Advertisement
E-Paper

অনেক প্রশ্ন রেখে চলে গেলেন অরুণা

এক জন পুরুষ মানুষ। একটা কুকুর বাঁধার চেন। আর কয়েক মিনিটের শরীর-মন ভেঙে দেওয়া অত্যাচার। তার পর শুধুই হাসপাতালের খুপরি ঘর। সেখানে বিছানায় শুয়ে এক মহিলা। চোখে দেখেন না, কিছু বলেনও না। জড়। জীবন্মৃত। সেই জড় পদার্থের মতো মানুষটার এ ভাবে বেঁচে থাকা ঘিরেই বদলে গিয়েছিল এ দেশের আইন। বাঁচার অধিকার যদি থাকে, তা হলে মরার অধিকার থাকবে না কেন, এই প্রশ্ন নাড়িয়ে দিয়েছিল ভারতের সংবিধান।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৫ ০৩:৩৯

এক জন পুরুষ মানুষ। একটা কুকুর বাঁধার চেন। আর কয়েক মিনিটের শরীর-মন ভেঙে দেওয়া অত্যাচার।

তার পর শুধুই হাসপাতালের খুপরি ঘর। সেখানে বিছানায় শুয়ে এক মহিলা। চোখে দেখেন না, কিছু বলেনও না। জড়। জীবন্মৃত।

সেই জড় পদার্থের মতো মানুষটার এ ভাবে বেঁচে থাকা ঘিরেই বদলে গিয়েছিল এ দেশের আইন। বাঁচার অধিকার যদি থাকে, তা হলে মরার অধিকার থাকবে না কেন, এই প্রশ্ন নাড়িয়ে দিয়েছিল ভারতের সংবিধান।

তিনি অরুণা রামচন্দ্র শানবাগ। ১৯৭৩-এর এক নভেম্বর-রাতে ধর্ষণ ও নারকীয় অত্যাচারের শিকার হয়ে ৪২ বছর কোমায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ছিলেন। মারা গেলেন আজ সকালে।

দিন সাতেক আগে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন অরুণা। তখন থেকেই খালি হয়ে গিয়েছিল মুম্বইয়ের পারেলে কিংগ এডওয়ার্ড মেমোরিয়াল (কেইএম) হাসপাতালের ৪ নম্বর ওয়ার্ড লাগোয়া ছোট্ট ঘরটা। সেই ঘরে অরুণার আর ফেরা হল না।

১৯৭৩-এর ২৭ নভেম্বর। রাত্রিবেলা বাড়ি ফেরার আগে জামাকাপড় পাল্টাচ্ছিলেন কেইএম হাসপাতালের নার্স ২৫ বছরের অরুণা। হাসপাতালের অস্থায়ী জমাদার সোহনলাল বাল্মীকি ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর ওপর। অরুণা যাতে পালাতে না পারেন, সে জন্য কুকুর বাঁধার চেন তাঁর গলায় পেঁচিয়ে দেয়। ধর্ষণ করতে গিয়ে দেখে অরুণার তখন ঋতুস্রাব হচ্ছে। বিরক্ত, হতাশ সোহনলাল অবশ্য তাতেও দমেনি। অরুণার সঙ্গে জোর করে পায়ু-সঙ্গম করে সে।

১১ ঘণ্টা ওই অবস্থায় পড়েছিলেন অরুণা। পর দিন সকালে যত ক্ষণে চিকিৎসকরা তাঁকে খুঁজে পেয়েছিলেন, তত ক্ষণে অরুণার মস্তিষ্ক (ব্রেন) ও সুষুম্না কাণ্ডে (স্পাইনাল কর্ড) অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন থেকেই অরুণার মস্তিষ্ক আংশিক বিকল। দৃষ্টি ও বাক্ শক্তিও চলে গিয়েছিল। প্রথম প্রথম পাগলের মতো করতেন অরুণা। কখনও বা হেসেই যাচ্ছেন, কখনও বা চিৎকার করছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তার পর অবশ্য দীর্ঘদিন কোমায় আক্রান্ত হয়েই পড়ে ছিলেন তিনি। আজ মৃত্যুর পরে রেখে গেলেন এ দেশে নিষ্কৃতি-মৃত্যু নিয়ে বহু উত্তর না-পাওয়া প্রশ্ন।

২০০৯ সালে অরুণার নিষ্কৃতি-মৃত্যুর আবেদন জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন তাঁর বন্ধু পিঙ্কি ভিরানি। পরের বছর ১৭ ডিসেম্বর আবেদন গ্রহণ করে আদালত। শীর্ষ আদালত তখন হাসপাতাল ও মহারাষ্ট্র সরকারের কাছ থেকে অরুণার শারীরিক অবস্থা নিয়ে রিপোর্ট চায়। ২০১১ সালে কোর্টের নির্দেশে একটি তিন সদস্যের মেডিক্যাল প্যানেল তৈরি হয়। অনেক টানাপড়েনের পরে শীর্ষ আদালত জানায়, কোনও বিশেষ অবস্থায় রোগীকে ‘পরোক্ষ নিষ্কৃতি-মৃত্যু’র অনুমতি দিতে পারে কোর্ট। তবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে রোগীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-বন্ধুকে। তাঁরা বললেই রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত জীবনদায়ী ব্যবস্থা বা পুষ্টিদায়ী খাদ্য ও পানীয় দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার অনুমতি দেবে কোর্ট।

অরুণার নিষ্কৃতি-মৃত্যু করা হবে কি না, সে বিষয়ে তাঁর চিকিৎসক ও নার্সের মত জানতে চেয়েছিল কোর্ট। তাঁরা কেউই এই নিষ্কৃতি-মৃত্যুতে মত দেননি। বলেছিলেন, অরুণাকে কখনওই জীবন্মৃত বলা যাবে না। তাঁর মতো করে তিনি সাড়া দেন।

২০১১ সালের ৭ মার্চ অরুণার নিষ্কৃতি-মৃত্যুর বিপক্ষে রায় দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। তবে একই সঙ্গে আদালত জানায়, যে রোগীর স্থায়ী ভাবে জড় পদার্থের মতো অবস্থা, বিশেষ ক্ষেত্রে তাঁর জন্য পরোক্ষ নিষ্কৃতি-মৃত্যুতে সম্মতি দেওয়া যেতে পারে। ভারতের আইনে এটা একটা বড় মাইলফলক।

এই রায়ের পরে নিষ্কৃতি মৃত্যু নিয়ে নতুন করে শুরু হয়েছিল আলোচনা। এই বিষয়ে আইন পাশ না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টেরই ঠিক করা বেশ কিছু নির্দেশ অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছিল। কারণ তা না হলে ভারতের মতো দেশে আত্মীয়-স্বজন সম্পত্তির লোভে এই নিয়মের অপব্যবহার করতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল শীর্ষ আদালতের।

সোহনলাল ধরা পড়ার পরে সাত বছরের সাজা খেটেছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ নয়, খুনের চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছিল। ১৯৭৩-এ পায়ু-সঙ্গমকে ভারতীয় সংবিধানে ধর্ষণের আওতায় রাখা হতো না। ২০১৩-য় সংশোধন করে এই ‘অপ্রাকৃতিক’ সঙ্গমকে ধর্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হয়। তখন সোহনলালের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা না হলেও এখন কি নতুন করে ধর্ষণের অভিযোগ আনা যায় না? মহারাষ্ট্র সরকার অবশ্য জানিয়েছে, কোর্ট না চাইলে তারা নিজে থেকে এই মামলা ফের শুরু করতে চায় না।

যাঁর সঙ্গে বিয়ে ঠিক ছিল, সেই সন্দীপ সরদেশাই সরে গিয়েছিলেন বহু দশক আগে। এত দিন পাশে ছিলেন না আত্মীয়রাও। কে শেষকৃত্য করবেন, তা নিয়ে অবশ্য আজ অরুণার দুই আত্মীয়ের সঙ্গে নার্সদের তর্কাতর্কি বেঁধে যায়। শেষ পর্যন্ত সকলের উপস্থিতিতে মুখাগ্নি করেন হাসপাতালেরই এক চিকিৎসক।

সে বার যখন অরুণার নিষ্কৃতি-মৃত্যুর আর্জি খারিজ হয়, হাসপাতালের এই চিকিৎসক-নার্সরাই মিষ্টি বিলিয়েছিলেন। বলেছিলেন ওঁর ‘পুনর্জন্ম’ হলো!

aruna shanbaug rape KEM Hospital mumbai nurse India
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy