সে দিন ছিল ২৭ মে। অসমের মরিগাঁওয়ের খইরুল ইসলাম ও আরও ১৩ জন বাংলাদেশের আলপথে দাঁড়িয়েছিলেন অসহায়। ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাঁদের তাড়িয়ে দিয়েছে রাষ্ট্র! এক দিকে বাংলাদেশের পুলিশের লাঠি, অন্য দিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের রাইফেলের নল! আর কোনও দিন অসমের মাটিতে, বাপ-ঠাকুরদার ভিটেতে ফেরা হবে না বলেই ধরে নিয়েছিলেন প্রাক্তন শিক্ষক খইরুল।
৭ জুন। মরিগাঁওয়ের খন্দাপুখুরি গ্রাম। ইদের দিনের ভরা জমায়েতে পরিবার-পরিজনের মধ্যমণি সেই খইরুল ইসলাম। এখনও এই আনন্দ অলীক বলে মনে হচ্ছে তাঁর! দুই দেশের মাঝখানে বসে থাকা দিশাহারা মানুষটা সে দিন ভাবতেও পারেননি, ইদের দিনটা কাটাতে পারবেন নিজের বাড়িতে! খইরুল ধন্যবাদ দিচ্ছেন আল্লাকে এবং ও-পারের সেই সাংবাদিকদের, যাঁদের ক্যামেরার সামনে তিনি উগরে দিয়েছিলেন নিজেদের ভারতীয় হওয়ার আকুতি, অসমের ঠিকানা।
সেই ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়েছিল অসমে। একে একে পরিবারগুলো চিনে নিয়েছিল পুলিশে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরে ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়া প্রিয়জনেদের। জানা গিয়েছিল, কী ভাবে মাটিয়া ট্রানজ়িট শিবির হয়ে, রাতের অন্ধকারে পুলিশ থেকে বিএসএফের হাত ঘুরে বাংলাদেশে ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল মানুষগুলোকে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা অবশ্য অনড় ছিলেন তখনও। বলছিলেন, ঘোষিত বিদেশিদের ফেরানো হবে না কোনও ভাবেই।কিন্তু যাঁদের মামলা চলছে, তাঁদের কথা আলাদা।
মামলা তো চলছিলই খইরুলের। সুপ্রিম কোর্টে। অন্য অনেকেরও। আর বিজিবিও তাঁদের কোনও ভাবেই দেশে ঢুকতে দেয়নি। ফলে, গত মাসের শেষ দিকে অসম জুড়ে বাংলাদেশি সন্দেহে ব্যাপক ধরপাকড়ের পরে বাংলাদেশে ‘পুশ-ব্যাক’ করা ৬০ জনের বেশি মানুষকে ফেরাতে বাধ্য হয়েছে ভারত। খইরুল, রহিমা বেগম, হাজেরা খাতুন, সোনা ভানুদের মতো একে একে অনেকে ফিরেছেন বাড়িতেও। আবার মনোয়ারা বেওয়ার মতো কারও এখনও খোঁজ নেই। পরিবার দ্বারস্থ হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের।
খইরুল বলেন, “বাংলাদেশের ঢোকার পরে বাকিরা কথা বলার অবস্থায় ছিল না। বিএসএফের ছোড়া রাবার বুলেট লাগে আমাদের এক সঙ্গীর গায়ে। আমিই ও-দেশের সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলি। সারা দিন জমিতে কাটানোর পর, বিজিবি আমাদের তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ভাত, ডাল, ডিম খেতে দেয়। পরের দিন সকালে, আমাদের অন্য ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ততক্ষণে আমার স্ত্রী আমার সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন মামলার কথা সরকারকে জানিয়েছিল। দুই দেশের মধ্যে কী কথা হয়েছে জানা নেই, তবে সন্ধ্যায় আমাদের কয়েক জনকে বিএসএফের কাছে ফেরত পাঠানো হয়।”
যাঁরা ফিরতে পেরেছেন, তাঁদের ঘরে আজ ইদের আনন্দ অনাবিল। কিন্তু সেই ইদের দিনেই সংখ্যালঘুদের আকাশে সিঁদুরে মেঘ ছড়িয়ে হিমন্ত ঘোষণা করলেন, বাংলাদেশে ‘পুশ-ব্যাক’ থামবে না, বরং বাড়বে। মুখ্যমন্ত্রী শনিবার বলেন, “নাগরিকত্ব আইনের ৬এ ধারা নিয়ে শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ জানিয়েছে, অসম সরকার বিদেশিদের শনাক্ত বা বহিষ্কার করার জন্য প্রতি বার আদালতের অনুমোদন নিতে আইনত বাধ্য নয়। জেলাশাসকেরাই বহিষ্কারের আদেশ জারি করার ক্ষমতা রাখেন। এ নিয়ে একটি পুরানো আইনি বিধান রয়েছে, তা আমরা জানতাই না। আমরা আরও বেশি, আরও দ্রুত বাংলাদেশিদের দেশছাড়া করতেতৈরি হচ্ছি।’’
বাংলাদেশের অভিযোগ, গত মাসে ১২৩৯ জনকে তাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে ভারত। মানবাধিকার সংগঠন সিটিজ়েন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস-এর অভিযোগ, অসম থেকে অন্তত ৩০০ জনকে বাংলাদেশি সন্দেহে ধরা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ১৪৫ জনের এখনও কোনও সন্ধান নেই। তাদের দাবি, যদি কাউকে ধরাও হয়, তা হলে একটি রিয়েল-টাইম বন্দি-ট্র্যাকিং সিস্টেম তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে ধৃত ব্যক্তি এ ভাবে স্রেফ উধাও না হয়ে যেতে পারেন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)