন্য ফ্লাড লাইট থাকে। পঠানকোটে এই নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বেশ কিছুটা ফাঁক ছিল বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। জায়গায় জায়গায় পাঁচিল ভাঙা ছিল। সম্ভবত বেশ কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ারে রক্ষী মোতায়েন করা হয়নি। কিছু ফ্লাড লাইটও অকেজো ছিল। জঙ্গিরা তারই সুযোগ নিয়েছে। খুব সহজে ঢুকে পড়েছে বায়ুসেনা ঘাঁটির ভিতরে। এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে যথেষ্ট খোঁজখবর নিয়েই পঠানকোটে এই হামলা চালানো হয়। যে কায়দায় গ্রাউন্ড অ্যাটাক হয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্পেশ্যাল গ্রুপ নামে যে কম্যান্ডো বাহিনীই আগের বিভিন্ন জঙ্গিহানার মতো এ বারও প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠিয়েছিল এই হানাদারদের। পঠানকোট বায়ুসেনা ঘাঁটির নিরাপত্তা যে নিশ্ছিদ্র নয়, সে বিষয়ে পাকা খবর পেয়েই এই হামলার ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হয়েছিল।

গোয়েন্দা ব্যর্থতা এই ঘটনার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। পঞ্জাবের গুরুদাসপুর বা সংলগ্ন এলাকায় জঙ্গি হামলা হতে পারে বলে গোয়েন্দারা খবর পেয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু বায়ুসেনা ঘাঁটি যে টার্গেট হতে চলেছে, সে রকম পাকা খবর গোয়েন্দারা দিতে পারেননি।

সব শেষে বলতে হয় সমন্বয়ের অভাবের কথা। পঠানকোট বায়ুসেনা ঘাঁটির কাছেই রয়েছে সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট। কিন্তু জঙ্গি হামলা হওয়ার পর গ্রাউন্ড অফেন্সিভ-এর জন্য সেনাকে ডাকা হবে কি না, তা স্থির করতে পারছিলেন না বিমানঘাঁটির কর্তারা। পরে অবশ্য স্থির হয় সেনা এবং এনএসজি— দুই বাহিনীকেই ডাকা হবে জঙ্গি মোকাবিলায়। সেনা এবং এসএসজি পঠানকোট বিমানঘাঁটিতে পৌঁছনোর পর শুরু হয় নতুন সমস্যা। যে কোনও এক জন সিনিয়র অফিসারের নেতৃত্বে সব বাহিনীর একসঙ্গে অভিযান চালানো উচিত। বায়ুসেনার খুব সিনিয়র অফিসার সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তিনি এনএসজি-কে অভিযানের নেতৃত্ব হস্তান্তর করে দেন। সেনাবাহিনী আবার এনএসজি-র অধীনে কাজ করে না। এনএসজি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনস্থ। সেনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের। বিমানঘাঁটিতে অভিযান চালানোর দায়িত্ব পড়েছিল সেনার যে আধিকারিকের উপর, তিনি এনএসজি কম্যান্ডারের নির্দেশে কাজ করতে অস্বীকার করেন। কার নেতৃত্ব মেনে অভিযান হবে, তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। ইতিমধ্যেই হরিয়ানার মানেসর থেকে পঠানকোটের দিকে রওনা হয় এনএসজি’র ১০৭ জনের একটি বাহিনী। সেই বাহিনীর নেতৃত্বে যিনি ছিলেন, তিনি আবার সেনারই মেজর জেনারেল। পঠানকোটে অভিযানের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা আধিকারিক অবশেষে সেই মেজর জেনারেলের কম্যান্ডে কাজ করতে রাজি হন। তার পর শুরু হয় পুরোদস্তুর অভিযান। কিন্তু তার মধ্যে সময় অনেকটা চলে গিয়েছে।

এই পুরো পরিস্থিতি থেকে স্পষ্ট, বিভিন্ন ডিফেন্সিভ ও অফেন্সিভ ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আপৎকালীন পরিস্থিতিতে বিপদ বাড়াচ্ছে। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার সহজ উপায় রয়েছে। সাধারণত সব বিমানঘাঁটির কাছেই একটি করে সেনা ক্যান্টনমেন্ট থাকে। সেই ক্যান্টনমেন্টগুলিকে যদি আপৎকালীন পরিস্থিতিতে বায়ুসেনা ঘাঁটি রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে সমস্যা অনেকটাই মিটে যায়। সেনার সঙ্গে বায়ুসেনার বছরভর সমন্বয়ও থাকে। আপৎকালীন পরিস্থিতিতে কে কার অধীনে কাজ করবে, তা নিয়ে কোনও বিভ্রান্তিও থাকে না। আর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীও আগে থেকেই জেনে রাখতে পারে বায়ুসেনা ঘাঁটির নকশা। অভিযানে নেমে নতুন করে চিনতে হবে না এলাকাকে।

National Pathankot Army NSG Confusion over command Operation delayed
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy