Advertisement
E-Paper

বন্ধু স্বপ্নভঙ্গের কারণ, তেলঙ্গানায় তাই রুখে দাঁড়িয়েছেন কোডানডারাম

চার বছর ধরে রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছেন কেসিআর। আর চার বছরেই দু’জনের সম্পর্ক এমন জায়গায় গিয়েছে, যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। প্রকাশ্যে একে অন্যের নামে অশোভন মন্তব্য করতে শোনা যায়।

উজ্জ্বল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৮ ১৬:০৭
দলীয় এক কর্মীর সঙ্গে নিজের বাড়িতে কোডানডারম (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র

দলীয় এক কর্মীর সঙ্গে নিজের বাড়িতে কোডানডারম (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র

ডোরবেল বাজতেই কালো সুঠাম এক ভদ্রলোক দরজা খুলে দিলেন। ধূসর ট্রাউজার্স, নীল টি শার্ট। মাথায় কালোর লেশমাত্র নেই।

একটা সময়ে রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বন্ধু ছিলেন। দুই বন্ধুর চাওয়া এক ছিল। পাওয়াটাও এক। কিন্তু, সেই প্রাপ্তিই দু’জনকে আলাদা করে দিয়েছে। শুধু আলাদা নয়, দু’জনকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সম্মুখ সমরে।

এক বন্ধুর নাম কে চন্দ্রশেখর রাও (কেসিআর)। অন্য জন, এম কোডানডারাম। একটা দীর্ঘ সময় আলাদা রাজ্যের দাবিতে ‘তেলঙ্গানা জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি’ নামের যে সংগঠন আন্দোলন চালিয়েছে, তখন একে অন্যের পরিপূরক ছিলেন এই দুই বন্ধু। কোডানডারাম ছিলেন ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান। একসঙ্গে আলোচনা, পরামর্শ, আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নানা পরিকল্পনা— সবটাই অত্যন্ত নিবিঢ় ভাবে করতেন দু’জনে। রাজনীতির পরিধি ছাড়িয়ে নতুন রাজ্যের দাবি যে গণ আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল, তাতে এই দুই বন্ধুর অবদান মনে রাখবে ইতিহাস। নিজেদের মতানৈক্যকে কী ভাবে ঐকমত্যে পাল্টে ফেলা যায়, তার কৌশলও জানতেন ওঁরা। তাই দীর্ঘ পথচলায় কোথাও কোনও সমস্যা হয়নি। সফল আন্দোলন শেষে মিলেছে নয়া রাজ্য। যার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন কেসিআর।

সমস্যার শুরুটা সেখান থেকেই। চার বছর ধরে রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছেন কেসিআর। আর চার বছরেই দু’জনের সম্পর্ক এমন জায়গায় গিয়েছে, যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। প্রকাশ্যে একে অন্যের নামে অশোভন মন্তব্য করতে শোনা যায়। শেষমেশ গত মার্চে নিজের রাজনৈতিক দলও তৈরি করে ফেলেছেন কোডানডারাম। নাম দিয়েছেন তেলঙ্গানা জন সমিতি (টিজেএস)। এ বারের নির্বাচনে সেই দল লড়াইয়ে নেমেছে কেসিআরের তেলঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি (টিআরএস)-কে হারাতে। কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মহাজোটে অংশও নিয়েছে টিজেএস। আটটি কেন্দ্র থেকে প্রার্থীও দিয়েছে তারা।

আরও পড়ুন: ভেমুলার স্মৃতি উস্কে দলিত ছাত্রের মৃত্যুতে উত্তপ্ত হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়

কিন্তু, নতুন এই দলকে ভোট দেবে কে? সেই পরিচিতি আছে?

ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তন অধ্যাপক প্রশ্নটা শুনে একটু চুপ করে গেলেন। সামনে ভিন্ রাজ্যের সাংবাদিক ছাড়াও রয়েছেন নতুন দলের একাধিক কর্মী। তাই হয়তো একটু গুছিয়ে নিতে চাইলেন। তার পর বললেন, ‘‘তেলঙ্গানা রাজ্য কী ভাবে আদায় করা হয়েছে, তা সকলেই জানেন। সেই আন্দোলনে কেসিআর বা জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটির কী ভূমিকা, সেটাও সর্বজনবিদিত। কিন্তু, একটা মানুষ যদি ক্ষমতা হাতে পেয়ে সব ভুলে যায়, জনগণ তো তার বিরুদ্ধে যাবেই। সেই মানুষই আমাদের সঙ্গে আছেন। সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভটা আমাদের ভোটে রূপান্তরিত হতে সময় নেবে হয়তো। কিন্তু আমরা আশাবাদী।’’

একটা দীর্ঘ সময় পথ চলার সঙ্গী ছিলেন কেসিআর। সেই বন্ধুই আজ কার্যত শত্রু, অন্তত ভোটের ময়দানে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হল কেন? কোডানডারাম গোটাটার পিছনে ক্ষমতাকেই দায়ী করছেন। তাঁর অভিযোগ, রাজপাটের দায়িত্ব পেয়ে কেসিআর নিজেকে পাল্টে ফেলেছেন। তাঁরা এই তেলঙ্গানা চাননি। মানুষ যাঁকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে সেই তিনি মানুষের সঙ্গে মেশেন না। এমনকি, নিজের দলের বিধায়ক থেকে শুরু করে কর্মী— কারও সঙ্গেই দেখা করেন না কেসিআর। তিনি যদি চান, তবেই ডেকে পাঠিয়ে কথা বলেন। নচেৎ নয়। বন্ধু কোডানডারামকেও তিনি দেখা করার অনুমতি দিতেন না। ফোনেও কথা বলতে চাইতেন না। কোডানডারামের কথায়: ‘‘প্রত্যেকটা মানুষের আত্মসম্মান বোধ আছে। কেসিআর ক্ষমতা দিয়ে রাজ্যবাসীর সেই আত্মসম্মানের জায়গাটাতেই বড়সড় আঘাত হেনেছেন।’’

কোডানডারমের দল টিজেএস-এর প্রচারে ব্যানার। —নিজস্ব চিত্র

তত ক্ষণে সকলের জন্য চা এসে গিয়েছে। কাপে হালকা চুমুক দিয়ে ষাটোর্ধ্ব শিক্ষক জুড়লেন, ‘‘আত্মসম্মানের সঙ্গে বাঁচব বলেই তো আমরা নতুন রাজ্য আদায় করেছিলাম। গণতন্ত্রের বদলে স্বৈরাচার মেলে যদি, সেটা কি সমর্থনযোগ্য? উনি তো নিজের মতো রাজ্য চালাচ্ছেন। তাতে ওঁর পরিবারের লাভ হয়েছে। কিছু ঠিকাদারের লাভ হয়েছে। কিন্তু, জনগণ কোনও সুফল পায়নি।’’

আরও পড়ুন: করতারপুর করিডর মানেই আলোচনা নয়, সার্কের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে কড়া বার্তা সুষমার

নতুন রাজ্যের দাবিতে তাঁরা যখন লড়াই করছেন, তখন চন্দ্রবাবু নায়ডুর তেলুগু দেশম পার্টি (টিডিপি) তার বিপক্ষে ছিল। সেই টিডিপির হাত ধরে নতুন লড়াইটা বিসদৃশ্য লাগছে না রাজ্যবাসীর কাছে? যাঁরা তেলঙ্গানা চেয়েছিলেন তারা কি টিডিপির সঙ্গে এই জোট মেনে নেবেন? কোডানডারামের যুক্তি অন্য। তাঁর মতে, একটা নির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা নিয়েই এই জোট তৈরি হয়েছে। সেখানে রাজনৈতিক মতাদর্শের থেকেও রাজ্যকে নতুন পথে চালিত করার ভাবনাই গুরুত্ব পাবে। সে কারণেই টিজেএস সমর্থন করেছে টিডিপিকে। এর মধ্যে সমস্যার কিছু দেখছেন না তিনি।

নতুন দলের রূপকার নিজে। কিন্তু, নির্বাচনে দাঁড়াননি। তাঁর দল থেকে যাঁরা টিকিট পেয়েছেন, তাঁদের সেই অর্থে কোনও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও নেই। কেউ পেশায় চিকিৎসক, কেউ গৃহবধূ, কেউ বা আবার নিতান্তই ছাত্র। এ দিয়ে কি টিআরএসের মতো সংগঠিত দলের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো যায়? প্রচারে গিয়ে এমন প্রশ্নও শুনতে হচ্ছে কোডানডারামকে। অনেকে তাঁর দলকে ‘আল্ট্রা লেফ্ট’ বলেও কটাক্ষ করছেন। কিন্তু, সে সবে কান দিচ্ছেন না প্রৌঢ়। সারা জীবনে অনেক আন্দোলন করেছেন। নতুন রাজ্য আদায়ের দাবিতে পথে থেকেছেন দীর্ঘ দিন। কিন্তু যে তেলঙ্গানার স্বপ্ন দেখতেন তাঁরা, ভেবেছিলেন সেই রাজ্যই বানিয়ে দেবেন কেসিআর। বাস্তবে সেটা হয়নি বলেই কেসিআরের এক কালের বন্ধুর ক্ষোভ।

কোডানডারামের কথা জুড়ে শুধু থাকল, এই সরকারের আমলে রাজ্যে এমন কোনও উন্নতি হয়নি, যা সাধারণ মানুষের কাজে লাগে। একটা অংশের মধ্যে উন্নয়নের নামে টাকা বিলানো হয়েছে। যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার সব ক’টাই রাখতে ব্যর্থ টিআরএস। বেকার সমস্যা বেড়েছে। কৃষকের দুঃখ বেড়েছে। আর সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে, কেসিআরের উন্নাসিকতা এবং মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া। যেটা তেলঙ্গানার মানুষের আত্মসম্মানে আঘাত বলেই মনে করছেন ওই প্রৌঢ়।

কথা শেষে বেরিয়ে আসার সময়, দরজা দিতে দিতে ভোট দেখতে আসা সাংবাদিকের উদ্দেশে কোডানডারাম ভাসিয়ে দিলেন ছোট্ট একটা মন্তব্য: ‘‘বন্ধু যদি স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়, তবে তাঁর বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ানো যায়। তাতে অন্যায় কিছু নেই।’’

(ভারতের রাজনীতি, ভারতের অর্থনীতি- সব গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে আমাদের দেশ বিভাগে ক্লিক করুন।)

Assembly Elections 2018 Telangana Assembly Election 2018 KCR
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy